আজ যে এতগুলো কাজ হল– এই যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার চারটি কর্মশালা অনুমোদন করেছে, যার মধ্যে দু’টি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তেমনই বাংলা খেয়ালের দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাক্রমও হয়েছে। বঙ্গ সংগীত সম্মেলনে, বাংলা গান মেলায় আমি বাংলা ভাষায় খেয়াল গেয়েছি। কাজেই হচ্ছে না, হয় না– এই কথাগুলো গা জোয়ারি। বেরসিকের মতো বলা। আমাদের রাজ্যের নবীনরা বাংলায় খেয়াল শিখবেন। তাতে সুবিধে হবে এই যে, তারা বুঝতে পারবেন কী গাইছেন।
কোভিডের ডামাডোল একটু স্থিমিত হয়ে এলে, আমি আবার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে আবেদন করি যে, ওটা তো কোভিডে ভেস্তে গেল, আরেকবার একটা সুযোগ দেওয়া হোক আমাকে বাংলা খেয়াল প্রশিক্ষণ দেওয়ার। তখন রাজ্য সংগীত আকাডেমির সভাপতি ছিলেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়া সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আবার আমাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাক্রম পরিচালনা করার সুযোগ দেয়। দুটো দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাক্রমের আয়োজন করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। এটা কিন্তু হয়ে রয়েছে। আমাদের যে গানমেলা হয়, সেখানে আমি বাংলা খেয়াল পরিবেশন করছি আজ তিন বছর হল। কাজেই বাংলাদেশ সরকার কিছু করার আগে কিন্তু আমাদের পশ্চিমবঙ্গের সরকার বাংলা খেয়ালকে স্বীকৃতি জানিয়েছে– এটা আজ স্বীকৃত। এমনকী, দু’বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে যে ক্লাসিক্যাল মিউজিক কনফারেন্স হয়, তাতেও আমি আবেদন করি যে, ক্লাসিক্যাল মিউজিক কনফারেন্সে এত ভাষায় খেয়াল হতে পারে, বাংলায় কেন হবে না! আমাকে বাংলায় খেয়াল গাওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চলে গেছেন, সেই সময় আমি ‘সন্ধ্যা’ নামে একটি রাগ সৃষ্টি করেছিলাম। আমি বলেছিলাম এই রাগটি আমি গাইতে চাই। আমার সৌভাগ্য যে, শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্মতি দেন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় কাউকে বলে দেন এবং আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়। কাজেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক কনফারেন্সেও বাংলা খেয়াল পরিবেশিত হয়েছে। আমাদের সংগীত মেলায়, গান মেলায় তো হচ্ছেই। এমনকী, আমার তত্ত্বাবধানে, আমার পরিচালনায় নবীন শিক্ষার্থীরা চেয়েছিলেন বাংলায় খেয়াল পরিবেশন করতে, সমবেত কণ্ঠে বাংলা খেয়াল। এটি অনবদ্য কাজ, এটি খুবই নতুন ধরনের কাজ– দু’বার সেটা হয়েছে মাত্র। এবং দু’বারই ১৭-১৮ জন শিক্ষার্থী তাতে অংশ নিয়েছেন। একবার আমার তৈরি করে দেওয়া বন্দিশ, আরেকবার পান্নালাল ঘোষের তৈরি নুপুর ধ্বনির। আগে আরেকবার ভীমপলশ্রী রাগে। তাঁরা বিভিন্ন ভাবে, কখনও সরগম করে, তান করে পরিবেশন করেন। আমরা মহড়া দিয়ে দিয়ে একদম তৈরি ছিলাম। শ্রোতাদের খুবই ভালো লেগেছিল। এটা পরিবেশিত হয়েছিল ওই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত সম্মেলনে। শীতকালে যেটা হয়। কাজেই আমি মনে করি যে, এবং যে কেউ মনে করবেন যে, বাংলা ভাষাতেই তো আমরা গাইব। আমরা তো বাংলা ভাষাতেই খেয়াল গাইব, ঠুংরি গাইব। যেটা বেদনাদায়ক এবং হাস্যকরও বটে, সেটা হল যে একটা কিছু হলেই সকলে বলে ওঠে ওটা তো রাগপ্রধান। কী হিসাবে এটা বলেন? হিন্দিতে রাগপ্রধান হতে পারে না। পস্তুতে হতে পারে না। বাংলায় কিছু হলেই সেটা রাগপ্রধান কেন? বাংলায় খেয়াল হইবে না কেন? আমি স্বামী বিবেকানন্দের কথার প্রতিধ্বনি তুলছি।
আজ যে এতগুলো কাজ হল– এই যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার চারটি কর্মশালা অনুমোদন করেছে, যার মধ্যে দু’টি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তেমনই বাংলা খেয়ালের দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাক্রমও হয়েছে। বঙ্গ সংগীত সম্মেলনে, বাংলা গান মেলায় আমি বাংলা ভাষায় খেয়াল গেয়েছি। কাজেই হচ্ছে না, হয় না– এই কথাগুলো গা-জোয়ারি। বেরসিকের মতো বলা। আমাদের রাজ্যের নবীনরা বাংলায় খেয়াল শিখবেন। তাতে সুবিধে হবে এই যে, তাঁরা বুঝতে পারবেন কী গাইছেন। নয়তো ওই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেটা বলেছিলেন, ‘মোটা মোটা কম্বল গুরুজি আমারে দে’– এই ধরনের কথায় গান গাইতে হবে। সেটা কি ভালো লাগতে পারে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সংগীত চিন্তা’ বইটি আমি সকলকে অন্তত একবার পড়তে বলব। বিশেষ করে যাঁরা গান-বাজনা করছেন, তাঁদের। সে লঘু সংগীত হোক, ক্লাসিক্যাল মিউজিক হোক, মার্গ সংগীত হোক– সবাই যেন পড়েন। ‘সংগীতের উৎপত্তি ও উপযোগিতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘সংগীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সমাজের পরিবর্তনের সহিত, তা পরিবর্তিত হয়। যাহাতে সমাজের উপর তাহার, এবং তাহার উপর সমাজের প্রভাব পড়ে। যাহাতে সমাজের বয়সের সহিত তাহার বয়স বাড়ে।’ এটা খুব জরুরি কথা। বাড়তে কিন্তু শুরু করেছিল নয়ের দশকে। আধুনিক বাংলা গানের ক্ষেত্রে বেশ ভালোমতো হয়েছিল। আজকের বাংলা খেয়াল রচনায় সেই আন্দোলনের অভিমুখ তৈরি হয়েছে।
পড়ুন আপন খেয়ালে-র দ্বিতীয় পর্ব: সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা খেয়াল গাওয়ার বরাত পেয়েছিলেন আকাশবাণী থেকেই
আরেকটি জায়গা বলা খুব দরকার। বছর তিনেক আগে বা তারও একটু আগে, ইন্টারনেটে যে সরকারের শিক্ষা প্রকল্পটি আছে, সেইখানে বিভিন্ন রাগের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। ছোট ছোট চমৎকার সেগুলো, বিভিন্ন রাগের পরিচয়, রাগের রূপ, আরোহণ, অবরোহণ, পকঢ়, কোন কোন স্বর ব্যবহার করা হয়, কোন কোন স্বর অনুমোদিত নয়, বাদি স্বর, সমবাদি স্বর, এবং একটি করে গানের নমুনা– স্থায়ী এবং অন্তরা, সেগুলি হিন্দিতে। সেইখানে ‘ছায়ানট’ রাগটির ভূমিকা দিয়ে গিয়ে কথক বা ঘোষক বলছেন যে, আমরা পণ্ডিত ভাতখণ্ডের যে শিক্ষা কার্যক্রম, সেটাই অনুসরণ করছি। কিন্তু এটা আমাদের মানতেই হবে, যে গানগুলি বা যে গীতগুলি অথবা বন্দিশগুলি আমরা পেয়েছি, পাচ্ছি, সেগুলি কিন্তু খুব পুরনো ধাঁচের। তাঁরা বলছেন– রচনা সমসাময়িক হোনা চাহিয়ে, রচনাগুলোকে সমসাময়িক হতে হবে। এটা কিন্তু হিন্দিতেও স্বীকার করে নিচ্ছেন ওঁরা। তাই যদি হয়, তাহলে আমরা বাংলায় কেন করব না? আপত্তিটা কোথায়? আর আপত্তি করলে আমার মতো লোক সেটা মানবেই বা কেন? আবার বলছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাগুলো– যে অজন্তা ইলোরার ছবি ভালো, তাই বলে কি বাকি জীবন দাগা বুলিয়েই কাটাতে হবে? তেমনই আরেক জায়গায় তিনি বলছেন, আমাদের দেশে যখন বড় প্রতিভা আসবে, সে তানসেনের যুগের কায়দাকানুনের পুনরাবৃত্তি করবে না। সে নতুন করে ভাব ও গম্ভীর সংগীত পরিবেশন করবে। রচনা করবে।
পড়ুন আপন খেয়ালে-র প্রথম পর্ব: খেয়াল-ঠুংরি গাইতে গেলে কৃত্রিম বাংলা ভাষায় কেন গাইব?
কাজেই সবকিছু থেমে গেছে, কিছু চলবে না– এটা মনে করার তো কোনও কারণ নেই। এবং এই কথাটা প্রচার করার মধ্যেও কোনও মাহাত্ম্য নেই। বাংলা ভাষায় খেয়ালটা আলাদা কোনও জিনিস নয়। হিন্দুস্থানি সংগীতই। হিন্দুস্থানি সংগীত যেমন নানান ভাষায় যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে, কি ব্রজবুলি, কি মৈথিলি, কি ঠিট, কি উর্দু, কি পাঞ্জাবি, কি মুলতানি, কি মারাঠি, কি সিন্ধি– এই এতগুলি ভাষায় হয়ে আসছে, তেমনই বাংলাতেও হয়েছে। হচ্ছে এবং হবে। আমার ৭৫ বছর বয়স চলছে, আমি প্রাণপণে আমার কাজ করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, বাংলা ভাষায় খেয়াল রচনা, গাওয়া এবং শেখানো আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বময় কাজ। এবং সবচেয়ে আনন্দময় কাজ। আমার সংগীত জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়টা আমি এখন কাটাচ্ছি। আশা করি, আরও কয়েক বছর বাঁচব। এবং আমার মাতৃভাষায় আরও খেয়াল গান বা খেয়াল বন্দিশ রচনা করে, কাউকে কাউকে শিখিয়ে, তারপর বিদায় নেব। দীর্ঘজীবী হোক বাংলা ভাষায় খেয়াল।
(সমাপ্ত)