‘ডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন’ প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে আমেরিকায়, ফেডারেল গভর্নমেন্ট থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে রাজ্য সরকারগুলোর ওপর, স্কুল-কলেজের ওপর, না-হলে ফেডারেল গ্রান্ট বন্ধের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি সম্পূর্ণ কোণঠাসা, আমেরিকার মাটিতে জন্মগ্রহণ করলেও সবার ‘বার্থরাইট’ থাকবে কি না, জানা নেই। এরপর আমাদের এই বিশেষ ছাত্রছাত্রীদের জন্য ফান্ডিং থাকবে তো? শঙ্কাময়, দমবন্ধ করা দিন এখন আমেরিকায়।
২০২৫ সালের ১৩ মে। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের একটি ছোট শহর হেভারহিল, সেখানকার একটি কমিউনিটি কলেজের একটি সেমিনার রুম। সেখানে স্প্রিং সেমিস্টার শেষে পিৎজা-কেক সহযোগে পালন করা হচ্ছিল একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান। ছাত্রছাত্রীরা একটা করে সার্টিফিকেট পাচ্ছিল সফলভাবে সেমিস্টার শেষ করার জন্য এবং আনন্দের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা একটু শোনাচ্ছিল।
এখন অবশ্যই প্রশ্ন আসতে পারে একটা সেমিস্টার শেষ করার জন্য সার্টিফিকেট কেন দেওয়া হচ্ছে? কারণ হল, এই ছাত্রছাত্রীরা বিশেষভাবে সক্ষম। অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তারা কলেজে একটা কোর্স নিতে পারে এবং সেটা শেষ করতে পারে। তাই এই নির্দিষ্ট কমিউনিটি কলেজটি এই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যেক সেমিস্টার শেষে বিশেষভাবে অভিনন্দন জানায়। এই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ক্লাসে উপস্থিত থাকেন একজন অ্যাকাডেমিক কোচ এবং এই ছাত্রছাত্রীরা যুক্ত থাকে ম্যাসাচুসেটসের কোনও শহরের স্কুল-সিস্টেমের সঙ্গে, সেখানকার ‘হাই স্কুল প্লাস’ প্রোগ্রামে, যেখানে এই বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-জীবন শেষ হওয়ার পর তাদের সাধ্যানুযায়ী কোনও ইন্টার্নশিপ, কিংবা কলেজে নিজেদের পছন্দ ও সাধ্যমতো কোনও কোর্স নেওয়ার ব্যবস্থা এবং নিজেদের রোজকার জীবনযাত্রা চালানোর জন্য যে স্কিল দরকার, সেসবের ট্রেনিং দেওয়া হয়।
তবে আমেরিকায় বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা এবং প্রথাগত শিক্ষার কথা বলতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হয়। আমেরিকার বেশিরভাগ প্রদেশেই শারীরিক বা মানসিক ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীরা পাবলিক স্কুলের শিক্ষার অংশ। এখানে সাধারণভাবে ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজেদের শহরের স্কুলেই যায় প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। বিশেষভাবে সক্ষম বাচ্চাদের প্রতিবন্ধকতা অনুযায়ী, অভিভাবক, ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, স্কুল কর্তৃপক্ষ– সবার অভিমত নিয়ে তৈরি হয় ‘ইন্ডিভিজুয়াল এডুকেশন প্ল্যান’। তাতে থাকে বাচ্চার চ্যালেঞ্জের কথা, সেগুলোর সঙ্গে কীভাবে কাজ করে একটি নিয়মানুবর্তী পজিটিভ রুটিনে ছাত্রছাত্রীদের রেখে, তাদের উন্নতি করা যায়, তা বিবেচনা করা হয়। ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট, রিডিং স্পেশালিস্ট– এরকম আরও নানা ধরনের বিশেষজ্ঞরা স্কুলে কাজ করেন। এদের সকলের সাহায্যে বাচ্চাদের জন্য কিছু লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হয়; অর্থাৎ এই বছর যে বাচ্চা শারীরিক, শিক্ষাগত, মানসিকভাবে এগুলো করতে পারে, সে আগামী শিক্ষাবর্ষে, আরও কী কী জিনিস করতে পারবে।
স্পেশাল এডুকেটরের নেতৃত্বে, প্যারা-এডুকেটর, স্পেশালিস্ট এবং সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই লক্ষ্যে কাজ করেন। প্রত্যেক বছর এই আধিকারিকরা দেখা করেন অভিভাবকদের সঙ্গে। দেখা হয়, কতখানি কাজ হয়েছে লক্ষ্য অনুযায়ী, ছাত্রছাত্রীরা কতটা সাড়া দিচ্ছে। বছরের যে কোনও সময়ে অভিভাবকরা তাদের কোনও শঙ্কা বা অভিযোগ নিয়ে পৌঁছতে পারেন শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে। কাজেই ছাত্রছাত্রী হুইলচেয়ারে থাকুক, কথা বলতে পারুক বা না-পারুক, কোনও সমস্যার জন্য এক জায়গায় বসতে না পারুক– তা সে স্কুলে হোক, কিংবা তার শহরের, তার কমিউনিটির অন্যান্য বাচ্চার সঙ্গে।
………………………………….
আমেরিকার বেশিরভাগ প্রদেশেই শারীরিক বা মানসিক ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীরা পাবলিক স্কুলের শিক্ষার অংশ। এখানে সাধারণভাবে ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজেদের শহরের স্কুলেই যায় প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। বিশেষভাবে সক্ষম বাচ্চাদের প্রতিবন্ধকতা অনুযায়ী, অভিভাবক, ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, স্কুল কর্তৃপক্ষ– সবার অভিমত নিয়ে তৈরি হয় ‘ইন্ডিভিজুয়াল এডুকেশন প্ল্যান’। তাতে থাকে বাচ্চার চ্যালেঞ্জের কথা, সেগুলোর সঙ্গে কীভাবে কাজ করে একটি নিয়মানুবর্তী পজিটিভ রুটিনে ছাত্রছাত্রীদের রেখে, তাদের উন্নতি করা যায়, তা বিবেচনা করা হয়।
………………………………….
শুধু তাই নয়, তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তারা যোগদান করে অন্যান্য সমস্ত বাচ্চাদের সঙ্গে কোনও না কোনও ক্লাসে। হতে পারে সেটা মিউজিক, ফিজিক্যাল এডুকেশন, আর্ট ক্লাস। আবার হাই-ফাংশানিং বাচ্চারা তাদের সাধ্যানুযায়ী যোগ দিতে পারে গণিত, সাহিত্য, বিজ্ঞান যে কোনও ক্লাসে, একজন প্যারা-এডুকেটরের সঙ্গে, তাঁর সাহায্য নিয়ে। সেটার একটা বড় কারণ– এখানকার সাধারণ, মানে নিউরোটিপিকাল বাচ্চারা, বিশেষভাবে সক্ষম বাচ্চাদের তাদের ক্লাসে দেখতে অভ্যস্ত। তারা বেশ সহজ আর স্বাভাবিকভাবেই তাদের গ্রহণ করে। ধরা যাক, কোনও একটি অটিস্টিক বাচ্চা কোনও রুটিনের ব্যাঘাতের বা অন্য কোনও কারণে জোরে চিৎকার করছে বা আওয়াজ করছে, সাধারণ বাচ্চাদের কাছে সেটা কিন্তু তাদের ক্লাসের একটা অংশ। স্কুলের কোনও অনুষ্ঠানে, বাৎসরিক সংগীতানুষ্ঠানে– বিশেষভাবে সক্ষম বাচ্চারা অবশ্যই অনুষ্ঠানের অংশ। এছাড়া একটু বড় হওয়ার পর থেকে চেষ্টা করা হয় ‘বাডি প্রোগ্রাম’ বা সেরকম জাতীয় কোনও প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্বাভাবিক আর বিশেষভাবে সক্ষম বাচ্চাদের মধ্যে পার্টনারশিপ গড়ে তোলা– আর্ট, মিউজিক, খেলার মাধ্যমে।
আমার রাজ্য ম্যাসাচুসেটসের কিছু শহরে হাই স্কুলের পরে, ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সি বিশেষ ছাত্রছাত্রীদের জন্য আছে বিশেষ প্রোগ্রাম, যাতে তাদের জীবনের পরবর্তী অংশে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়– যার কথা লেখার শুরুতে বলেছি। তার অংশ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের অ্যাকাডেমিক কোচ হিসেবে আমি সাহায্য করি তাদের কলেজের ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে। আমাদের এই বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীরা এই কমিউনিটি কলেজের একটা ক্লাস নিয়ে দেখছে, তারা কতটা পারে, তাদের ভালো লাগছে কি না, তাহলে তারা একটু একটু করে এগোতে পারে। কলেজ এডুকেশনে খুঁজে পেতে পারে এমন কোনও ক্ষেত্র, যাতে তারা ভবিষ্যতে কাজ করতে পারে। কেউ কেউ খুঁজে পায়, এগিয়ে যায়, আবার কেউ সফল হয় না। তবে এটা একটা বিশাল চেষ্টা, এত বছর ধরে এই ছাত্রছাত্রীদের পাশে তাদের বাড়ি, স্কুল, কমিউনিটি থেকে একটা পুরো টিম চেষ্টা করছে, তাদেরকে এই পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কলেজের প্রতিটি সেমিস্টারের একটা কোর্স পাসও তাদের জন্য একটা সাফল্য।
কমিউনিটি কলেজের অনুষ্ঠানে বসে তাই যখন শুনছিলাম, একের পর এক এই বিশেষ ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজেদের কথা বলছিল বা বলার চেষ্টা করছিল, তখন আমেরিকার একের পর এক ইউনিভার্সিটিতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রিসার্চ ফান্ডিং। নিজেদের মতাদর্শ, নিজেদের বিশ্বাস প্রকাশ্যে বলার জন্য বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, দেশ থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে। ‘ডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন’ প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, ফেডারেল গভর্নমেন্ট থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে রাজ্য সরকারগুলোর ওপর, স্কুল-কলেজের ওপর, না-হলে ফেডারেল গ্রান্ট বন্ধের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি সম্পূর্ণ কোণঠাসা, আমেরিকার মাটিতে জন্মগ্রহণ করলেও সবার ‘বার্থরাইট’ থাকবে কি না, জানা নেই। এরপর আমাদের এই বিশেষ ছাত্রছাত্রীদের জন্য ফান্ডিং থাকবে তো? শঙ্কাময়, দমবন্ধ করা দিন এখন আমেরিকায়।
সেদিন ওই ছোট্ট অনুষ্ঠানে যখন ‘ট্যুরেট সিন্ড্রোম’ থাকা এক ছাত্র বলছে, সে পড়াশোনার সঙ্গে মোটিভেশনাল স্পিকার হতে চায়; যখন তার ভীষণ কষ্ট করে বলা একেকটা বাক্য আশার ফুলকি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এদিক-ওদিক; কিংবা যখন আর্ট ক্লাস নেওয়া আরেকজন ছাত্র বলছে, ‘ডাউন সিনড্রোম’ তার পরিচয় নয়– তার জীবনের লক্ষ্য, সে শুধু মানুষদের মুখে হাসি ফোটাতে চায়। যখন সামনে দাঁড়িয়ে মনের কথা ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে না-পারা আমাদের ‘বিশেষ’ ছাত্রছাত্রীদের চোখ খুঁজে নিচ্ছে তাদের কোচদের, মুখে তাদের উঁকি দিচ্ছে এক চিলতে আশ্বাসের হাসি, মন বলছে– আলো আছে, আলো থাকবে, যত কম হোক তার তেজ। যতদিন মানুষ আছে, কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের, কোনও সরকারের ক্ষমতা নেই এই আলো নিভিয়ে দেওয়ার।
…………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবপেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………..
যদি দাগই মুছে ফেলো, স্মৃতিও মুছে ফেলা দস্তুর। পারবে পুরাতন প্রেম ছাড়া বেঁচে থাকতে? পারবে সেই আদিম ডাককে অস্বীকার করতে? বারবার জিতে যাওয়াগুলো ভুলে যেতে? সেইসব অপ্রেমের ভেতর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ওই আনন্দ ভুলে যেতে? কাটাগাছে হাত কেটে রক্তাক্ত, তবুও রাতের শেষে সেদিন বাঁকা চাঁদ উঠলে তুমিই তো আলোয় ভরে উঠেছিলে, আরও কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিলে। ফেরার রাস্তা ভুলতে চেয়েছিলে। আধেক আলো আর গোটা জীবন নিয়ে ফিরে এসেছিল সকাল হতে।