৩০ বছর আগে লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু-বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নেন, পদার্থের মধ্যে দিয়ে লেজার আলো পাঠানো হলে কী কী নতুন ঘটনা ঘটতে পারে, এ নিয়ে তাঁরা আরও গভীরে তলিয়ে দেখবেন। গবেষণার জন্য ফান্ড জোগাড় হয়, স্থাপন করা হয় অত্যাধুনিক লেজারযন্ত্র। ততদিনে ফ্রান্সে লেজার সংক্রান্ত গবেষণায় যথেষ্ট নাম করে ফেলেছেন তরুণী অ্যান, এবং তাঁকে পাওয়া গেলে যে ডিপার্টমেন্ট সমৃদ্ধ হবে, সেটা বুঝতে দেরি হয়নি লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের। অ্যানকে সুইডেনে আমন্ত্রণ জানান তাঁরা, অ্যানও জড়িয়ে পড়েন সেখানকার বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে।
অ্যান লুইলিয়ের (Anne L’Huillier) এ বছরের পদার্থবিদ্যার নোবেলজয়ী ত্রয়ীর একজন। পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পাওয়া পঞ্চম মহিলা বিজ্ঞানী তিনি। অ্যাটোসেকেন্ড পালস লেজার, যা কাজ করে সেকেন্ডের অতি অতি ক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশে (১-এর পর আঠেরোটা শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয়, ১ সেকেন্ডের তত ভাগের এক ভাগ হল ১ অ্যাটোসেকেন্ড) , তার জন্য আরও দু’জন বিজ্ঞানীর সঙ্গে এই পুরস্কারে সম্মানিত হচ্ছেন অ্যান। তা, এত ছোট সময়-টুকরো কেন প্রয়োজন বিজ্ঞানীদের? প্রয়োজন এই জন্য, পদার্থের পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের গতিবিধি বুঝতে চান ওঁরা। ইলেকট্রনরা অতি ক্ষুদ্র কণিকা, তারা বহু কাণ্ডকারখানা ঘটিয়েও ফেলছে অতি অল্প সময়ের ওই ফ্রেমে। আর তা হাতেনাতে ধরার জন্য ওই স্বল্পায়ু লেজার পালসের গুরুত্ব বিশাল।
যেখানে তিনি অধ্যাপনা করেন, সেই লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে আরেকটি কথা। নোবেল পুরস্কারের খবর জানানোর জন্য নোবেল কমিটি অ্যানকে যখন ফোন করে, তিনি ফোন তোলেননি– কারণ তিনি তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন। ক্লাস চলাকালীন একবার একটা ব্রেক হয়, তখন অ্যান খবরটা পান, এবং তারপরেও নির্বিকার চিত্তে ক্লাসে ফেরত যান, পড়ান আরও আধঘণ্টা। ক্লাসে বসে থাকা ছাত্রছাত্রীরা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে, এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে মাঝখানে!
সারা পৃথিবীর মিডিয়াতেই বেশ হইচই হচ্ছে এই নিয়ে। শিক্ষক হিসেবে অ্যানের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা চলছে।
সত্যি, নিজের পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা হয়তো একেই বলে! যিনি শিক্ষক, পড়ানোই তাঁর সাধনা। কোনও কিছুই সেই সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না, এমনকী নোবেল কমিটির ফোনকল-ও নয়। সেই যে জেন বৌদ্ধধর্মে একটা প্রবাদ আছে না? ‘বোধিলাভের আগে কাঠ কাটো, জল বয়ে নিয়ে যাও। বোধিলাভের পরেও কাঠ কাটো, জল বয়ে নিয়ে যাও’? এ যেন তার সার্থক উদাহরণ। যে-কাজ করার, তা করে যেতেই হবে– জীবনের সর্বোত্তম অর্জনটিও সেই কাজের গতিতে ছেদ টানতে পারবে না।
আর আমরা? আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার প্রেক্ষিতে অ্যান লুইলিয়েরকে আমরা কীভাবে দেখব?
একজন মানুষ শিক্ষক হিসেবে কতটা সফল হবেন, তার পিছনে সম্ভবত তিনটি মুখ্য বিষয় কাজ করে–
১. তাঁর ব্যক্তিগত চেষ্টা, স্বকীয় শিক্ষণপ্রণালী ২. যেখানে পড়াচ্ছেন সেই প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, পরিকাঠামো, এবং ৩. দেশের বা রাজ্যের সামগ্রিক শিক্ষানীতি, অনুসৃত পঠনপাঠনপদ্ধতি।
ব্যক্তি-প্রসঙ্গে আসি প্রথমে। এ দেশের, বা এ রাজ্যের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দিকে যদি তাকাই, নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রদরদি প্রকৃত শিক্ষক কম নেই আমাদেরও। প্রবাদপ্রতিম অনেক অধ্যাপক ছিলেন, এখনও আছেন কেউ কেউ। অনেকরকম প্রতিকূলতার মধ্যে তাঁরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রদীপটুকু জ্বালিয়ে রাখার। কিন্তু এরই উল্টোদিকে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, নিজের স্কুলে বা কলেজে ঠিকমতো না পড়িয়ে বাড়িতে প্রাইভেট টিউশনের আসর জমিয়ে ফেলা শিক্ষকদের নিয়ে অভিযোগও তো উঠে আসে, নিয়তই। কলেজে প্র্যাক্টিকাল হচ্ছে না ঠিকমতো, ছাত্রছাত্রীরা ল্যাব করার জন্য নাম লেখাচ্ছে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে, এমনও তো দেখা যায় চারপাশে। যাঁরা এই অবস্থার জন্য দায়ী, অ্যানের দৃষ্টান্ত এঁদের মনে কোথাও দাগ কাটবে কি? কর্মসংস্কৃতির পাঠ শেখাতে পারবে? সম্ভবত না।
ব্যক্তি ছেড়ে প্রতিষ্ঠানের কথায় আসা যাক। বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার যদি উন্নতিসাধন করতে হয়, তাহলে সম্পূর্ণ সিস্টেমটাকেই হতে হয় স্বচ্ছ, দায়িত্ববান। অ্যান লুইলিয়েরের নোবেল প্রাপ্তির পর ওই একই বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক সুন স্বানবের্গ (Sune Svanberg) স্মৃতিচারণ করেছেন– ৩০ বছর আগে লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু-বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নেন, পদার্থের মধ্যে দিয়ে লেজার আলো পাঠানো হলে কী কী নতুন ঘটনা ঘটতে পারে, এ নিয়ে তাঁরা আরও গভীরে তলিয়ে দেখবেন। গবেষণার জন্য ফান্ড জোগাড় হয়, স্থাপন করা হয় অত্যাধুনিক লেজারযন্ত্র। ততদিনে ফ্রান্সে লেজার সংক্রান্ত গবেষণায় যথেষ্ট নাম করে ফেলেছেন তরুণী অ্যান, এবং তাঁকে পাওয়া গেলে যে ডিপার্টমেন্ট সমৃদ্ধ হবে, সেটা বুঝতে দেরি হয়নি লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের। অ্যানকে সুইডেনে আমন্ত্রণ জানান তাঁরা, অ্যানও জড়িয়ে পড়েন সেখানকার বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে। যোগ্য মানুষকে যোগ্য সমাদর দিলে, তাঁর উপযুক্ত কাজের পরিবেশ তাঁকে দিতে পারলে সংশ্লিষ্ট সকলেই যে উপকৃত হন, এটা তারও উদাহরণ বটে। এর বিপরীতে, আমাদের দেশে যেখানে শিক্ষা সংক্রান্ত অজস্র ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে যায়, শিক্ষক-নিয়োগে অবাধ দুর্নীতি চলে, সেখানে শিক্ষার উৎকর্ষ কতটুকুই বা আশা করা সমীচীন!
শিক্ষক ও তাঁর নিজস্ব পরিমণ্ডল ছাপিয়েও আরেকটা কথা থেকে যায়– তা আমাদের সার্বিক শিক্ষানীতি ও গবেষণানীতি সংক্রান্ত। এদেশে যে-কোনও বড়মাপের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আর্থিক ফান্ড জোগাড় করাটা একটা বিরাট ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে গবেষণায় সরকারি ও বেসরকারি দু’-ধরনের বিনিয়োগই আসে। একেবারে মৌলিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলি, যাদের প্রায়োগিক দিক শুরুতেই তত স্পষ্ট নয়, তারাও কিন্তু সেই অনুদান পায়। অ্যানের গবেষণাও তার ব্যতিক্রম নয়। সব গবেষণার তাৎক্ষণিক হাতে-গরম প্রযুক্তিগত প্রয়োগ থাকে না; কিন্তু যে কোনও প্রকৃত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানই মানবসভ্যতাকে এক কদম দু’কদম করে এগিয়ে দেয়– আমাদের দেশের নীতিনিয়ামক ও ফান্ডিং এজেন্সিরাও সেকথা মনে রাখলে আমাদেরই কল্যাণ।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা মনে করে নেওয়া যাক। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণা আর অধ্যাপনাকে অনেকাংশে পৃথক করে নেওয়া হয়েছে। খানিকটা যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শুধু পাঠদান প্রক্রিয়া চলবে, উন্নত গবেষণা-পরিকাঠামো সেখানে তেমন জরুরি নয়। উল্টোদিকে, রিসার্চ ইনস্টিটিউটগুলোর মূল লক্ষ্য হিসেবে রাখা হয়েছে গবেষণাকে, ক্লাস-শিক্ষকতা সেখানে যেন তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ, গবেষণা আর অধ্যাপনা যে বিচ্ছিন্ন দু’টি বিষয় নয়, একটি আরেকটির পরিপূরক মাত্র– অ্যান লুইলিয়েরের নোবেল প্রাপ্তি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো যুগান্তকারী গবেষণা করেছেন অ্যান, শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্বপালনে ফাঁক রাখেননি কোথাও।
অ্যান লুইলিয়েরের নোবেল-প্রাপ্তি ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনেকগুলো জরুরি দিকে আলো ফেলেছে। সেই আলোতে কতটা আত্মানুসন্ধান করতে পারবেন আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকরা, তার ওপরেই নির্ভর করছে আমাদের বিজ্ঞানচর্চার ভবিষ্যৎ।