ছয়ের দশকে এই কলকাতায় এসে কীভাবে যেন জুড়ে গিয়েছিলেন এই মালায়লি– আরেকরকম কলকাতার সঙ্গে। সে-কলকাতা শুধু তাঁর বর্তমানের কলকাতা নয়, ইতিহাসের কলকাতা। তিনি হেঁটে বেরিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়, খুঁজে বেরিয়েছেন কাগজ, বই-পত্রিকা, ছবি। যা দিয়ে এই দুম করে ভালোবেসে ফেলা কলকাতাকে আরও চেনা যায়। ভালোবাসলে যে অতীত থেকে ভালোবাসতে হয়, শিকড় থেকে, আরও একবার প্রমাণ করেছিলেন নায়ার।
পরমেশ্বরন থনকাপ্পান নায়ার। জনপ্রিয় ছিলেন ‘পি টি নায়ার’ নামেই। ছয়ের দশকে এই কলকাতায় এসে কীভাবে যেন জুড়ে গিয়েছিলেন এই মালায়লি– আরেকরকম কলকাতার সঙ্গে। সে-কলকাতা শুধু তাঁর বর্তমানের কলকাতা নয়, ইতিহাসের কলকাতা। তিনি হেঁটে বেরিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়, খুঁজে বেরিয়েছেন কাগজ, বই-পত্রিকা, ছবি। যা দিয়ে এই দুম করে ভালোবেসে ফেলা কলকাতাকে আরও চেনা যায়। ভালোবাসলে যে অতীত থেকে ভালোবাসতে হয়, শিকড় থেকে, আরও একবার প্রমাণ করেছিলেন নায়ার। তিনি খুঁজে গিয়েছেন সারাজীবন, সেই কলকাতাকে। কীরকম ছিল কলকাতা শরীর ও মনের আঙ্গিক, তা ছানবিন করেছেন। দেখতে চেয়েছেন পুরনো রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, দোকান, মানুষ– যারা হারিয়ে গিয়েছে, কিংবা এখনও দু’-একটা চিহ্ন দেখে, যা সম্পর্কে একটা আন্দাজ তৈরি হবে।
পি টি নায়ারের কাছেই শুনেছিলাম, তিনি কলকাতায় এসেছিলেন একজন টাইপিস্ট হয়ে। খুচরো কাজ করতেন নানা প্রেসে। পরে অ্যানথ্রোপলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে ছিলেন। সে চাকরিও ছেড়ে দেন একদিন। তারপর? রোজগারহীন একটা লোক, কলকাতার রাস্তার হেঁটে বেড়াচ্ছিল! কীভাবে দিন গিয়েছে তাঁর, আমরা জানি না। কলকাতার হাওয়া-বাতাস হয়তো তাঁকে বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছিল, কখনওই কলকাতাকে খুঁজতে চাওয়ার ইচ্ছে হারিয়ে যায়নি তাঁর। যখন ওঁকে পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, নায়ার বলেছিলেন, ওঁর স্ত্রী ও ছেলেরা কেরলে থাকে। স্ত্রী ইশকুলে পড়ান। ফলে ওঁদের চলে যায় ঠিক।
নায়ারকে বলা হত ‘বেয়ারফুট হিস্টোরিয়ান’। তা অবশ্য আক্ষরিক অর্থে ধরলে খানিক ভ্রান্তি তৈরি হবে। এই ‘বেয়ারফুট’ বুঝতে হলে, ওঁর অনাড়ম্বর জীবনটাকেই বুঝতে হবে। যাতায়াতের জন্য নায়ার ব্যবহার করতেন গণপরিবহণ– কলকাতার বাস-ট্রামই। সারা জীবনে একবারই তিনি ফেলোশিপ পেয়েছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির থেকে– ওই একবারই প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য। ফলে বাকি জীবন তিনি নিজের খরচেই কলকাতার ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন।
পি টি নায়ারের বইগুলো বিচিত্র বিষয়ের। ‘আ হিস্ট্রি অফ ক্যালকাটা স্ট্রিটস’ (১৯৮৭), ‘ম্যারেজ অ্যান্ড ডাউরি ইন ইন্ডিয়া’ (১৯৭৮), ‘অরিজিন অফ দ্য কলকাতা পুলিশ’ (২০০৭)-এর পাশাপাশি ‘দ্য ম্যাঙ্গো ইন ইন্ডিয়ান লাইফ অ্যান্ড কালচার’ (১৯৯৬)– এছাড়াও বহু। যদিও প্রথমবার পি টি নায়ার একজন ‘কলকাত্তাইয়া’ ইতিহাসবিদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন ‘ক্যালকাটা ইন দ্য এইটটিনথ সেঞ্চুরি’ (১৯৮৪) এবং ‘ক্যালকাটা ইন দ্য সেভেনটিনথ সেঞ্চুরি’ (১৯৮৬)– এই দু’টি বইয়ের সূত্র ধরে। এই বই দু’টি স্পষ্ট করে দেয় পি টি নায়ারের আবির্ভাব, জানিয়ে দেয় কলকাতাকে এক মালায়লি ভদ্রলোক কিছু কম জানেন না, বরং অনেক অনেক বাঙালির চেয়ে ঢের বেশিই জানেন।
শুধুই পুরনো রেকর্ড থেকে কলকাতার ইতিহাসের তল্লাশি চালাননি পি টি নায়ার, তিনি সতেরো-আঠারো শতকের ভ্রমণবৃত্তান্ত, ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা, পুরনো বইপত্র যা অনেককাল রিপ্রিন্ট হয়নি– সেসবের ওপর ভরসা করেছিলেন। পরের দিকে উনিশ শতকের কলকাতা নিয়ে কাজটাও অসম্ভব নিষ্ঠা নিয়ে করেন। ফলে এই বইগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে ওঠে কলকাতা জানার জন্য অত্যন্ত জরুরি বই।
পি টি নায়ারের ‘অ্যা হিস্ট্রি অফ ক্যালকাটা স্ট্রিটস’ (১৯৮৭) আসলে রাস্তা ধরে ধরে কলকাতাকে চেনার কৌশল। রাস্তার নাম কীভাবে এল, কবে তৈরি হল এবং নামগুলো বদলাল কী করে। এই যে কলকাতার রাস্তার নামবদল, এইটা খুঁজতে শুরু করলেই একরকমভাবে কলকাতার ইতিহাসকে পাওয়া যায়, বুঝেছিলেন পি টি নায়ার। ‘কলুটোলা’ যেমন সহজ হিসেবে– যে জায়গার কলুরা থাকতেন, সেখান থেকে এই নাম এসেছে। কিন্তু অনেক সময়ই কম জানা, কম পরিচিত মানুষের নামেও রাস্তা হয়েছে। তাঁরা কারা, দেখিয়েছিলেন নায়ার। রাস্তাঘাট নিয়ে কাজ যে এর আগে হয়নি, তা কিন্তু নয়। কিন্তু পি টি নায়ারের রাস্তাটা ছিল মৌলিক, তাঁর মতোই। মজার ব্যাপার, অনেক দিন এই বই খুঁজেও না পেয়ে নায়ারকে গিয়ে আমি যখন জিজ্ঞেস করি, বইখানা তো পাওয়া যাচ্ছে না! তখন তিনি বলেছিলেন, কলকাতার পুলিশ কমিশনার বইটা রিপ্রিন্ট করতে চেয়েছেন। পরে কলকাতা পুলিশের তরফ থেকেই এই বই প্রকাশিত হয়।
কলকাতার যখন ৩০০ বছরের জন্মদিন পালন হচ্ছিল, তখন দুরন্ত একটি বই প্রকাশ করেন নায়ার। ‘ক্যালকাটা: টারসেন্টেনারি বিবলিওগ্রাফি’, প্রকাশক এশিয়াটিক সোসাইটি। সারাজীবন যতরকমভাবে কলকাতাকে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন, তার একটা জমায়েত ঘটিয়েছিলেন এই বইয়ে। ধরা যাক, কেউ কলকাতার ট্রাম নিয়ে কাজ করতে চাইছেন। এই বইতে ট্রামের অংশটি যদি সেই কলকাতা-উৎসাহী দেখেন, দেখা যাবে ট্রাম-সংক্রান্ত ৫০টি প্রবন্ধ সেখানে রয়েছে। উনিশ-বিশ শতকের নানা দুষ্প্রাপ্য সাময়িকপত্র থেকে সেগুলো জোগাড় করা একক দক্ষতা ও পরিশ্রমে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, পি টি নায়ারের শ্রেষ্ঠতম কাজ এটি।
১৯৮৪ সালের আশপাশে এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে পি টি নায়ার এক চমৎকার কাজ করেন। এশিয়াটিক সোসাইটির ২০০ বছর উপলক্ষে এই কাজ। সেজন্যই ফেলোশিপ, যার কথা বলেছি প্রথমেই। এশিয়াটিক সোসাইটির যে প্রসিডিংস, একেবারে পুরনো আমলের, সেগুলো তিনি নতুন করে প্রকাশ করলেন। আঠেরো-উনিশ শতকের সেসব কাগজপত্র, নথি, রেকর্ড– অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ছেপেছিলেন নতুন করে। প্রাতিষ্ঠানিক কাজ হলেও তা অত্যন্ত জরুরি যে কোনও ইতিহাসবিদের কাছেই। নায়ার আমাকে বলেছিলেন, ‘এই কাজ যদি পুনঃপ্রকাশিত না হত, তাহলে সেই ইতিহাস চিরতরে হারিয়ে যেত।’
এসবের পরেও, বিদ্যায়তনিক ইতিহাসচর্চাকারী ও পি টি নায়ারের মধ্যে কিন্তু চিরকালই একটু দূরত্ব থেকে গিয়েছে। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদরাই মনে করেছেন, নায়ার শুধুই তথ্য জোগাড় করেন। কিন্তু ইতিহাস লেখা তো আলাদা একটা শিল্প। তার জন্য জরুরি ইতিহাস ও সমাজবিদ্যার তত্ত্ব। কিন্তু সেসব পি টি নায়ারের ইতিহাস বইতে ছিল না। ফলত, কলকাতা নিয়ে যেসব ইতিহাসবিদরা কাজ করতেন, তাঁরা অনেকেই খুব একটা সম্ভ্রমের চোখে দেখতেন না নায়ারকে। তাঁকে সংগ্রাহকের ভূমিকায় দেখতেন, ইতিহাসবিদের ভূমিকায় না।
এর বাইরেও অবশ্য আরেকটা ব্যাপার ছিল, তা হল যে-সমস্ত বাঙালি কলকাতার ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের যুক্তি ছিল কলকাতা নিয়ে কাজ করলেও পি টি নায়ার কোনও বাংলা সোর্স দেখতেন না। যদিও নায়ার দিব্যি বাংলা বলতে পারতেন! নায়ারকে এ ব্যাপারে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙালিরা বাংলায় ইতিহাসচর্চা করুক, কিন্তু আমার মনে হয় ইংরেজিতে প্রচুর সোর্স রয়ে গিয়েছে যা এখনও অনেকেই দেখেননি, জানেননি। আমি সে কাজটাই করতে চাই।’ কিন্তু কাজের সূত্রে প্রত্যেকেই নায়ারকে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু ইতিহাসবিদ হিসেবে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি অনেকেই।
নায়ারের ইতিহাস লেখার যে পথ, তা ছিল ইংরেজদের গেজেট অনুসারী। তথ্য, টিকা, পরিসংখ্যান, প্রবন্ধ, ছবি– এইসব নিয়ে অত্যন্ত পরিপাটিভাবে একটা ইতিহাস গড়ে তোলা। যার স্টাইলটা একেবারেই দেশি ঘরনার নয়। স্ট্রেনডেল, বেভারলির মতো ইংরেজ সাহেবদের ইতিহাসের মতো, যাঁরা প্রচুর ইংরেজি রেকর্ডস ব্যবহার করেছেন। মনে পড়ছে, সি আর উইলসনও এই পথেই হেঁটেছিলেন– সিরাজদৌল্লাকে নিয়ে বিশ শতকের শুরুতে তাঁর বইগুলো বেরয়। কটন সাহেবের কলকাতার ওপর যে গাইডবুক ‘কলকাতা ওল্ড অ্যান্ড নিউ’, যে বই এখনও জনপ্রিয় কলকাতা চিনতে গেলে, সেই ঘরানারই ছিলেন নায়ার। এক বাঙালি– এ. কে. রায়ের ১৯০১-এর সেনসাস রিপোর্ট। ইংরেজি রেকর্ড দেখে এবং সেই অঞ্চলে গিয়ে অতীতকে পাকড়াও করেছিলেন তিনি। তাঁর বই ‘সেনসাস অফ ক্যালকাটা: টাউন অ্যান্ড সাবারস’। অমল হোম প্রকাশ করতেন ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেট’, তাঁকে খুবই পছন্দ করতেন নায়ার। জন ব্যারি নামক এক ভদ্রলোকের ইতিহাসচর্চার ব্যাপারেও কথা বলতেন নায়ার। ১৯৪০ সালে তিনিও কলকাতার গাইডবুক বের করে। নামে ইংরেজ, কিন্তু এই সাহেব ছিলেন কলকাতারই। তাঁর বই ‘ক্যালকাটা: নাইন্টিন ফরটি’ প্রকাশিত হয়েছিল সেন্ট্রাল প্রেস থেকে, ১৯৪৩ সালে। এই যে ইতিহাস লেখার ঘরানা, তা-ই আয়ত্ত করেছিলেন পি টি নায়ার। এই শহরের অতীত-পথিক।
অনেক ইতিহাসবিদের অভিযোগ: নায়ার স্টেট আর্কাইভে যেতেন না। আমাকে নায়ার বলেছিলেন, ‘আর্কাইভ খুব জরুরি, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের কলকাতার ইতিহাসের যে পত্রপত্রিকাগুলো, সেগুলো দেখাও তো জরুরি। আর্কাইভে সমস্ত কিছু নেই।’ একটা সময় বিদেশ থেকে বেরনো পত্রিকাতেও কলকাতার ওপর অহরহ প্রবন্ধ প্রকাশ পেত। যেমন, ‘লন্ডন ইলাস্ট্রেটেড’। সেসব পত্রিকায় কলকাতার বাড়িঘর, গাড়ি, রাস্তাঘাট, খাওয়াদাওয়া, নানা ক্যাটালগ– এই সমস্ত কিছুই অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে দেখতেন নায়ার। বলতেন, ‘মানুষ ওপর ওপর দেখে। মন দিয়ে দেখে না।’ কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির জার্নাল সেকশনে সারাটা দিন বসে থাকতেন তিনি। সকাল ৯টায় চলে যেতেন। রাত সাড়ে ৭টা, ৮টা পর্যন্ত হাতেই লিখতেন নানা বই-পত্রিকা থেকে। প্রবন্ধ, তথ্য সবকিছুই। তিনি যখন কাজ শুরু করেছেন তখনও ফোটোকপি আসেনি। ফলে আর কোনও উপায়ও ছিল না।
১৯৯০ সালের আশপাশ হবে। কাসারিপাড়ার ৮২/সি-তে থাকতেন নায়ার। গলির মধ্যে একটু হেঁটে ওঁর বাড়ি। দুটো ঘর। গ্রাউন্ড ফ্লোর। ছোট বেঞ্চ, ছোট্ট টেবিল। মেঝেতে বই। আরেকটা ঘর– সেখানে ভাগ্যিস আমি ঢুকতে পেরেছিলাম, কাজের সূত্রেই– তা ছিল সত্যিই এক বইয়ের গুদাম! পত্রিকা, বই, খুচরো কাগজ ডাঁই করে রাখা। কলকাতার নানা পুরনো বইয়ের মার্কেট থেকে নানা সময় জোগাড় করা। কলকাতার আর্বান প্ল্যানিং নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অনেক কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। নায়ার আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার বইপত্র ব্যবহার করতেই পারো, কিন্তু আমি তো সকাল ৯টার মধ্যেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি চলে যাই। আর সন্ধেবেলা আমার এনার্জি থাকে না। তুমি যদি কাজ করতে চাও, তাহলে ভোরবেলায় এসো।’
আমি থাকতাম ন্যাশনাল লাইব্রেরির হোস্টেলে। সেখান থেকে হেঁটে রোজ সকাল ৬টা থেকে ৮টা নায়ারের বাড়ি যেতাম। সন্ধেবেলায় মাঝে মাঝে যে যেতাম না, তা নয়। তিনি তখনও আমাকে সাহায্য করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। সেই কাজে কয়েকটি পত্রপত্রিকার খোঁজ করে নানা সময় বিফল মনোরথ হয়েছি, জেনেছি যে সে পত্রিকা লন্ডনে রয়েছে, আর কোনও উপায় নেই সেখান থেকে আনানো ছাড়া– আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন পি টি নায়ার। কিন্তু মজার ব্যাপার, তা তখন আর হাতের লেখা নোট নেই। নায়ার তো কলকাতায় এসেছিলেন টাইপিস্ট হিসেবে, তিনি তাঁর হাতে লেখা সমস্ত নোট টাইপ করে যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছিলেন নানা ফাইলে। একটা কোনও প্রবন্ধ নয় কিন্তু, বহু বহু প্রবন্ধ।
আমার গবেষণা যখন শেষ করলাম, বই হিসেবে বেরল তা, তখন ওঁর বয়স সত্তরের শেষদিকে। একলাই থাকতেন। একদিন বললেন, ‘এবার অবসর নিয়ে কেরল চলে যাব।’ এ খবরে চারপাশে উদ্বেগ ছড়াল– নায়ারের এই বিপুল সংগ্রহের তাহলে কী হবে! আমি খবর পেয়েছিলাম, বিদেশিরা, যারা সত্যিই সংগ্রহের জন্য প্রচুর টাকা দিতে প্রস্তুত, তারা ওত পেতে বসেছিল। শিকাগো, জাপানের বড় লাইব্রেরিগুলো খোঁজ নিয়েছিল এবং বেশ ভালোরকম টাকা দিতে রাজিও ছিল। দিল্লির প্রফেসর পার্থসারথি গুপ্ত নায়ারের এই খবরটা পেয়েই দিল্লি থেকে একটা চিঠি লেখেন মুখ্যমন্ত্রীকে। তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। চিঠিতে ছিল এই সংগ্রহ বাঁচানোর কথা। এই চিঠির সূত্রেই সরকারের তরফ থেকে পি টি নায়ারের সংগ্রহ ১০ লাখ টাকায় কিনে নেওয়া হয়। ফলে, সংগ্রহটা বেঁচে রইল এই কলকাতাতেই। পি টি নায়ার অবশ্যই জানতেন, বিদেশ থেকে এই সংগ্রহ কিনলে অনেক বেশি টাকা তিনি পেতে পারতেন, শেষ জীবনটা হয়তো অনেক সুখশান্তির হত, কিন্তু তিনি বেজায় খুশি ছিলেন এই ভেবে যে, তাঁর সারাজীবনের কলকাতা সংগ্রহ যে এই কলকাতায় থেকে গেল টাউন হলের লাইব্রেরিতে।
ভালোবাসার জন্য এই আত্মত্যাগ, পি টি নায়ার শেষ জীবন পর্যন্ত বহন করলেন। এক মালায়লি যুবক, কলকাতা যাঁর চিরকালীন প্রেম হয়ে থেকে গেল। সেই প্রেম পি টি নায়ারের মৃত্যুতেও ফুরোল না। কলকাতা থাকল, থাকল পি টি নায়ারের বইগুলো। ইতিহাস কখনও সখনও প্রেমপত্রর চেয়েও প্রখর।