পুরাণের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক উপাদান সংক্রান্ত। কিন্তু পুরাণ নিজেই তো আর ইতিহাস নয়। এই যুক্তি মুখে মানতে না চাইলেও, অধ্যাপক আইজ্যাকের মতো ভাবধারার মানুষ বোধহয় ভিতরে ভিতরে একটু হলেও এই কথা মেনে নেন। আর মেনে নেন বলেই ইদানীং তাঁরা প্রচুর টাকা খরচ করে এই প্রমাণ করতেই উঠেপড়ে লেগেছেন যে, রামায়ণ-মহাভারতের মধ্যে বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের যথেষ্ট অনুষঙ্গ রয়েছে।
কিছুটা পিছু হটল রাষ্ট্রীয় শিক্ষা অনুসন্ধান এবং প্রশিক্ষণ পরিষদ (এনসিইআরটি)। অধ্যাপক সি আই আইজ্যাক দিনকয়েক আগে সিলেবাস বদলের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তার মধ্যে দু’টি প্রস্তাব নিয়ে শুরু হয়েছে তরজা। ভারতের ইতিহাসকে, তাঁর মতে চারটি পর্বে বিভাজিত করা উচিত– চিরায়ত, মধ্যযুগ, ব্রিটিশ ও আধুনিক ভারতের ইতিহাস। খেয়াল করুন, এই বিভাজন কিন্তু কালানুক্রমিক এবং সেই প্রচলিত ধারণারই অনুসারী। শুধু ‘প্রাচীন’ শব্দের বদলে তিনি ব্যবহার করতে চান ‘চিরায়ত’ শব্দটি। ‘চিরায়ত’ বা ‘ক্লাসিক’ শব্দটির মান্য আভিধানিক অর্থ যদিও কোনওভাবেই কোনও নির্দিষ্ট কালপর্বকে দ্যোতিত করে না। বরং, সময়-নিরপেক্ষ অথচ দীর্ঘসময় ধরে যা প্রাসঙ্গিক থাকে, তাকেই চিরায়ত বলা যায়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ভারত-ইতিহাসে ‘প্রাচীন’ কালপর্বকে শুধু ‘চিরায়ত’ বলা হবে কেন? আসলে এ সিদ্ধান্ত এসেছে তুমুল একপেশে কিছু কাল্পনিক হাইপোথিসিস থেকে– এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী, বলা ভালো, আগুনে হিন্দুত্ববাদীরা মনে করছেন, এই উল্লিখিত সময়পর্বে ভারত ভূ-খণ্ডের শাসন মুসলিম বা অন্য কোনও বহিরাগত শক্তির হাতে যায়নি। যা কিছু সেই সময়ের, তা-ই চূড়ান্ত গৌরবের এবং আদর্শের। আর পরবর্তীকালে বহিরাগত অন্য ধর্মাবলম্বীর হাতে পড়ে নষ্ট হয়েছে সেই আদর্শ, ক্ষুণ্ণ হয়েছে সেই গৌরবগাথা।
আরও পড়ুন: কবিতা পাঠ করে জুটেছিল ‘টেররিস্ট’ বিশেষণ, কমেডির জন্য জুটল এমি পুরস্কার
আর এই মনোভাবকে পুষ্ট করতেই সি আই আইজ্যাকের দ্বিতীয় প্রস্তাব, ‘প্রাচীন’-কে ‘চিরায়ত’ বলে চিহ্নিত করে রামায়ণ-মহাভারতকে ওই পর্বের ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। মহাকাব্য হিসেবে রামায়ণ-মহাভারত ‘চিরায়ত’, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দুই কাব্যের ঐতিহাসিক মূল্য কতখানি? পুরাণের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক উপাদান সংক্রান্ত। কিন্তু পুরাণ নিজেই তো আর ইতিহাস নয়। এই যুক্তি মুখে মানতে না চাইলেও, অধ্যাপক আইজ্যাকের মতো ভাবধারার মানুষ বোধহয় ভিতরে ভিতরে একটু হলেও এই কথা মেনে নেন। আর মেনে নেন বলেই ইদানীং তাঁরা প্রচুর টাকা খরচ করে এই প্রমাণ করতেই উঠেপড়ে লেগেছেন যে, রামায়ণ-মহাভারতের মধ্যে বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের যথেষ্ট অনুষঙ্গ রয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে নানাবিধ গবেষণার আয়োজনও চলছে সাজো-সাজো রবে। রামকে কোনও এক ঐতিহাসিক চরিত্র বলে ধরে নিয়ে সেই প্রস্তাবনার পরিচয় এবং ভূমিকাকে ইতিহাসে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজবিজ্ঞানের চৌহদ্দির মধ্যে নিয়ে আসতে তাঁরা বদ্ধপরিকর।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর ওয়াল্লাদের বাকস্বাধীনতা মানেই গরাদের ওপার
এর পাশাপাশি ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ বলে আপাত নির্বিষ একটি বিষয়ের কথাও বেশ কিছুদিন ধরে তাঁরা বলে চলেছেন। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ বলে মূলত হিন্দুত্ববাদীদের অ্যাজেন্ডাই বলবৎ করা হচ্ছে। বছর পাঁচেক আগেই, ২০১৮ সালে চালু হওয়া ‘বিজেপি টিচার্স সেল’-এর দফা দশেক দাবির মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল, ‘ধর্মনিরপেক্ষ সিলেবাস’। তা এমন দাবি নতুন করে এলে বুঝতে হয়, এতদিনের সিলেবাস যথেষ্ট ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নয় নিশ্চয়ই, তাই কেঁচে গণ্ডূষের প্রস্তাব উঠছে। অথচ, মাত্র তিন বছরের মধ্যেই বারো দফা দাবি নিয়ে ২০২১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে তারা যে পদযাত্রার ডাক দেয়, তাতে দেখা যায়, ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি উঠে গিয়ে সেখানে এসেছে ‘শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মর্যাদা প্রদান’। তা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ থেকে ‘ভারতীয় কৃষ্টি’তে পৌঁছে যাওয়ার পথটা ঠিক কীরকম? আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি যে, যা কিছু আরএসএস-এর চক্ষুশূল, যেমন ধরুন গণতন্ত্র ও বৈচিত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, নির্জোট আন্দোলন, ঠান্ডা লড়াই আর সবচেয়ে অপছন্দের, ইসলামের উত্থান, অ্যাফ্রো-এশিয়ান অঞ্চলসমূহ এবং ভারতে মুঘল আমলের ইতিহাস– এই সবই ছেঁটে ফেলা হয়েছে কেন্দ্রীয় বোর্ডের সিলেবাস থেকে। কৃষিনীতি নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তিতে থাকা, পিছু হটা কেন্দ্রীয় সরকার দশম শ্রেণির সিলেবাস থেকে বাদ দিয়েছে ‘কৃষিতে বিশ্বায়নের প্রভাব’ অংশটি। একইভাবে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা আর পড়বে না ‘দারিদ্র আর পরিকাঠামো’ অধ্যায়টিও যা সাম্প্রতিক মহামারীর প্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আরও পড়ুন: বিষণ্ণ কমলালেবুর দেশে
এই ছেঁটে ফেলা অংশগুলো খেয়াল করলে বোঝা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যালার্জি ঠিক কোন কোন বিষয়ে। ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই তারা অস্বীকার করতে চায়, ছুড়ে ফেলে দিতে চায় অন্য ধর্মের মানুষদের। তবে এই প্রচেষ্টা তাদের নতুন নয়। গত বছরই পাঠ্যসূচি থেকে বাদ গিয়াছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, নাগরিকত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়গুলো। প্রচণ্ড বিরোধিতার কারণে এই বিষয়গুলি আবার ফিরে আসে পাঠ্যসূচিতে। এর আগেই কর্নাটকের বিজেপি সরকারও অতিমারীকে অজুহাত করে সিলেবাস থেকে বেছে বেছে টিপু সুলতান, যিশুখ্রিস্ট এবং মহম্মদের প্রসঙ্গ মুলতবি রাখতে চেয়ে পড়েছে বিতর্কের মুখে। আঁচ এসে পড়ছে এরাজ্যেও। আরএসএস নেতা আশিস বিশ্বাস ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়ে রেখেছেন, ‘বিদেশি’ কারওর প্রসঙ্গ পাঠ্যসূচিতে চলবে না। মার্কসবাদকে নিশানা করতে গিয়ে পাঠ্যসূচি থেকে এবার আইনস্টাইন-নিউটন, ডারউইন-ল্যামার্ক, শেলি-কিটসও বোধহয় বাদ পড়বেন! এই বছর সুযোগ পেতেই এনসিইআরটি-কে শিখণ্ডী করে আবার বাদ গেল নানা বিষয়। ফলে অধ্যাপক আইজ্যাকের বক্তব্য কোনও বিচ্ছিন্ন এবং ব্যক্তিগত মতের প্রকাশ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
তাহলে এই সব কথা বলে এনসিইআরটি তড়িঘড়ি অধ্যাপক আইজ্যাকের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক অস্বীকার করল কেন? এনসিইআরটি-র ডিরেক্টর দীনেশ প্রসাদ সাকলানি মিডিয়ার কাছে স্পষ্ট করেই এই দূরত্বের কথা বলেছেন। তাহলে কি এনসিইআরটি ‘ধীরে চলো’ নীতি মেনে এগোতে চাইছে?
ভারতীয় সংস্কৃতির হদ্দমুদ্দ করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই দেশের ৯০০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে ইউজিসি ‘গো বিজ্ঞান পরীক্ষা’ নেওয়ার নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। ইতিহাসের নামে অন্ধবিশ্বাস, সংস্কৃতির নামে কুসংস্কার, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মৌলবাদের এই উন্মাদের পাঠক্রমকে আটকাতে সর্বস্তরেই জোরালো প্রতিবাদ যে ভীষণ জরুরি, সেই কথাটা ভুলে যাওয়াটাই বোধহয় এই শতকের সবচেয়ে বড় অন্যায় হয়ে দাঁড়াবে। সব নীরবতাকে ইতিহাস ক্ষমা করে না।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved