নেতাইয়ের হাততালিতে রকি থ্রি-র গানের আগল খুলে গেল। বহুদিন পর তৃষ্ণার অবিবাহিত মুখ ভেসে উঠল। গেয়ে উঠল, ‘তৃষ্ণা ওগো তৃষ্ণা’। সুর এদিক-ওদিক, কবিতার মতো। তাতে কী! আবেগ তো জেনুইন। নিত্যানন্দবাবুর মনে হল, রবীন্দ্রনাথ কি নিজেকে নিয়ে কম করেছেন! দাড়ি-বিহীন আত্মপ্রতিকৃতি! তাছাড়া ‘শেষের কবিতা’য় নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা। সইবে, সবই তাঁর সইবে।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
নিত্যানন্দবাবু স্থির করলেন রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে রকিগণের কী ভাবনা, তা জানবেন। যদিও বৈশাখ মাস নয়, কালী ঠাকুর জলে পড়েছে, ছটের ঠেকুয়ার স্বাদ সবে মুখে মিলিয়েছে। তাতে আর কী আসে যায়! যখনই জেগেছে চিত্ত তখনই হয়েছে প্রভাত। যখনই জেগেছে চিত্ত তখনই এসেছে বৈশাখ, রবি ঠাকুরের জন্মমাস। ক্যালেন্ডারের পাতায় নভেম্বর মাস, তবে কোথায় শীত! নিত্যানন্দবাবু একটি ফুরফুরে হাওয়াই শার্ট পরে রকের দিকে এগোলেন।
এখনও ভালো করে সন্ধে নামেনি, তবে চপের দোকানটি বসেছে। ছ’টা করে আলুর চপ আর পেঁয়াজি অর্ডার দিয়ে তিনি যখন রকে পৌঁছলেন তখন পাঁচমূর্তির মধ্যে তিনজন এসেছে, বাকি দু’জন অ্যাবসেন্ট। আসছে। রকি থ্রি তাঁকে দেখেই বলে উঠল, ‘নেতাই সোনা/ চাঁদের কণা/ ভুবনে তুলনা নাই।’ এমন কাব্যিক সম্ভাষণ তিনি আশা করেননি। তবে এ সম্ভাষণের কারণ আছে। তিন রকি দেখেছে নেতাই চপের দোকানের সামনে একবার গ্যারেজ হল। অর্থাৎ চপ আসছে আসবে, সে জন্যই এমন কাব্যিক সম্বোধন। যদিও বাকিরা এখনও আসেনি তবু কাব্যগুণের সুযোগে নিত্যানন্দবাবু রবি ঠাকুরে ঢুকে পড়লেন। ‘কবিতাই যখন উচ্চারিলে তখন বলো দেখি সেরা বাঙালি কবি কে?’
রকি নম্বর ওয়ান: উচ্চারিলে আবার কী নেতাই? স্মার্ট বাংলা বলতে পারো না! বলবে, কবিতাই যখন মারালে।
নিত্যানন্দবাবু একটু হোঁচট খেলেন, তবে মনে মনে। তাঁর শরীরী বিভঙ্গে অর্থাৎ, বডি ল্যাঙ্গোয়েজে কিছু প্রকাশ পেল না। রকি নম্বর থ্রি বলল, ‘রবি ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সেরা বাঙালি কবি।’ বলেই ফিক করে হাসল। তারপর আবার শুরু করল, ‘‘আমাদের ইস্কুলে ক্লাস নাইনের এক দাদা লজিক পড়ে বলেছিল, ‘রামছাগলের দাড়ি আছে। রবীন্দ্রনাথেরও দাড়ি আছে। সুতরাং …’ আমি সেই দাদাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কানের গোড়ায় দিলাম একটা… রবি ঠাকুরকে নিয়ে ইয়ার্কি? কী কবিতা! কী গান! ‘তৃষ্ণা ওগো তৃষ্ণা।’ আমাদের পাড়ায় কৃষ্ণার বোনের নাম ছিল তৃষ্ণা। আমি তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে গানটা গাইতাম। কী যে দেখতে ছিল।”
নিত্যানন্দবাবু খেয়াল করলেন রকি থ্রির চোখ কেমন ছলছলে হয়ে উঠল। কিন্তু সেই ছলছলে মুহূর্তেই অ্যাবসেন্ট রকিদ্বয় প্রবেশ করল, তারা পূর্বকথা জানত না। সুতরাং, এসেই জোড়া গলায় বলে উঠল, “চপ আসেনি তো! নাকি আসা মাত্রই তোরা সব কটা সালটে দিয়েছিস! কী নেতাই?”
নিত্যানন্দবাবু দেখলেন একটু শাসন করা দরকার। শাসন না করলে প্রশাসন চলে না। যদিও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমরা সবাই রাজা’। তবে রাজা হতে গেলে আত্মশাসনের অনুশীলন জরুরি। এই রকিবৃন্দ আত্মশাসনহারা। এ-সমস্ত ভাবনা অপ্রকাশ্য রেখে নেতাই হয়ে নিত্যানন্দ ফুকরে উঠলেন, ‘কেউ সালটে দেয়নি। চপ কামিং। তার আগে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কৌন বনেগা ডিমের ডেভিলপতি খেলনা হোগা।’
রকি টু: ‘সে আবার কী খেলা?’
নেতাই: ‘‘তোমরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দু’-তিনটে করে বাক্য বলবে। যার বলা ভালো হবে সে আজকের বরাদ্দ চপের বাইরে দুটো ডিমের ডেভিল পাবে।”
………………………………………………………..
নিত্যানন্দবাবু দেখলেন একটু শাসন করা দরকার। শাসন না করলে প্রশাসন চলে না। যদিও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমরা সবাই রাজা’। তবে রাজা হতে গেলে আত্মশাসনের অনুশীলন জরুরি। এই রকিবৃন্দ আত্মশাসনহারা। এ-সমস্ত ভাবনা অপ্রকাশ্য রেখে নেতাই হয়ে নিত্যানন্দ ফুকরে উঠলেন, ‘কেউ সালটে দেয়নি। চপ কামিং। তার আগে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কৌন বনেগা ডিমের ডেভিলপতি খেলনা হোগা।’
………………………………………………………..
রকি ওয়ান কাউকে সুযোগ না দিয়েই বলল, ‘রবীন্দ্রনাথ খুব বড়ো ব্যবসাদার ছিলেন। কালি কলম আর কাগজের কী বা দাম! সেই কালি-কলম-কাগজ খরচ করে কত টাকা কামালেন! হেব্বি চালু!’
রকি থ্রি একটু রেগে গেল। ‘তুই চেষ্টা করে দেখ না। কালিও কিনতে হবে না। ডটপেন আর কাগজ– এটুকুই তো ইনভেস্টমেন্ট। তাও সে টাকা নেতাই দেবে। তুই লেখ আর কামা। কাল থেকেই শুরু কর।’
নিত্যানন্দবাবু শক্ত হাতে বিষয়টি দমন করলেন। ‘এখন কেউ অন্যের বলা নিয়ে মন্তব্য করবে না। আমি পরপর সকলের কথা শুনতে চাই।’
রকি টু: ‘ইয়েস স্যর। আমি বলব। রবীন্দ্রনাথ প্রেমের কবিতা খুব ভালো লিখতেন। তাঁর বউদির সঙ্গে একটু ইয়ে ছিল। আমি একবার বইমেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম একটা বই সবাই কিনছে। সুইসাইড নোট না কী যেন নাম। রবীন্দ্রনাথের বৌদি সুইসাইড করেছিল। কেচ্ছা টেচ্ছা।’
রকি থ্রি আবারও কিছু একটা বলতে চাইছিল, নিত্যানন্দবাবু তাকে আবার চোখের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। রকি ফোর সেই সুযোগে বলল, ‘হাম বোলেগা।’ নিত্যানন্দবাবুর রকি ফোরের হিন্দি ভাষাজ্ঞান সম্বন্ধে একটু সন্দেহ জাগল। তবু কিছু বললেন না। তাঁর হিন্দিও খুব একটা…।
রকি ফোর: ‘‘রবীন্দ্রনাথ মাইরি হেভি সেন্টু টাইপ। আচ্ছা দেবদাস কি রবীন্দ্রনাথের? না, না শরৎচন্দ্রের। মনে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ ছাড়া যে ক’টা গান শুনেছি বেশ ন্যাকা ন্যাকা, ঘুম-ঘুম। চানের সময় সাবান মাখতে মাখতে গাইলে সাবান ক্ষয়ে যাবে না।”
রকি থ্রি আর পারছিল না। পারলে সে সব ক’টাকে ভস্ম করে দেয়। তার তৃষ্ণাকে ডাকার গান লিখেছেন যিনি তাঁকে অপমান! এ শুধু রবীন্দ্রনাথের নয় তৃষ্ণারও অপমান! হোক না সে পরের বউ তবু তো একসময় তার ছিল। তার তৃষ্ণা। ডার্লিং তৃষ্ণা। এ তারও অপমান। কেবল নেতাই আছে তাই কিচাইন করা যাচ্ছে না। আসুক তার বলার সময়, সে ফাটিয়ে দেবে। সবার শেষে বলবে। লাস্টে। রবীন্দ্রনাথ ছিল বলে করে খাচ্ছিস। সেই রবীন্দ্রনাথকে অপমান। দোকানের নাম রবীন্দ্র ভাণ্ডার, রবীন্দ্রনাথ হোশিয়ারি। মুদির দোকান থেকে গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া সব রবীন্দ্রনাথের নামে। তাকে নিয়ে কপিল শর্মাপনা!
রকি ফাইভের কথায় রকি থ্রির চিন্তা ছিন্ন হল।
রকি ফাইভ: ‘রবীন্দ্রনাথ গলদা চিংড়ি নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা আমার মনে আছে।
গলদা চিংড়ি তিংড়িমিংড়ি,
লম্বা দাঁড়ার করতাল।
পাকড়াশিদের কাঁকড়া-ডোবায়
মাকড়সাদের হরতাল।
এখন বাজারে গলদা চিংড়িগুলো তিংড়ি মিংড়ি করে না। বরফে শোয়ানো থাকে। রবীন্দ্রনাথ কোন বাজার থেকে চিংড়ি কিনতেন? তাঁর সময় বাজারে বোধহয় জ্যন্ত গলদা চিংড়ি পাওয়া যেত। যদি না যায়, তাহলে কল্পনা করেছেন। কবিরা হেভি কল্পনা করে। মাকড়সাদের হরতাল হলে ভালো। বাড়িতে ঝুল হবে না।’
নিত্যানন্দবাবু এবার রকি থ্রি-র দিকে তাকালেন। সে দৃষ্টিতে সম্মতি। রকি থ্রি বেগবান লড়াকু প্রাইভেট বাসের মতো তীব্র গতিতে তার কথা শুরু করল। ‘‘রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ইজ রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ আমার তৃষ্ণা। ছোটবেলায় আমি ‘বীরপুরুষ’ বলে একটা কবিতা পড়েছিলাম। হেভি মারপিটের কবিতা। একটা বাচ্চা ছেলে একদল ডাকাতকে মেরে ঠান্ডা করে দিল। কে বলে রবীন্দ্রনাথ ন্যাকা। রবীন্দ্রনাথ ব্যবসাবুদ্ধি খুব ভালো নয়। আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথের ইশকুলে ছেলেমেয়েরা পড়ে। তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন পড়ার খরচ বেশি ছিল না। শুনেছি তাঁর স্ত্রীর গয়না বিক্রি করতে হয়েছিল। বউদির সঙ্গে ইয়ে? তিনি ঠিক আমাদের মতো নন। তাঁর ইয়ে আমাদের ইয়ে নয়। লিখেছিলেন, ‘বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে…’ ”
নিত্যানন্দবাবু হাততালি দিয়ে উঠলেন। রকি থ্রি এভাবে বলবে, এতটা বলবে তিনি ভাবতেও পারেননি। ‘বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই’! ক’জন বাংলার মাস্টার পারবে? নেতাইয়ের হাততালিতে রকি থ্রি-র গানের আগল খুলে গেল। বহুদিন পর তৃষ্ণার অবিবাহিত মুখ ভেসে উঠল। গেয়ে উঠল, ‘তৃষ্ণা ওগো তৃষ্ণা’। সুর এদিক-ওদিক, কবিতার মতো। তাতে কী! আবেগ তো জেনুইন। নিত্যানন্দবাবুর মনে হল, রবীন্দ্রনাথ কি নিজেকে নিয়ে কম করেছেন! দাড়ি-বিহীন আত্মপ্রতিকৃতি! তাছাড়া ‘শেষের কবিতা’য় নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা। সইবে, সবই তাঁর সইবে। বাঙালি একদিকে তাঁকে ভক্তি করে মাথায় তোলে, অন্যদিকে রঙ্গ করে পথে বসায়। একটি অন্যটির প্রতিক্রিয়া।
……………………………………….
আরও পড়ুন বিশ্বজিৎ রায়-এর লেখা: কালীপুজোয় নানাবিধ কালিকার চপ ছাড়া চলে?
……………………………………….
রকি থ্রি চোখ বন্ধ করে ফাটা রেকর্ডের মতো তৃষ্ণা তৃষ্ণা করছে। অন্যরা তাকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। নিত্যানন্দবাবু বললেন, ‘কম বেশি সকলের বলাই ফাটাফাটি। আমি সবাইকে চপপতি করে দিচ্ছি। সকলের জন্যই দুটো করে ডিমের ডেভিল।’
রকি থ্রি চোখ খুলল। আনন্দে বাক্যহারা! তারপর বলল, ‘বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই/ ডিমের ডেভিলে বাঁচালে মোরে।’
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………