শাফিন আহমেদ লিখেছেন কলকাতায় মায়ের সঙ্গে অনুষ্ঠান করতে আসার কথা। লিখেছেন কলকাতার অ্যান্টনি বাগান লেন ও টালিগঞ্জে তাঁর ছোটবেলার দিনগুলোর কথা। ১৯৬৭ সালে শাফিনরা ঢাকায় চলে যান পাকাপাকিভাবে। তারপর ৭০-এর শুরুর দিকে দেশের উত্তাল সময়ে শাফিন আহমেদকে পাঠানো হয় লন্ডনে মিউজিক নিয়ে পড়ার জন্য। শাফিন দেশে ফিরলেন ১৯৭৮ সাল নাগাদ। আর ১৯৭৯ সালে যোগ দিলেন ব্যান্ড ‘মাইলস’-এ। এর পর বাকিটা ইতিহাস। বাঙালি এর আগে এত প্রাণোচ্ছ্বল আধুনিক ব্যান্ড মিউজিক কোনও দিন শোনেনি। ‘মাইলস’ পথ চলা শুরু করেই বাংলা মিউজিকের ইতিহাসের একদম প্রথমদিকে নিজের জায়গা করে নিল। একে একে আসতে থাকল এমন সব গান যা বাঙালি শ্রোতার জীবনে থেকে যাবে চিরকাল, নীলা, জন্মদিন তোমার, ফিরিয়ে দাও, ধিকি ধিকি আগুন জ্বলে– আরও অনেক অনেক গান।
১৯৯৭-’৯৮ সালের এক শরতের বিকেল। শ্যামবাজারের পার্ক ইন্সটিটিউশনের তিন কিশোর ছাত্র মিলে স্কুল পালিয়ে বিধাননগর রোড স্টেশন থেকে ট্রেন ধরল। গন্তব্য বারাসত। আকাশ নীল, তুলোমেঘ, আর ট্রেনের জানলা দিয়ে আকাশের তাকিয়ে মাঝে মাঝেই গেয়ে উঠছি, ‘নীলা, তুমি কি জানো না…’। সত্যিই নীল আকাশ সেদিনও জানত না, আজও জানতে পারেনি কীসের চাহিদায় তিনটি কিশোর ছেলে স্কুল পালিয়ে বারাসতে গিয়েছিল।
বারাসত স্টেশনে নেমে আগে পাওয়া ইনফরমেশনের ওপর ভিত্তি করে অনেক খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গেলাম সেই ক্যাসেটের দোকানে। দোকানদারকে শুধু একটা নাম বলতেই তিনি এগিয়ে দিলেন একটা পাইরেটেড সাদা রং-এর ক্যাসেট। ক্যাসেটের গায়ে সাদা কাগজে স্কেচপেন দিয়ে লেখা একটা নাম– ‘মাইলস’। ব্যস, আমাদের হাত-পা কেমন যেন করতে শুরু করল। পকেটের টাকা দোকানদারকে দিয়ে কীভাবে যে বাড়ি ফিরে এলাম, মনে নেই। মনে আছে, বাড়ি ফেরার পরে তিন বন্ধু মিলে স্কুলের জামা পরেই সোজা ঘরে ঢুকে ক্যাসেট প্লেয়ারে সেই যে বাজতে শুরু করল, একের পর এক মাইলসের গান, তা কখন থেমে ছিল, বলতে পারব না। হয়তো এখনও থামেনি। এখনও বেজে চলেছে নীলা।
আমাদের ছোটবেলায় গান বলতে ছিল, ‘তুমি যামিনী আমি শশী হে’, কিংবা ‘রানার চলেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’, অথবা ‘বড় আশা করে এসেছি গো, কাছে ডেকে নাও’। বাড়িতে ক্যাসেট ছিল এসবেরই। হিন্দি গান ছিল, তবে আমাদের বামপন্থী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে (পড়ুন, পাড়ায়) হিন্দি গান ছিল অশ্লীল এবং ইংরেজি গান অপসংস্কৃতি। আমরা চিনতাম পল রবসনকে, যদিও তাঁর গান দিয়ে নয়, পার্টির অনুষ্ঠানে চালানো বাংলা গানে জানতাম যে, পল রবসনকে গান গাইতে দেওয়া হয় না, কারণ আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ।
সত্যি কথা বলতে কী, ভালো লাগত না এই প্যানপ্যানে বাংলা গান। ততদিনে বাজারে সুমন এসে গেছেন, নচিকেতা এসে গেছেন, সবাই বলছে, আহা, সুমনের গানের কথা কী আগুন জ্বালানো। কিন্তু সুরে সেই এক প্যানপ্যানে বাংলা গানের ছোঁয়া। এসেছে ‘পরশ পাথর’ ব্যান্ড, কিন্তু সুরে কিংবা মিউজিকে সেই প্যানপ্যানে ধাঁচ, অথবা প্যানপ্যানের চেয়ে সামান্য মডার্ন। ভালো লাগত, তবে মন ভরত না।
এমনই একদিন আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে সে আমাদের অবাক করে দিয়ে একটা গান শোনাল, তার এক মামা ঢাকা থেকে এনে দিয়েছে একটা ক্যাসেট। ক্যাসেটের নাম ‘প্রত্যাশা’, আর ব্যান্ডের নাম ‘মাইলস’। ক্যাসেটটা পুরোটা শোনার পরে কেমন এক মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাড়ি ফিরলাম। সারা রাত বাড়ির বিছানায় শুয়ে থাকলাম, মাথায় বাজতে থাকল, ‘ওই সুদূর নীলিমায়, মন হারিয়ে যেতে চায়’। পরদিন সকাল থেকে একটা জীবনের লক্ষ্য– ‘মাইলস’-এর ক্যাসেট জোগাড় করা। শাফিন আহমেদের কণ্ঠ আমাকে তখন পাগল করে দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
কলকাতায় তখন মিউজিক সিন খুব অন্যরকম (এখনও)। একদিকে, ইংরেজি পার্ক স্ট্রিট আর এলিট জ্যজ ক্লাব, আর একদিকে হেমন্ত, মান্নার মতো দিক্পালরা গত হয়েছেন, তাঁদের ছাত্রছাত্রী কিংবা কণ্ঠীরা গান গাইছে। শিক্ষিত প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা সুমনকে নিয়ে গর্বিত উচ্ছ্বসিত, আর দমদমে নচিকেতা। এছাড়া আর কিছু নেই। আর আমরা যারা সদ্য কিশোর, তাদের কাছে শাফিন আহমেদ ‘মাইলস’-কে নিয়ে এলেন এক নতুন এনার্জি হিসেবে। রক মিউজিক, বেস গিটার সব মিলিয়ে কেমন একটা যেন সাইক্লোন এসে আছড়ে পড়ল আমাদের বুকে। আমরা ভেসে গেলাম, ‘ওই সুদূর নীলিমায়’।
শাফিন আহমেদের ফ্যান হয়ে গেলাম। পাড়ার প্রেসিডেন্সির দাদা সুমনের ইন্টেলেকচুয়াল গান বোঝাতে এলেই সামনে মাইলসের ক্যাসেট তুলে ধরতে হবে। বোঝাতে হবে, শুধু লিরিক দিয়ে গান হয় না, রক মিউজিক তো হয় না একেবারেই। একটা নতুন শব্দ শিখলাম সেই সময়– ‘জোশ’। শাফিন আহমেদের গানে খুঁজে পেলাম সেই শব্দের আসল মানে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই ব্যান্ডের ক্যাসেট জোগাড় করতেই হবে।
কিন্তু সমস্যা হল তখনও কলকাতায় বাংলাদেশের ক্যাসেট পাওয়া যেত না। যাই হোক, বন্ধুর বাড়িতে শোনা একটা নাম শাফিন আহমেদ। তখন ইন্টারনেট নেই, তাই দেখে ফেলতেও পারছি না লোকটাকে কেমন দেখতে, শুধু ভরসা ক্যাসেটের ছবি। অনেক খোঁজখবর করে জানতে পারলাম বারাসাতে একটা ক্যাসেটের দোকানে বাংলাদেশের চোরপথে আসা পাইরেটেড ক্যাসেট বিক্রি হয়, সেখান থেকেই তারপর একে একে বাংলাদেশের মিউজিক ঢুকে পড়ল শ্যামবাজারের বাড়ির অন্দরমহলে। শাফিন আহমেদ এবং মাইলস তাই শুধু আমার কাছে একটা ব্যান্ড নয়, এক খুজে পাওয়া নিষিদ্ধ স্বাদ, যা আমার কানে লেগে থাকবে চিরজীবন। জীবনে বুঝলাম ‘রক মিউজিক’ কাকে বলে। আমার প্রথম শোনা বাঙালি রকস্টার এর নাম শাফিন আহমেদ।
অনেক পরে ইন্টারনেট আসার পরে জানতে পারলাম কী আশ্চর্য, এই লোকটা মাইলস ব্যান্ডের ভোকালিস্ট শাফিন আহমেদের জন্ম কলকাতায়, সময়টা ১৯৬১ সাল। বাবা কমল দাশগুপ্ত বিখ্যাত সুরকার, বাংলা ও প্রাক স্বাধীনতা যুগের অজস্র ছবিতে তার মিউজিক করা, এমনকী, কাজী নজরুল ইসালামের সংস্পর্শে এসে তার গানের সুর করেছেন কমল দাশগুপ্ত ।
অন্যদিকে শাফিন আহমেদের মা হলেন ফিরোজা বেগম। নজরুল গীতি যাঁর কণ্ঠে শোনার জন্য মানুষ সারারাত অপেক্ষা করে থাকতেন কলকাতা-ঢাকা– দু’-জায়গাতেই। বঙ্গভঙ্গ বাঙালি আটকাতে পারেনি কিন্তু ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে নজরুল গীতি যেন সেই ভাঙা বাংলাকে জুড়ে দিয়ে গেছে এক সুতোয়।
…………………………………………………………….
আরও পড়ুন রুদ্রাঞ্জন মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: যাঁর কণ্ঠস্বর বয়ে নিয়ে আসে এক আস্ত মহাফেজখানা
…………………………………………………………….
অনেক পরে শাফিন আহমেদ লিখেছেন কলকাতায় মায়ের সঙ্গে অনুষ্ঠান করতে আসার কথা। লিখেছেন কলকাতার অ্যান্টনি বাগান লেন ও টালিগঞ্জে তাঁর ছোটবেলার দিনগুলোর কথা। ১৯৬৭ সালে শাফিনরা ঢাকায় চলে যান পাকাপাকিভাবে। তারপর ৭০-এর শুরুর দিকে দেশের উত্তাল সময়ে শাফিন আহমেদকে পাঠানো হয় লন্ডনে মিউজিক নিয়ে পড়ার জন্য। শাফিন দেশে ফিরলেন ১৯৭৮ সাল নাগাদ। আর ১৯৭৯ সালে যোগ দিলেন ব্যান্ড ‘মাইলস’-এ। এর পর বাকিটা ইতিহাস। বাঙালি এর আগে এত প্রাণোচ্ছ্বল আধুনিক ব্যান্ড মিউজিক কোনও দিন শোনেনি। ‘মাইলস’ পথ চলা শুরু করেই বাংলা মিউজিকের ইতিহাসের একদম প্রথমদিকে নিজের জায়গা করে নিল। একে একে আসতে থাকল এমন সব গান যা বাঙালি শ্রোতার জীবনে থেকে যাবে চিরকাল, নীলা, জন্মদিন তোমার, ফিরিয়ে দাও, ধিকি ধিকি আগুন জ্বলে– আরও অনেক অনেক গান। প্রায় ৪০ বছর ধরে শাফিন আহমেদ আমিলসের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন। তারপর কিছু মতানৈক্যের কারণে ২০১০ সালে ব্যান্ড থেকে সরে দাঁড়ান, নিজের একটা ব্যাড তৈরি করেন ‘রিদমস অফ লাইফ’ নামে আবার কিছুদিন পরে ভুল বোঝাবুঝি মিটলে আবার যোগ দেন মাইলসে, কিন্তু আবার ঝামেলা বাড়লে মাইলস ছেড়ে দেন ২০১৭ সালে, কখনও একা এখনও মাইলস নিয়েই শো করে গিয়েছেন জীবনের শেষ দিন অবধি।
শাফিন মারা গেলেন ২৪ জুলাই। বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। কানাডায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন সেখানে শরীর খারাপ হওয়ায় তাকে আমেরিকার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজের অনুরাগী শ্রোতাদের উদ্দেশে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন তাড়াতাড়ি মঞ্চে ফিরবেন, কিন্তু আর ফেরা হল না। শাফিন শুয়ে রইলেন ঢাকায় তার বাবা কমল দাশুগুপ্তের কবরে। খারাপ লাগল এটা দেখে যে, আমাদের কলকাতার একটাও সংবাদপত্রগুলি শাফিন আহমেদের মারা যাওয়ার প্রায় কোনও খবরই প্রকাশ করল না সেইভাবে।
আমরা জানি, রকস্টারের মৃত্যু হয় না। শাফিন আহমেদও তাই বেঁচে থাকবেন চিরদিন আমাদের কানে, আমাদের স্মৃতিতে। এমন অনেক মানুষ এই বাংলায় আছেন যারা ‘নিঃস্ব করেছ আমায়’ গানটি জানে কিন্তু শাফিন আহমেদকে চেনে না। এইটা হয়তো একজন শিল্পীর সবথেকে বড় পাওয়া। শিল্পীকে না চিনলেও তাঁর শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে কাঁটাতার পেরিয়ে। ভাল থাকবেন শাফিন ভাই সুদূর নীলিমায়, মন হারিয়ে যেতে চায়, যেথা সময় থেমে রয়, তোমারই আশায়।
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..
দরজার সামনে শম্ভু মিত্র, রেকর্ডিং শেষ করে সবে ফ্লোর থেকে বেরিয়েছেন। গম্ভীর মানুষ, সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে প্রণাম করি, মাথায় হাত রাখলেন। পাশে ছিল চৈতি ঘোষাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাড়ির টিভিতে আমাকে দেখতে পায় তাই এই বিস্ময়, নিচু গলায় জানাল ডাকঘরের অমল।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মনে করতেন– ‘শাহজাদা দারাশুকো হিন্দুস্থানে হিন্দু-মুসলমানের ধর্মচিন্তায় মিলনবিন্দুটি খুঁজতে গিয়ে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে যান। তাই তিনি হিন্দুস্থানের ইতিহাসে একটি কালো গোলাপ। ব্যথা, সৌন্দর্য, কালের ইতিহাসের সঙ্গে এই গোলাপ জড়িয়ে গেছে। হিন্দুস্থান যুগে যুগে তাঁকে বারবার আবিষ্কার করবে।
তুলনাহীন স্পিভাকের অনর্গল যুক্তিবাদী বাগ্মিতা। তাঁর সন্ধান ও প্রকাশের, তাঁর যুক্তির এবং ভাষার কত যে মুহূর্ত জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিতে কী বলব! তখন তিনি তাঁর বিতর্ক উজ্জ্বল, বোধ শাণিত, ভাষায় অব্যর্থ যৌবনে। গোল টেবিলের আর সবাই বিদেশি পুরুষ। একমাত্র নারী তিনি। এবং বাঙালি। হাতে জ্বলছে সিগারেট। সিগারেট মুখে তীব্র আগুনবিন্দু যেন তাঁরই দার্শনিক চেতনা, তাঁরই ধ্যানবিন্দু !