কমিকসের লক্ষ্য– পাঠক যে বয়সসীমার মানুষ, সেই সীমামধ্যস্থ মেয়েরা কমিকসের পাতায় দুর্লভ। নারায়ণ দেবনাথের শুঁটকি-মুটকি, দিলীপ দাসের ছুটকি-বড়কি, তুষার চট্টোপাধ্যায়ের মুমু, উদয় দেবের ছুটকি, হাতেগুনে এই ক’টি নাম বলা যায়। পাশাপাশি এটাও বলতে পারা যায়, মূল ধারার আঁকিয়ে-লিখিয়েরা তেমনভাবেই মেয়েদের দেখিয়েছেন, যেমনটা তাঁরা মেয়েদের দেখতে চান। সেই চাওয়াটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিতান্ত একটেরে।
‘বাংলা কমিকস’ বলতে সবার আগে কোন কোন নাম মনে পড়ে? অবশ্যই নারায়ণ দেবনাথ, ময়ূখ চৌধুরী, খুব বেশি হলে অহিভূষণ মালিক। কমিকসের ব্যাকরণ বাংলায় যাঁর হাতে বেশ ঠিক-ঠিক রূপ পেয়েছিল, সেই সুখলতা রাও-এর কথা বিশেষ আলোচিত হয় না। সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ‘ছবি ও গল্প’-এরও আগে ১৯২১-এ যিনি ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশ করেন তাঁর ছবিতে গল্প ‘যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল’। ‘কমিকস কালচার কালেকটিভ’-এর উদ্যোগে ‘কমিকস ইন বেঙ্গল’ নামে শুরু হয়েছে এক প্রদর্শনী; এক মাস ধরে বাংলার ২৩৫ জন শিল্পীর বিভিন্ন ধারার বিভিন্ন স্বাদের কাজ সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে, চর্চিত হচ্ছে। সুখলতার প্রথম ছবিগল্পটি সেই প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ তো বটেই।
চারটি ছবির বাক্সে আলাদা আলাদা ফ্রেমে এর গল্প ধরা। চারটি ছবির প্রথমটিতে দেখানো হয়, সিধু গয়লাকে জব্দ করবে বলে এক কিশোর স্কুল পালিয়ে দেওয়ালের এক পাশ থেকে জলের পিচকিরি হাতে অপেক্ষা করছে। দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যায়, গয়লার পিছনে আসছেন মাস্টারমশাই, বেচারা ছেলে দেওয়ালের ওপাশে তা দেখতে পায়নি। তৃতীয় ছবিতে সিধু গয়লা এক পাশে সরে যাওয়ায় ছেলেটির পিচকিরির জল হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ে মাস্টারমশাইয়ের চোখেমুখে, ‘হেই!’ বলে তিনি চমকে ওঠেন, আর চতুর্থ ছবিতে ছেলেটি ঘাবড়ে গিয়ে পালাতে থাকে, মাস্টারমশাই তাড়া করেন তার পিছনে। একটি বহমান ঘটনাংশকে টুকরো টুকরো ফ্রেমে উপস্থাপিত করার যে ছক তিনি ব্যবহার করেছেন, তা-ই কমিকসের প্রচলিত ছক। স্থির ছবির অন্তর্গত গতি ও চলমানতা সহজেই ধরা পড়ে এই ছবিগল্পে। আরও উল্লেখ্য, এই ছবিগল্পে স্পিচ-বেলুন ব্যবহার করেছেন সুখলতা, এতদিন ধারণা ছিল, বাংলা কমিকসের ধারায় এটা প্রথম। যদিও প্রদর্শনীতে সুখলতার এই কাজের কয়েক মাস আগের একটি কমিকস প্রদর্শিত, যেখানে স্পিচ-বেলুনের প্রয়োগ দেখা যায়।
সুখলতার বাকি তিনটি কমিকসে বা ছবিগল্পে কিন্তু স্পিচ-বেলুন নেই। ১৩২৮-এর চৈত্রে ‘ডিম রেঁধেছি খাসা’ বলে যে কমিকস আঁকেন, তা আসলে ছবি-ছড়ার মিশেল। এই বিশেষ প্যাটার্ন অনুসরণ করে সুখলতা এরপর ‘সন্দেশ’-এ ১৩৩০-এর আষাঢ়ে আর ১৩৩১-এর বৈশাখ সংখ্যায় আরও দু’টি কমিক স্ট্রিপ কিংবা ছবি-ছড়া বের করেন– ‘ঘুমের ঘোরে’ আর ‘ময়রার চোর ধরা’। এ-ছাড়া ‘পিঠে ভাগ’ নামে একটি কার্টুন স্ট্রিপ-ও এঁকেছিলেন তিনি ১৩৩১-এর জ্যৈষ্ঠে। এদের মধ্যে ‘ঘুমের ঘোরে’ আছে প্রদর্শনীতে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মৈত্রেয়ীরও বছর দশেক পরে কবিতা প্রভাকরণ মুখোপাধ্যায়কে পাওয়া যায় কমিক্স-শিল্পী হিসেবে, সত্যজিৎ যাঁর নাম দিয়েছিলেন– হিজিবিজবিজ। যদিও এঁর কোনও কাজ প্রদর্শনীতে আপাতত নেই। হিজিবিজবিজ নামেই ‘সন্দেশ’-এ ‘ন্যাড়ার কমিক্স’ লিখতেন তিনি। এক ন্যাড়ামাথা ছেলে, হাফ শার্ট হাফ প্যান্ট, তার বিচিত্র কীর্তিকলাপের গপ্প! ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬– প্রায় এক দশক ধরে সব মিলিয়ে ১৩টি কমিক্স এঁকেছিলেন এই শিল্পী।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সুখলতা ছাড়া তাঁর সমকালে আর কোনও বাঙালি মেয়ে কমিকস-নির্মাতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেননি। অন্তত এখনও অবধি তেমন কারওর সন্ধান মেলেনি। প্রায় ৫-৬ দশক পরে, মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায় নামক এক শিল্পী কমিকস-পাঠকমহলে পরিচিতি পান। এখনও পর্যন্ত যা জানি, ‘শুকতারা’ ও ‘নবকল্লোল’-এ তাঁর মোট চারটি ছবিগল্প ছাপা হয়। ‘বোকা হীরু’, ‘ঘুঘুর ভাই ফাঁদ’, ‘বোকা গিন্নীর কাহিনী’ আর ‘প্রবাহনের স্বপ্নভঙ্গ’। চতুর্থটি অবশ্য সবার আগে ছাপা হয়। এই ছবিগল্পের থেকে বাকি তিনটি কাজ লক্ষণীয়ভাবে আলাদা; ছবিতে নয়, বক্তব্যে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে। এর মধ্যে ‘বোকা হীরু’র ছবিগল্পের অংশ প্রদর্শিত হয়েছে ‘কমিকস কালচার কালেকটিভ’-এর প্রদর্শনীতে। ১৩৭৯ অগ্রহায়ণ (১৯৭২) থেকে ১৩৮০ বৈশাখ (১৯৭৩)-এ ছাপা হয় এটি। লোককাহিনির উপাদান নিয়ে এই ছবিগল্প তৈরি। হীরু নামের সরলমতি যুবকের (যাকে সবাই ‘বোকা’ বলেই চিহ্নিত করে) ভালবাসায় এক অভিশপ্ত রাজকন্যা বেড়াল থেকে মানুষ রূপ ফিরে পায়। এই ছবিগল্পটির কিছু বছর পরে মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায় ‘বোকা গিন্নীর কাহিনী’ নামে আরেকটি কমিকস বের করেন, তার সঙ্গে আখ্যানগত সাযুজ্য আছে ‘বোকা হীরু’র কমিক্সটির। বুদ্ধির ওপর হৃদয়বলের জয়– এটাই মৈত্রেয়ীর গল্পগুলির সাধারণ থিম। অ্যাকশনসমৃদ্ধ অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ মারমার-কাটকাট কমিকস-জগতের সমান্তরালে মৈত্রেয়ী এক বিশেষ ঘরানা তৈরি করেছিলেন, একথা অবশ্য-উল্লেখ্য।
মৈত্রেয়ীরও বছর দশেক পরে কবিতা প্রভাকরণ মুখোপাধ্যায়কে পাওয়া যায় কমিকস-শিল্পী হিসেবে, সত্যজিৎ যাঁর নাম দিয়েছিলেন– হিজিবিজবিজ। যদিও এঁর কোনও কাজ প্রদর্শনীতে আপাতত নেই। হিজিবিজবিজ নামেই ‘সন্দেশ’-এ ‘ন্যাড়ার কমিক্স’ লিখতেন তিনি। এক ন্যাড়ামাথা ছেলে, হাফ শার্ট হাফ প্যান্ট, তার বিচিত্র কীর্তিকলাপের গপ্প! ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬– প্রায় এক দশক ধরে সব মিলিয়ে ১৩টি কমিকস এঁকেছিলেন এই শিল্পী। যার মধ্যে সাতটি এক পাতার, বাকিগুলি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ। শেষ গল্পে ন্যাড়ার সঙ্গে এসেছিল এক চতুষ্পদ পোষ্য, যার নাম আবার নেড়ি। ছোটদের জন্যে তৈরি কমিকসের ভাণ্ডারে মজা তৈরির উপাদান প্রভূত পরিমাণে ব্যবহার করেছেন তিনি। তার মধ্যে একটির উদাহরণ দিতে চাই। ন্যাড়াকে তার বন্ধু নেকু তাদের ক্লাবের পত্রিকার জন্য ‘একটা দম ফাটানো হাসির ছড়া’ লিখে দেবার অনুরোধ করে। এই নেকুর চেহারাটা দুর্দান্ত। তার হাত-পা-গা সবই মানুষের মতো, শুধু মাথাটা ত্রিকোণাকৃতি। আর গোটা গল্পে তার একটাই চোখ দেখতে পাওয়া যায়। স্বাভাবিক, আরেকটা চোখ তো পাতার ওপাশে থাকবে, দেখা যাবে না। তো সেই বন্ধু নেকুর অনুরোধে সাড়া দিয়ে ন্যাড়া ছড়া লিখতে বসে। কিন্তু এক সপ্তাহ জুড়ে ন্যাড়া কেবল তার পেনসিলটা চিবোয়, লিখতে আর পারে বা। শেষ ছবিতে দেখা যায়, লেখার তাগাদা নিয়ে এসে নেকু দেখছে, গোলগাল ন্যাড়া হাসির কথা ভেবে ভেবে একেবারে হাড়-জিরজিরে হয়ে গেছে, জামাও ঢিলে।
অতএব বাংলা কমিকস-শিল্পী হিসেবে মেয়েরা অনুপস্থিত, একথা বলা যায় না। কমিকসের সম্পূর্ণ কাজ না হলেও বিভিন্ন সময় কমিকসের গল্প, চিত্রনাট্য বা ছবির কাজে যুক্ত থেকেছেন অরুন্ধতী মুন্সী, চুমকি চট্টোপাধ্যায় বা পুতুল ঘোষালদের মতো অনেকেই। পরীক্ষামূলকভাবে নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কাঙাল মালসাট’-এর গ্রাফিক পরিবেশন করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মধুজা মুখোপাধ্যায়। এর ভূমিকায় মধুজা বলেছিলেন, ফ্যাতাড়ু-চোক্তারদের ‘ম্যাসকুলিন’ ভঙ্গিমার সঙ্গে ‘লড়ে যাওয়ার’ উদ্দেশ্যেই তাঁর এই কাজ। সুমন মুখোপাধ্যায়ের দৃশ্যরূপের অনুষঙ্গে এই গ্রাফিক নভেলটি নির্মিত। আর আদিম ঝুলকালি-অন্ধকারের রূপ দিতে চেয়ে গোটা ছবিরূপেই কালো রঙের আধিক্য, কখনও সেখানে মেশে ঘন লাল, ঘষা কালো বা ধূসর। উল্লেখিত প্রদর্শনীতে সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি রয়েছে, এই রকমের সংলগ্নতার কথা মনে রেখে বা তাকে মান্যতা দিতে চেয়েও। কিন্তু আনুপাতিক বিচারে মেয়েদের কমিকসের সংখ্যা আশ্চর্যরকমের কম। দুর্ভাগ্যজনক, ২৩৫টি কাজের মধ্যে মাত্র ৪টি মেয়েদের কাজ।
এই তথ্য না জানলেও হয়তো কমিকস-রসিকের চলে যায়, কিন্তু জানলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া দুষ্কর। শুধু নারীশিল্পীর সংখ্যা নয়, বাংলা কমিকসে মেয়েদের উপস্থিতিই বা কতটা?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ক্যানভাসে খেলার ছবি, ধরে রাখছে সংগ্রামের ইতিহাস
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক কমিকসের প্রেক্ষিতে খুঁজলে বাংলা কমিকসের মেয়েদের উপস্থিতি নগণ্য, উপস্থাপন ততোধিক একমাত্রিক। মা-পিসিমা-জেঠিমা শ্রেণির মহিলা, যাঁদের গার্হস্থ্য পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে গার্হস্থ্য ভূমিকাতেই স্থাপন করা যায়; কখনও রান্না করতে, কখনও ঝাঁট দিতে, কখনও শাসন করতে দেখা যায় তাঁদের। দ্বিতীয়ত, বিশেষ অভাব আছে কিশোরী চরিত্রের। ফানিসের পরিধিতে কেন্দ্রচরিত্র হিসেবে কোনও কিশোরী নেই। কমিকসের লক্ষ্য– পাঠক যে বয়সসীমার মানুষ, সেই সীমামধ্যস্থ মেয়েরা কমিক্সের পাতায় দুর্লভ। নারায়ণ দেবনাথের ‘শুঁটকি-মুটকি’, দিলীপ দাসের ‘ছুটকি-বড়কি’, তুষার চট্টোপাধ্যায়ের ‘মুমু’, উদয় দেবের ‘ছুটকি’– হাতেগুনে এই ক’টি নাম বলা যায়। পাশাপাশি এটাও বলতে পারা যায়, মূল ধারার আঁকিয়ে-লিখিয়েরা তেমনভাবেই মেয়েদের দেখিয়েছেন, যেমনটা তাঁরা মেয়েদের দেখতে চান। সেই চাওয়াটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিতান্ত একটেরে। তৃতীয়ত, কিশোরীবেলার যে নির্দিষ্ট অনুভূতিতরঙ্গ, তার সূত্রও বাংলা কমিকসে বিরল। বেশ অনায়াসে হেনরি বা আর্চি কমিকসের দুনিয়ায় যা দেখা গিয়েছিল, সেই কিশোর-কিশোরী সম্পর্কের স্বতঃস্ফূর্ত রসায়নও নেই এই পরিসরে।
যেসব প্রশ্নগুলো তাই থেকে যায়, মীমাংসাহীনভাবে–
এই নারীবিযুক্তির কারণ ঠিক কী? প্রায়-নারীবিযুক্ত একটা দুনিয়া তৈরি করে বাংলা ফানিসকে কি খুব ‘নিষ্পাপ’ বলে প্রতিপন্ন করতে চাইলেন শিল্পীরা? সচেতনভাবে না চাইলেও, তেমনটা কি বাজারের চাহিদা ছিল? বেতাল বা ম্যানড্রেকের মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় (এবং কিশোরপাঠ্য) বিদেশি কমিকসের অনুবাদে মেয়েদের যে ‘মোহময়’, ‘ইন্দ্রিয়ময়’ উপস্থাপন ঘটেছিল, তাকে কি অস্বীকার করা যায়? বাংলা ছোটদের ফানিস ও একটু বড়দের চিত্রকথায় দৃশ্যত যে উপস্থিতি রয়েছে মেয়েদের, তার ধরনই বা কেমন? সেখানেও কি উদ্ভট রসবোধের আক্রমণ ঘটেনি? শরীর-রাজনীতির পুরুষতান্ত্রিক ভাষায় সেই ছবি কথা বলেনি?
‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’-তে একমাস ধরে চলা প্রদর্শনীতে ২ মার্চ কমিকসে মেয়েদের উপস্থাপন বিষয়ে একটি আলোচনাসভাও হতে চলেছে। কথা বলবেন মধুজা মুখোপাধ্যায়, অনন্যা সাহা, দেবাঞ্জনা নায়েক ও দেবকুমার মিত্র। আশা করা যায়, এইসব প্রশ্ন ও সচেতন তর্কের অবকাশ সেখানে গড়ে উঠবে।