সোশাল মিডিয়া ও ওটিটি রেগুলেশনের বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন নিয়ে লোকসভায় আলোচনা হবে শোনা যাচ্ছে। গত ২০২৪ নির্বাচনে বিজেপি যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, তার পিছনে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিডিয়া চ্যানেলগুলির বিপুল ভূমিকা ছিল। তাদের ওপর কীরকম কোপ পড়বে, সহজেই অনুমেয়। অর্থাৎ, রণবীর-সময়কে ঢাল করে, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা বাতিলের দাবিটিকে অস্ত্র করে আদপে দেশের সমস্ত ওটিটি, সোশাল মিডিয়ার ওপরে নজরদারি চালাবে সরকার। যা কিছু তাদের বিচারে ‘অশ্লীল’, তা-ই হবে ‘ক্যানসেল’।
গত কয়েক দিনে এই দেশে অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। নয়া দিল্লি স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে কয়েকজন মারা গেছেন, কয়েকজন আহত। মহাকুম্ভ যাওয়ার জন্য প্রয়াগরাজমুখী ট্রেন ধরতে গিয়েই এই বিপত্তি। এর পাশাপাশি, তামিলনাড়ুর সৈকতে শতাধিক অলিভ রিডলি কাছিমের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। বাংলার দিকে যদি তাকান, এখানেও পরিস্থিতি বড় সুখকর নয়। নিউটাউনে ধর্ষণ করে এক কিশোরীকে খুন করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘আমার লেনিন’-এর প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হল নাকতলায়। অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিল্প-সাংস্কৃতিক, পরিবেশ-প্রকৃতি যেদিকেই তাকাই, ভারতে সমস্যার শেষ নেই। ক্রমবর্ধমান সংকটের কমতি নেই। অথচ, আমাদের দেখে মনে হবে, একমাত্র রণবীর আলাহবাদিয়া এবং সময় রায়না নামের দুটো লোককে কোনও মতে নিষিদ্ধ করতে পারলেই দেশ-দুনিয়ার যাবতীয় বিপত্তি ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাবে। কাল থেকে দরকচা মারা আম জিন্দেগি থেকে হুড়ুমতাল লাফ মেরে সমাজ পৌঁছে যাবে ঝাঁ-চকচকে মেন্টোস জিন্দেগিতে। কিন্তু, আচমকা এই ‘ক্যানসেল’ ‘ক্যানসেল’ রব কেন?
বিশদে এই আলোচনায় ঢোকার আগে কয়েকটা পরিভাষার দিকে আমাদের তাকানো দরকার।
বাকস্বাধীনতা: দেশের সংবিধান-প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলির একটি, যাতে একটা লোক তার মনের ভেতর যা চলছে, তা নির্ভাবনায় ভাষায় প্রকাশ করতে পারে। ভারতীয় নাগরিকের এই অধিকারখানা আছে।
সংযম: প্রকৃতি-প্রদত্ত মৌলিক প্রবৃত্তিগুলির একটি, যাতে একটা লোক শেখে, মনের ভেতর যা চলছে, স্থান-কাল-পাত্র না বুঝে তা প্রকাশ করা শোভন নয়। বাচ্চা, ক্ষুধার্ত ছাগল আর গাছগাম্বাট মাথামোটা ছাড়া বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এটা থাকার কথা।
ডার্ক জোক: সাধারণত, যা নিয়ে হাসিমজা চলে না, তা নিয়ে একটু ঘোরালো ঠাট্টা– ঠিকমতো সামলাতে না পারলে অসংবেদনশীল হওয়ার সম্ভাবনা আছে পুরোমাত্রায়।
ক্যানসেল কালচার: কোনও ব্যক্তির নির্দিষ্ট কোনও আচরণ পছন্দ না হলে তার ধোপা-নাপিত বন্ধ করার আর্জি জানানো। এ-জিনিস নর্ম হয়ে গেলে পৃথিবীর তাবৎ জনসংখ্যাকে মৌনব্রত অবলম্বন করতে হবে। নচেৎ পথ নেই।
এটুকু মোটামুটি ঝালিয়ে নিয়ে আমরা এবার মূল প্রসঙ্গে এগোই। গোড়াতেই একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিই। রণবীর আলাহবাদিয়ার জোকটি কি আমি সমর্থন করি? সহজ উত্তর, না। কারণ, যে কোনও জোককে– তা সে অফেন্সিভ, ডিফেন্সিভ, এক্সপেন্সিভ যা খুশি হোক– আগে ‘হাস্যকর’ হয়ে উঠতে হয়। না-হলে তা মন্তব্যমাত্র; সরস মন্তব্য নয়। আলাহবাদিয়া তাঁর নিজস্ব পেছনপাকামির বশেই হাউজের সামনে কুল হতে গিয়ে যে মন্তব্যটি করেছেন, তার মধ্যে বিন্দুমাত্র হাসিমজার উপাদান নেই। অতএব, তাঁর বয়ানটিকে ‘জোক’ হিসেবে বিচার করতে পারছি না।
এবার এর উল্টোদিকটি দেখি। শ্লীল-অশ্লীলের গণ্ডি টেনে এই যে পবিত্র-অপবিত্র নির্ধারণ করে দেওয়া– এর মধ্যে আদপে কতখানি সুস্থ চেতনা লুকিয়ে আছে? ধরা যাক, সোশাল মিডিয়ায় ভেসে ওঠা কোনও একটি কনটেন্ট আমার ভালো লাগল না। আমি কী করতে পারি? এড়িয়ে যেতে পারি। যদি মনে হয়, এড়িয়ে যাওয়া সমীচীন নয়, এই কনটেন্ট ওয়েব-দুনিয়ায় থাকলে তা সমাজে কু-প্রভাব ফেলবে; তাহলে আমি সংশ্লিষ্ট সোশাল মিডিয়ায় সেই কনটেন্টটির বিরুদ্ধে একটি নালিশ ঠুকতে পারি। যদি মনে হয়, আমার একার নালিশে কিছু হবে না, তাহলে আমি সমমনস্কদের নিয়ে একটি জোট তৈরি করে গণ-অভিযোগ করতে পারি। এবং, যদি প্রয়োজন মনে হয়, ভবিষ্যতে এই লোকটির কথা আমার না-শুনলেও চলবে, তাহলে আমি তাঁকে এড়িয়ে চলতে পারি। কিন্তু, আমি যদি নিদান দিই এই লোকটা আর কোনও দিন কথাই বলবে না, এর কথা কেউ শুনলে সে অধম, একে রাস্তায় দেখলেই জুতোর মালা পরানো উচিত– তাহলে তা দিন শেষে কতখানি সুস্থ এবং স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া?
আচ্ছা, তর্কের খাতিরে ধরা যাক, কেউ বেফাঁস কিছু বলে ফেললেই তাকে একঘরে করা হবে। এটাই সমাজের দস্তুর। ভালো। এবার ‘বেফাঁস কিছু’-টা খতিয়ে দেখা যাক। কমেডি হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যা সাধারণত্বের বিচ্যুতিকে অবলম্বন করেই গড়ে ওঠে। যা হচ্ছিল, যা স্বাভাবিক; তা ঘটে চললে আর আপনার হাসি পাবে কেন! একটা লোক সকালে বাজারের থলি হাতে গেল, চাট্টি শিঙি মাছ কিনল, বাড়ি ফিরে শিঙিমাছের ঝোল আর ভাত খেয়ে পাখা চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আপনার হাসি পেল? পাবে না। স্বাভাবিক। এবার ধরুন, শিঙি মাছ কিনে ফেরার পথে কলার খোসায় পা হড়কে লোকটা সোজা হাইড্রেনে গুয়ের তালে গিয়ে পড়ল। এই দৃশ্যটা কল্পনা করে আপনার হাসি পেতে পারে। হয়তো যারা চোখের সামনে দেখবে, তারাও খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসবেই। কিন্তু যে লোকটা পড়ল, সে তো কাঁকালে ব্যথা নিয়ে দিন সাতেক বিছানায় শুয়ে রইল। তার কাছে এই হাসিটাই চরম অসংবেদনশীল। কমেডির একটা আধার প্রয়োজন হয়। পাত্র। সুভাষিণী যদি কথা বলতে পারত, তাহলে বাক্যটা আর ডার্ক থাকত না। ‘মেয়েটির নাম যখন সুভাষিণী রাখা হইয়াছিল তখন কে জানিত সে বোবা হইবে।’ এই মূক হওয়াতেই দুম করে পরিহাসটা হিট করে। না হলে করত না।
এবার ধরুন, হাস্যরসের উৎসমুখে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরও আপনার চাইতে নাগরিকত্ব কিছু কম নয়। তারা ভোট দেয়, প্যানকার্ড মানিব্যাগে রাখে, চাইলেই কাগজপত্র দেখিয়ে এ-দেশে বসবাসের ছাড়পত্র আদায় করে ফেলবে। অতএব, তাদেরও পূর্ণ অধিকার আছে আপনাকে একঘরে করার। যে লোকটা বাজারে আছাড় খেল, সাতদিন বিছানায় শুয়ে থেকে অষ্টম দিন উঠে এসে বাজারের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল। পুলিশ এসে বলল, আইনমাফিক আর কেউ কোনও দিন বাজারে আসতে পারবেন না। ন্যায্য। আপনি ভাবলেন, আচ্ছা বাজারে না হয় যাব না, ব্লিংকিটে সব আনিয়ে নেব। বাড়ি বসে সোশাল মিডিয়া স্ক্রোল করতে করতে আনমনে বলে ফেললেন, দেশটা কোথায় যে যাচ্ছে! সরকার এক্কেবারে অপদার্থ! জানালার পাশে গলিতে একটা পুলিশের গাড়ি যাচ্ছিল, তারা শুনেই আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে বলল, ব্যাটা রাষ্ট্রদ্রোহী, এবার জেলের ভাত খাবে চলো। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা! এরকম চলতে থাকলে আমাদের জাতীয় বাসস্থান হবে জেলখানা আর জাতীয় পোশাক হবে কয়েদির ইউনিফর্ম।
একজন পাবলিক ফিগারের বিস্তর দায়িত্ব থাকে। ঠিক। উদিত নারায়ণ যেমন কোনও মতেই অনুরাগিণীকে চুমু খেয়ে উচিত কাজ করেননি। রণবীর আলাহবাদিয়াও একটা বোকা বোকা কথা বলেছে। কিন্তু ব্যক্তিকে বাতিল করলে কাজের কাজ প্রায় কিছুই হয় না। কোন সংস্কৃতি শেখায় যে, পুরুষ একাধিক রমণীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হলে তবেই সে সুপারস্টার? সেই সংস্কৃতিটিকে ধীরে ধীরে মুছে ফেলা জরুরি। কোন ধরনের আবহে রণবীর আলাহবাদিয়ার মতো একটা অপদার্থ পডকাস্টার-ইউটিউবার দেশের এই মানুষের ওয়াচলিস্টে থাকে দীর্ঘদিন? সেই আবহের একটা প্রতি-সংস্কৃতি দরকার। সেই কাজগুলো না-করে শুধুই ব্যক্তি বা গোত্রকে ব্ল্যাকলিস্ট করে কিছু হয় না। এই দেশে যারা ক্ষমতায় আছে, তাদের নেতা-নেত্রীদের ঘৃণাভাষণ নিয়ে বই লেখা যায়। ধর্মীয়, লৈঙ্গিক পরিচয়ে যারা সংখ্যালঘু, তাদের বাছা-বাছা বিশেষণে ভূষিত করা এ-দেশের নেতা-নেত্রীদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। তাদের বছরের পর বছর ভোটে জিতিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এতটা সোচ্চার হওয়া দ্বিচারিতা নয় কি? রণবীর আলাহবাদিয়া এবং সময় রায়নার বিতর্ক পালে হাওয়া পাওয়ার পরে দুটো ঘটনা ঘটেছে, যার সঙ্গে এর যোগসাজশ আছে বলে আমার মতো কয়েকটা পশ্চাদপক্ব লোক সন্দেহ করে।
“ইন্ডিয়া’জ গট লেটেন্ট”-এর সব পর্ব ইউটিউব থেকে উঠে যাওয়ার পর জিও এবং হটস্টার মার্জ করে গেছে। জিওহটস্টার নতুন আটটা কমেডি শো আনছে, যা হোস্ট করছেন নতুন প্রজন্মের কমিকরা। তাতে রাহুল দুয়ার মতো হেভিওয়েটও রয়েছেন। জিও কার কোম্পানি, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁর কেমন সম্পর্ক– এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। দ্বিতীয়ত, সোশাল মিডিয়া ও ওটিটি রেগুলেশনের বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন নিয়ে লোকসভায় আলোচনা হবে শোনা যাচ্ছে। গত ২০২৪ নির্বাচনে বিজেপি যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, তার পিছনে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিডিয়া চ্যানেলগুলির বিপুল ভূমিকা ছিল। তাদের ওপর কীরকম কোপ পড়বে, সহজেই অনুমেয়। অর্থাৎ, রণবীর-সময়কে ঢাল করে, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা বাতিলের দাবিটিকে অস্ত্র করে আদপে দেশের সমস্ত ওটিটি, সোশাল মিডিয়ার ওপরে নজরদারি চালাবে সরকার। যা কিছু তাদের বিচারে ‘অশ্লীল’, তা-ই হবে ‘ক্যানসেল’।
এই পদক্ষেপকে কি গণতান্ত্রিক বলা চলে? যদি তা মনে না-হয়, তাহলে আমরা একই আচরণ করে ব্যক্তিগত পরিসরে কতটা গণতান্ত্রিক থাকছি, সেটা একটু ভেবে দেখা যায়? যদি লেখার প্রথমে উল্লিখিত সমস্ত সমস্যার থেকেও এই দুই ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ করা আমাদের প্রধানতম মাথাব্যথা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আদপে এরকম নৈরাজ্যই ডিজার্ভ করি কি না, তা ভেবে দেখা যায়?
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………