মেয়েরা জানে, এক-একটা করে ধর্ষণ হয় আর তার নারকীয়তার বর্ণনা যখন নতুন করে গোটা শরীরে ছেড়ে দেয় কাঁকড়াবিছে, তখন তারা মনে মনে নিজের জন্য মৃত্যু কামনা করে ধর্ষণের বদলে। প্রতিবার। আর সুতন্দ্রার জীবন সেই নিয়তিকেই জড়িয়ে নিয়েছে আপ্রাণ। ধর্ষিতা হতে না চেয়ে তাকে মরে যেতেই হয়েছে শেষমেশ। তবু এ মৃত্যু ‘হত্যা’ কি না, তা নিয়ে তরজা চলবে। এ মৃত্যুর নেপথ্যে ধর্ষণের ভয় ছিল কি না, সে প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে শোনানো হবে এমন এক কাহিনি যাতে মনে হবে নিশুতি রাতে মেয়েটিরই বুঝি ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার ইচ্ছে হয়েছিল।
এক পৃথিবী হাঁটতে চেয়েছিল মেয়েটা। অন্য কারও জন্য নয়, নিজেরই জন্য। যে-সমস্ত ভয় তার পায়ে অদৃশ্য শিকল পরিয়ে রেখেছে– ধর্ষিতা হওয়ার ভয়, নোংরা কথা গায়ে লেগে যাওয়ার ভয়, ‘খারাপ মেয়ে’ হয়ে যাওয়ার ভয়, ‘লোকে কী বলবে’-র ভয়; সেইসব ভয় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে এক রাতে সে হাঁটতে চেয়েছিল। যদি কোনও দিন তার মুঠোয় আসে একখানা পুরুষহীন পৃথিবী, সেই গোটা দুনিয়াটা জুড়ে সে কেবল হেঁটে যেতে চেয়েছিল রাতের রাস্তায়।
সেই মেয়েটার কথা শুনে আমার মনে পড়েছিল মাস কয়েক আগের একটা মুহূর্ত। এসপ্ল্যানেড পাড়া জুড়ে তখন আওয়াজ উঠেছে বিচার চাওয়ার। আর মানুষের জোড়া জোড়া পায়ের নিচ থেকে ক্রমে মুছে আসছে দিনের আলো। তবু সে অন্ধকারে পা বাড়াতে ভয় করছিল না মোটে। ট্রামলাইনের দিকের ফাঁকা ফাঁকা চত্বরে অন্য কোনও দিন একা যেতে গেলে শরীরে নিশ্চিত মেখে নিতাম বাড়তি সতর্কতা। জন্মসূত্রে পাওয়া একটা মেয়ে-শরীর যে সতর্কতা রোজ রোজ আমাদের মুখস্থ করিয়েছে। কিন্তু সেদিন, সন্ধে-ঘনিয়ে আসা আলো-আঁধারিতে কালো পিচরাস্তায় পা ফেলতে ফেলতে আশপাশ থেকে মুছে যাচ্ছিল যাবতীয় ভিড় কিংবা নির্জনতা। মানুষে মানুষে ভরে থাকা এক রাতের যাদবপুরেও যেমন, অজগরের মতো পড়ে থাকা রাস্তায় একা পা বাড়াতে শঙ্কা হচ্ছিল না। যে-কোনও রাস্তায়, যে-কোনও সময়ে একা হাঁটার অধিকার দখল করে নিচ্ছিলাম আমি, আমরা।
সেই সময়েই যদিও ভেসে আসছিল সযত্ন সাবধানবাণী। কর্মস্থলে মেয়েদের রাতের ডিউটি বন্ধ হোক। যাকে বলে ‘বিধিসম্মত সতর্কীকরণ’। অর্থাৎ, রাতে কাজে গেলে ধর্ষিতা হয়ে যেতেই পারে কোনও মেয়ে, এমনকী, খোদ মহানগরের বুকের উপর সরকারি হাসপাতালেও। কিন্তু কথা না-শুনেই তো মেয়েরা লক্ষ্মণরেখা ভেঙে এগিয়েছে বরাবর, নইলে মেয়েদের ইতিহাস খাঁচার গরাদের বাইরে বেরত থোড়াই! তাই নাইট ডিউটিতে মরে যাওয়া মেয়ের কথা মনে রেখেই মেয়েরা লাগাতার মনে করিয়ে দিয়েছে, রাতটাও তাদের অধিকার, দিনেরই মতো। কেবল অধিকার নয়, বাধ্যতাও বইকি, কেন-না নিজের ইচ্ছেমতো কাজের স্থান-কাল বেছে নেওয়ার সুযোগ শ্রমের দুনিয়া কাউকেই দেয় না। ফলে কোনও কিছু মনে রেখে বা না-রেখেই মেয়েরা রাতে কাজে বেরিয়েছে কিংবা কাজ থেকে ফিরেছে। রোজ।
কিংবা কেউ কেউ ফেরেনি। মদ্যপদের গাড়ির তাড়া থেকে বাঁচতে গিয়ে সদ্য ‘নেই’ হয়ে যাওয়া মেয়েটা যেমন। রাতে কাজ করতে গিয়ে যে-মেয়ে খুন হয়েছিল, তারই মতো, কাজের ডাকেই রাতের রাস্তায় বেরিয়েছিল সে মেয়ে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার কাজে দিনক্ষণের হিসেব থাকে নাকি! হিসেব থাকে না ভিনরাজ্যে যাওয়ারও। এবারও তেমন, রাত্রিবেলাতেই গয়া যাওয়ার দিকে পাড়ি দিয়েছিল চন্দননগরের বাসিন্দা, বছর সাতাশের সুতন্দ্রা চট্টোপাধ্যায়ের গাড়ি। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনো হয়নি আর, হয়নি বাড়ি ফেরাও। পেট্রোল পাম্পে তেল নিতে গিয়েই এক গাড়ি মদ্যপ যুবকের নজরে পড়ে গিয়েছিল সুতন্দ্রার গাড়িটি, বলছেন গাড়ির চালক। গাড়ির ভিতরে ‘টাটকা’ একটা মেয়ে, অতএব উত্যক্ত তো করাই যায়। খেলার ছলে ধাক্কা মারা যায় গাড়িতে, যেভাবে খেলিয়ে খেলিয়ে ইঁদুর শিকার করতে চায় বিড়াল। সেই লোভের থাবা থেকে বাঁচতেই অসহায় মরণছুট, যার পরিণতি গাড়িটির উল্টে যাওয়া এবং সুতন্দ্রার মৃত্যুতে।
এ মেয়ের অবশ্য নাম বলা চলে খোলাখুলি, কেন-না সে তো ‘ধর্ষিতা’ হয়নি। মেয়েরা জানে, এক-একটা করে ধর্ষণ হয় আর তার নারকীয়তার বর্ণনা যখন নতুন করে গোটা শরীরে ছেড়ে দেয় কাঁকড়াবিছে, তখন তারা মনে মনে নিজের জন্য মৃত্যু কামনা করে ধর্ষণের বদলে। প্রতিবার। আর সুতন্দ্রার জীবন সেই নিয়তিকেই জড়িয়ে নিয়েছে আপ্রাণ। ধর্ষিতা হতে না চেয়ে তাকে মরে যেতেই হয়েছে শেষমেশ। তবু এ মৃত্যু ‘হত্যা’ কি না, তা নিয়ে তরজা চলবে। এ মৃত্যুর নেপথ্যে ধর্ষণের ভয় ছিল কি না, সে প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে শোনানো হবে এমন এক কাহিনি যাতে মনে হবে নিশুতি রাতে মেয়েটিরই বুঝি ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার ইচ্ছে হয়েছিল। প্রথমে মেয়েটির ফ্রন্ট ফেসের ছবি খবরে এলেও, পরে সে কাহিনির সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই কভার পেজ বদলে যাবে তার নাচের পোশাক পরা অপাঙ্গে তাকানোর ছবিতে, যাতে ‘নৃত্যশিল্পী’ পরিচয়টির দিকে বাঁকা চাহনির ইশারা টেনে আনা যায়।
এমন আরও কত কী ঘটে যাবে, রোজ! যেমনটা ঘটেই থাকে কোনও মেয়ে মরে গেলে। যেমনটা হবে বলে মেয়েরা জানে। তাই কোনও সমীক্ষা যখন প্রশ্ন করে, গভীর জঙ্গলে একা পড়ে গেলে কার দেখা পেতে চান, একজন পুরুষ না একটি ভাল্লুক– সেখানে আটজনের মধ্যে সাতজন মেয়েই বুঝিয়ে দেয় বন্য জন্তুটিকেই বরং বেশি নিরাপদ বলে মনে করছে তারা। কেন-না ভাল্লুক তো মেরে ফেলার আগে বা পরে ধর্ষণ করবে না। কেন-না ভাল্লুকের হাতে মৃত্যু হলে তো মেয়েটির দিকে পোশাক-চরিত্র-হাবভাব নিয়ে প্রশ্নের তর্জনী উঠবে না। কেন-না ভাল্লুকের আক্রমণের কথায় অবিশ্বাস করে মেয়েটির শরীরী হাতছানি আর ‘দর কষাকষির ঝামেলা’ নিয়েও গল্প বানানো হবে না। ছোট থেকে বড় হতে হতে ঘরে-রাস্তায়-গাড়িতে-অফিসে ঘিনঘিনে চাউনি, লোভী ছোঁয়া আর তার পালটা ধেয়ে আসা এই যাবতীয় প্রশ্নমালা কিংবা আত্মরক্ষার গাইডবুক– এসব কিছু মেয়েদের ‘কালেকটিভ সাইকি’তে জাগিয়ে রেখেছে বিপন্নতার বয়ান। যে বিপন্নতার বয়ান ‘নট অল মেন’-এর আগে ‘আ লট অফ মেন’-এর ইতিহাসকে খেয়াল রাখে। আর সেই কারণেই, রাত হোক বা দিন, ঘরে হোক কি বাইরে, ভয় জাগিয়ে রাখে মনে। একা নয়, অপর হয়ে যাওয়ার ভয়। যে অপরের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র যৌন আক্রমণ, এ কথা নারী ও পুরুষ উভয়েরই জানা।
তাই, কোনও বিদ্বেষ নয়, স্রেফ বিপন্নতা থেকেই কোনও কোনও মেয়ে নির্জন অরণ্যে পুরুষের বদলে ভাল্লুকের সাহচর্যকে শ্রেয় বলে মনে করে; কিংবা কোনও মেয়ে মনে মনে একবারের জন্য এমন একটা পৃথিবী দেখতে চায়, যেখানে কোনও পুরুষ নেই বলে সে রাতে হাঁটতে বেরনোর সাহস বা অধিকার ফিরে পেয়েছে। যে রাতের রাস্তায় সুতন্দ্রা ধর্ষিতা হতে না চেয়ে প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করছিলেন, সেই রাতেই, রাস্তায় হাঁটতে চাওয়ার এই সামান্য ইচ্ছেটুকু ভেসে এসেছিল এক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে। ভেসে এসেছিল কোনও এক মেয়ের একটা প্রশ্ন, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পৃথিবীতে কোনও পুরুষ না থাকলে মেয়েরা কী করতে চায়? যার উত্তরে কেউ রাস্তায় নিঃসংকোচে হাঁটার কথা বলেছিল, কেউ চেয়েছিল মাঝরাতে অলিগলি ঘুরে দেখতে, কেউ চেয়েছিল একলা একলা সাগর বা পাহাড়ের কাছে যেতে। পুরুষ না-থাকা একটা কাল্পনিক পৃথিবীতেও তারা কেউ ক্ষমতা-টাকা-সম্পদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেনি, তারা কেবল একজন মানুষ হিসেবে পৃথিবীর যে-কোনও কোনায় যে-কোনও সময়ে যেতে পারার অধিকার পেতে চেয়েছিল। যে অধিকার, এ পৃথিবী কেবল পুরুষকেই দিয়েছে এ যাবৎ। সে অধিকারের গল্প বলতে গিয়ে “আ রুম অফ ওয়ান’স ওন” বইয়ে ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন এক যুবকের কথা, যে কখনও মুক্ত জীবন যাপন করছে জিপসিদের সঙ্গে, কখনও উপভোগ করে নিচ্ছে কোনও অভিজাত নারীর সঙ্গকামনা, কখনও ছুটে যাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে– জীবন যা কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে আসছে সেসব কিছু কোনও সংকোচ বা বাধা ছাড়া সে তুলে নিচ্ছে দু’হাত ভরে, আর সেই যাবতীয় অভিজ্ঞতার নির্যাস নিয়ে তৈরি হচ্ছে তার ম্যাগনাম ওপাস, যার নাম ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’। টলস্টয়ের জীবন বা পৃথিবীকে এমন ইচ্ছেমতো ছুঁয়েছেনে দেখা, শেক্সপিয়রের ভাগ্যান্বেষণের অ্যাডভেঞ্চার থেকে তুমুল সাফল্য আর জীবনকে মুঠোয় পুরে ফেলতে পারার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে উলফ কল্পনা করেছিলেন, যদি শেক্সপিয়রের কোনও বোন থাকত আর দাদার মতোই প্রতিভা থাকত তারও, কোনও এক রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে ভাগ্যের খোঁজে বেরলে কী পেত সে? তারপর মেয়েদের কালেক্টিভ সাইকিতে থেকে যাওয়া বিপন্নতার সূত্র ধরেই উলফ বুঝে নিয়েছিলেন, কারও লোভের শিকার হওয়া এবং তারপর আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া– ‘that, more or less, is how the story would run, I think.’।
প্রতিভা থাক বা না-ই থাক, এক পৃথিবীর একশোরকম স্বপ্ন দেখার ইচ্ছেটুকু থাকলেই তবে লেখা হবে মেয়েদের মৃত্যু পরোয়ানা? এক পৃথিবী হাঁটব বলে, নিজের পাড়ায় আর ফিরিনি– এমন দুঃস্বপ্ন দেখার অভ্যেস আমাদের যেন না হয়।