‘পাশের দেশের ঘটনা’ বলে যাঁরা মানসিক সান্ত্বনা খুঁজতে চাইতে পারতেন, তাঁদের জন্যে রয়েছে গত মাসের শেষে হরিয়ানার গ্রামে গোরক্ষকদের গণপিটুনিতে মৃত বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক সাবির মল্লিকের লাশ। সাবিরদের বস্তির কোনও বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হয়েছে, কেবলমাত্র এমন একটা সন্দেহের বশেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁকে। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী যদিও বলেছেন যে, এরকম ঘটনাকে দুম করে ‘গণপিটুনি’ বলে দেওয়া উচিত নয় কারণ গোরক্ষা সংক্রান্ত কড়া আইন আছে রাজ্যে। গরুর জন্যে গ্রামবাসীদের মনে এতটাই ভক্তি যে, এমন একখানা কথা তাদের কানে একবার পৌঁছলে কে আর তাদের রোখে! অর্থাৎ গণরোষের সামনে হাত তুলে নিচ্ছে আইন এবং প্রশাসনও। এই সমাজেই আমরা চাকরি করি, খবর পড়ি, সিনেমা দেখি, চায়ে চুমুক দিই।
প্রচ্ছদ: দীপঙ্কর ভৌমিক
আমাদের ‘স্মৃতি’ বলে আদতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। তাকে গিলে খেয়েছে ইতিহাস। ‘বড়’ ইতিহাসের কামড়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে আমাদের ছোট ছোট ব্যক্তিগত স্মৃতি-টুকরো ঝুলে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে। ব্যক্তিগত ট্রমা হাঁটতে থাকে সমষ্টিগত ট্রমার সমান্তরালে, আজীবন। তার পায়ে ধুলোবালি, টুকরো কাচ, পাথরকুচি। আমাদের ব্যক্তিগত রক্তের ধারা মিশে যায় উপমহাদেশের রক্তনদীতে। গণপিটুনিতে থেঁতলে যাওয়া শরীরের কথা লিখতে গিয়ে দেখি চোখের সামনে একটার পর একটা শরীর– রক্তমাখা মুখ, কবজি কেটে নেওয়া হাত। কারও নাম পকেটমার, কারও নাম ছেলেধরা। কেউ সন্ত্রাসী, গরুখোর বা দেশদ্রোহী। উন্মত্ত জনতার হিংস্র চোখের মতো চাঁদ ওঠে। তার নিচে বসে দেখি, একপাল লোক ঘিরে ধরেছে মফস্সল থেকে আসা ছেলেটিকে। হোস্টেলময় ছড়িয়ে পড়ছে কান্না, আর্তনাদ। আর একটু পরে তাকে ঝাঁপ দিতে হবে নিচে।
আমরা ভয় পাই। কেঁপে উঠি। শিউরে উঠি তোফাজ্জল নামে এক অতি সাধারণ যুবকের ভাত খাওয়ার ছবি দেখে। তোফাজ্জলের কোনও পেশা ছিল না। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সে ঘুরে বেড়াত পথ থেকে পথে। ভাত চেয়ে খেত। পেটভরে ভাত খাইয়ে, রান্না কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করে, তোফাজ্জলকে চরম নৃশংসতায় একটু একটু করে পিটিয়ে মেরে ফেলবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে এককালে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হত, যেখানে পড়ার সুযোগ সে দেশের বহু মেধাবী ছাত্রছাত্রীর কাছে স্বপ্ন। ঘটনার দু’-একদিন পরে ওই ছাত্রদের মধ্যে একজনের সাক্ষাৎকার নেবেন কোনও একজন সংবাদকর্মী। কেন ওই যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল, এই প্রশ্নের উত্তরে ছাত্রটি ভীষণ স্বাভাবিক অসহায়তার সুরে বলবে, ‘আরে ভাই আমার ফোনটা… ফোনটা পাচ্ছিলাম না। আবেগের বশে মেরে ফেলেছি।’ ফোন হারানোজনিত আবেগের বশে একজন মানুষ, একপাল মানুষ আরেকজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে যেখানে, সেই পৃথিবীতেই আমরা খাই, ঘুমোই, ভালোবাসি, সন্তানের জন্মও দিই।
‘পাশের দেশের ঘটনা’ বলে যাঁরা মানসিক সান্ত্বনা খুঁজতে চাইতে পারতেন, তাঁদের জন্যে রয়েছে গত মাসের শেষে হরিয়ানার গ্রামে গোরক্ষকদের গণপিটুনিতে মৃত বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক সাবির মল্লিকের লাশ। সাবিরদের বস্তির কোনও বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হয়েছে, কেবলমাত্র এমন একটা সন্দেহের বশেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁকে। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী যদিও বলেছেন যে, এরকম ঘটনাকে দুম করে ‘গণপিটুনি’ বলে দেওয়া উচিত নয় কারণ গোরক্ষা সংক্রান্ত কড়া আইন আছে রাজ্যে। গরুর জন্যে গ্রামবাসীদের মনে এতটাই ভক্তি যে, এমন একখানা কথা তাদের কানে একবার পৌঁছলে কে আর তাদের রোখে! অর্থাৎ গণরোষের সামনে হাত তুলে নিচ্ছে আইন এবং প্রশাসনও। এই সমাজেই আমরা চাকরি করি, খবর পড়ি, সিনেমা দেখি, চায়ে চুমুক দিই। কী আশ্চর্য, পড়শি দেশের ‘নৃশংস সমাজ’-কে তেড়ে গালি দিতেও ছাড়ি না। ওই দেশেরও অনেকে হয়তো ঠিক একই কাজ করেন।
ফিরে যাই তোফাজ্জলে। যে বিষয়টি মানুষকে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত করেছে তা সম্ভবত ‘মেধাবী’ ছাত্রদের হাতে তোফাজ্জলের নৃশংস মৃত্যু। ঠান্ডা মাথায় খুন। বিশেষত, ছাত্র-আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতনের পরে এমন ঘটনা মানুষকে প্রবল আলোড়িত করেছে। কিন্তু তোফাজ্জল-হত্যা তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশ, তথা গোটা উপমহাদেশের ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে গণপিটুনিতে মরা মানুষের রক্তের দাগ। এই ঘটনার পর যাঁরা বলছেন, ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’, ‘কলোনি’ হারানোর মনস্তাত্ত্বিক চাপে যাঁরা ভুলে যেতে চাইছেন জুলাই-আগস্ট মাসে হাজারখানেক মানুষকে গুলি করে খুন করা হয়েছে, যাঁরা ভুলে যেতে চাইছেন ছোট্ট মেয়ে রিয়া গোপের লাশ, তাঁরা একটু ইন্টারনেট ঘাঁটলেই দেখতে পেতেন, হাসিনার আমলে ছাত্রলিগ, অর্থাৎ আওয়ামী লিগের ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা করেনি হেন কুকর্ম নেই। তোফাজ্জলের মৃত্যুতে প্রধান অভিযুক্তদের মধ্যেও রয়েছেন সেই ‘সাবেক ছাত্রলীগ’ সদস্য। জমানা বদলায়, গণপিটুনির উৎসব থামে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মারা হল, যিনি আবার পরিচিত ছিলেন ‘শ্যুটার শামিম’ নামে। মাত্র কয়েক দিন আগে বাবা হওয়া একজনকেও পিটিয়ে মারা হল।
একটু পিছনে ফিরে যাই। আওয়ামী শাসন যখন মধ্যদিনের সূর্যের মতো বিরাজমান, সেই ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হয় ৩৩ জন, গুরুতর আহত হয় ১৫০০ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৮-র মধ্যে আওয়ামী লিগের ছাত্র সংগঠনের নৃশংসতার বলি হয় আরও ১২৯ জন। ২০২২ সালের এপ্রিলে ডেলিভারিম্যান নাহিদ হোসেনকে তার কর্মস্থলের কাছেই ঘেরাও করে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ২০১৯-এর অক্টোবরে এক ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট। আবরার ফাহাদ নাম এক ছাত্রকে জামাতে ইসলামি-র ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলে ছাত্রলীগের কিছু সদস্য।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে বিরোধীদলের সমর্থক সন্দেহে বিশ্বজিৎ দাস নামে ঢাকার এক দর্জিকে তাড়া করে লোহার বার ও হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে মারে ছাত্রলীগের সদস্যরা। ছাত্রলীগের নৃশংসতা থেকে ছাড় পায়নি এমনকী ছাত্রলীগ নিজেও। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে বেধড়ক পিটুনির জেরে মারা যান ছাত্রলীগেরই কর্মী সাদ ইবনে মমতাজ। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগেরই দুই লবির মধ্যে মারামারিতে প্রাণ হারান জুবায়ের আহমেদ। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একইভাবে মারা যান আবু বকর। বিশ্ববিদ্যালয় হলের গেস্টরুমে ছাত্রদের ডেকে নির্যাতন করা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রায় সংস্কৃতিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। প্রাণে বেঁচে গেলেও এহসান রফিক, মাহাদি আকিব, জাহিদুর রহমান, বা আলি ইমাম শীতলের মত বহু বহু ছাত্রের উপর যে নির্যাতন হয়েছিল, তার সামান্যতম বিবরণ শুনলে যে কোনও সুস্থ মানুষ অসুস্থ বোধ করবেন।
কোন অধিকারে ছাত্রলীগের সদস্যরা দিনের পর দিন চালিয়ে গেছেন এই চূড়ান্ত অমানবিক কর্মকাণ্ড? উত্তরটা কঠিন নয়। তারা জানতো তাদের মাথার উপর রয়েছে গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ। আমরা যদি তারও আগে ফিরে যাই, তাহলে দেখব বিএনপি-জামাতের শাসনকালে বা এরশাদের আমলেও গণপিটুনির ছবিটা একই রকম ছিল। শাসক বদলায়, গণপিটুনির ধারাবাহিকতা একই থাকে। একই রকম থাকে বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণের ধারা। আমরা যখন আখলাক বা আফরাজুলের কথা ভাবি, তখন কি সফদর হাসমির কথা মনে পড়ে না? মনে পড়ে না অনিতা দেওয়ানকে? জামাতে ইসলামির ছাত্রসংগঠনকে খুন করার হুমকি দিয়ে বলা ‘একটা করে শিবির ধর, ধরে ধরে জবাই কর’ এবং ‘একটা করে নাস্তিক ধর, ধরে ধরে জবাই কর’-এর মধ্যে কোনও ফারাক নেই। আছে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীকে হত্যাযোগ্য করে তোলার গাঢ় অন্ধকার। এই অন্তহীন ট্রমা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। ধূ ধূ মরুভূমির মাঝে বসে থাকে নিঃসঙ্গ ধর্ষিতা নারী, থেঁতলে যাওয়া তরুণ, রক্তমাখা বৃদ্ধ। মানুষের যাবতীয় অর্জনের গায়ে ছিটে ছিটে রক্ত। নাৎসিবাদের পরাজয়ের হাত ধরে থাকে ‘রেপ অফ বার্লিন’। আমরা কোথায় পালাব? কোন মতাদর্শ হাত ধরবে আমাদের?
মহান মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরেই ঢাকা শহরে প্রকাশ্য জনসভায় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিপক্ষের কয়েকজনকে যিনি হত্যা করেছিলেন, তাঁর নাম কী? এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। চাইলেই জানা যায়। স্রেফ রাজনৈতিক বিশ্বাসের পার্থক্যের জেরে সংগঠিত হয়েছিল কমিউনিস্ট নেতা সিরাজ শিকদারের বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড। সেই রাষ্ট্রীয় খুনের পর কে বলেছিলেন, ‘কোথায় সিরাজ শিকদার?’, কে ‘লাল ঘোড়া’ থামিয়ে দেওয়ার হুংকার দিয়েছিলেন? সব তথ্যই ইন্টারনেটে লব্ধ। আমরা কি বীর মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞ হত্যাকাণ্ডের কথা জানি? ১৯৭৩ সালের ১০ মার্চ আরও তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউর রহমান লেবু, বিষ্ণুপদ কর্মকার, শ্যামাপদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে কমলেশ বেদজ্ঞকেও পিটিয়ে খুন করেছিল আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তরা। আমরা যেন এই তথ্য জেনে আশ্চর্য না হই যে, খুনিরাও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাই। এমন অজস্র নাম, অসংখ্য ঘটনা। ইতিহাস শরীরময় কাদা কাদা রক্ত। পা ফেলাই দুষ্কর। তারপর তো এগোনোর ভাবনা।
গাাঢ় স্বৈরাচার কেবল তার পোষ্যদেরই নৃশংসতার অলিখিত ছাড়পত্র দেয়, তাই নয়। অনুচ্চারিত সন্ত্রাস ও বিভেদের বাতাবরণে থাকা একটা সমগ্র সমাজকেই সে ক্রমশ আরও নৃশংস করে তোলে। বিবিসি বাংলার হিসেবমতে ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ছেলেধরা, ডাকাত বা চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে মারা গিয়েছেন ৮০০ জন মানুষ। ২০১৪ সাল থেকে ধীরপায়ে ফ্যাসিবাদের দিকে এগোতে থাকা ভারতেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গণপিটুনির ঘটনা, যার একটা বড় অংশই গোহত্যা বা গোমাংস কেন্দ্রিক সন্দেহের জেরে। তার পাশাপাশি আছে জয় শ্রীরাম না বলতে চাওয়ার অপরাধে গণপিটুনি, প্রেম-জিহাদীর তকমা লাগিয়ে গণপিটুনি। মোহাম্মদ আখলাক বা তাবরেজ আনসারী তো একক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নন। তাঁদের লাশ সরাসরি ভারতের বর্তমান শাসকদলের হিন্দুত্বের মতাদর্শের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু এছাড়াও আছে চোর বা শিশু পাচারকারী সন্দেহে গণপিটুনি, পরকীয়ার ‘অপরাধে’ গণপিটুনি, ডাইনি সন্দেহে গণপিটুনি। পশ্চিমবঙ্গেই গত জুন-জুলাই মাসে তিলকে তাল করে ঘটে গেছে পরপর বেশ কতকগুলি গণপিটুনির ঘটনা। সামাজিক মাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননার অপরাধে গণপিটুনির ঘটনাও আছে ভারত ও বাংলাদেশ দুই জায়গাতেই। সংবাদসংস্থা দ্য কুইন্ট ভারতে গণপিটুনির ঘটনার একটি ডিজিটাল মানচিত্র তৈরী করেছে যেখানে গণপিটুনির শিকার হওয়া মানুষগুলির নামপরিচয়সহ গণপিটুনির তারিখ ও কারণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই মানচিত্রের দিকে একনজর তাকালেই বুঝতে পারা যায় গোরক্ষার নামে ভারতে বলি হয়ে চলেছেন কত কত মানুষ! বিশ্বের বাজারে গোমাংস রপ্তানিতে ভারত তৃতীয় না কি চতুর্থ স্থানে, সে হিসেব আপাতত মুলতুবি থাক। বরং যেটা খেয়াল করা যাক, সেটা হল, প্রায় প্রতিটি গণপিটুনিই কিন্তু সন্দেহের বশে। সন্দেহ মানুষকে একত্র করছে এবং সম্মিলিত জনতাকে দিচ্ছে তার ভিতরের অবদমিত নৃশংসতাকে বার করে আনার অবাধ ছাড়পত্র।
এই কালেক্টিভ নৃশংসতার প্রবণতা এক মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। এই অসুখ সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চরিত্রে নিহিত। রাজনৈতিক কারণ হিসেবে স্বৈরাচারের পাশাপাশি থাকে আইনশৃঙ্খলার প্রতি মানুষের গভীর অনাস্থা। প্রশাসনিক কাঠামো যখন দুর্নীতি ও অপদার্থতার কারণে মানুষকে ন্যায়বিচার ও আইনি সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সহজেই মানুষ বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নেন। সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে বহু সংবেদনশীল মানুষকেও বলতে শুনছি যে, বিচার এবার রাজপথে হওয়া দরকার। এর একমাত্র কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে পুলিশ, তদন্তকারী সংস্থা, এমনকী, বিচারব্যবস্থার প্রতি চূড়ান্ত অনাস্থা। এর পাশাপাশি আছে মানুষের আর্থসামাজিক নিরাপত্তার অভাব। অর্থপূর্ণ এবং অর্থকরী কাজের অভাব মানুষের ভিতরকার নিকৃষ্ট প্রবৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তোলে। শিক্ষা এবং সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার অভাব মানুষের উদারতা ও কোমল প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটতে দেয় না, নষ্ট করে দেয় স্বাভাবিক সংবেদনশীলতা।
আমাদের শহর নগরের রাস্তাগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, পরস্পরকে জায়গা ছেড়ে দিতে মানুষ কতখানি নারাজ। ট্র্যাফিক আইন বা প্রাণের ঝুঁকি, কোনওকিছুই তাঁদের বাঁধ মানাতে পারে না। একটা গাড়ির সঙ্গে আরেকটা গাড়ি ঠুকে গেলে মুহূর্তের মধ্যে চালকেরা পরস্পরের কলার খামচে ধরেন, বইতে থাকে গালিগালাজের বন্যা। একটা অসুস্থ সমাজের জন্ম হয়েছে উপমহাদেশে, গত সাড়ে ৭ দশকে সেই অসুস্থতা ক্রমশ বেড়েছে। ক্রমাগত অন্যায়-অবিচার দেখতে দেখতে মানুষের সয়ে যায়। সে দর্শক হয়ে যায়। আর কেউ কেউ দর্শক হতে হতে একসময় ধর্ষকও হয়ে যায়। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছে চট্টগ্রামে খুঁটিতে বাঁধা এক যুবককে গান গাইতে গাইতে মারধর করছে উন্মত্ত জনতা। এই বীভৎসতার ব্যাখ্যা কী? কালীপুজোর রাজে পথকুকুরের গায়ে বাজি ছুড়ে মারার কারণ কী? এই বীভৎস বিনোদনের জন্ম দিচ্ছে একটা পচে গলে যাওয়া অসুস্থ সমাজ, আমরা সকলেই যার অংশ।
নৃশংসতা মানুষের সহজাত কি না তাই নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। বেশ কিছু মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষানিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে অনেকখানি সময় ধরে একটা বদ্ধ পরিবেশে উদ্দেশ্যহীনভাবে থাকা মানুষ অকারণেই নৃশংসতায় মেতে উঠতে পারে। অনেকেরই জানা থাকবে, মারিনা আব্রামোভিচের রিদম জিরো এক্সপেরিমেন্টের কথা, যেখানে ছ’-ঘণ্টা ধরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে তিনি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া জনতাকে বলেছিলেন যে তাঁকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে তারা। প্রথমে ভালো ব্যবহার দিয়ে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রতি নৃশংস হয়ে ওঠে জনতা। আবার ক্ষমতার অসম বণ্টনও আপাত বিরোধহীন মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে পরস্পরের বিরুদ্ধে। স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্টের কথাও তো আমরা জানি। দু’দল মানুষকে দু’সপ্তাহ ধরে একটি জেলখানায় রেখে জেলরক্ষী ও জেলবন্দির ভূমিকায় অভিনয় করতে বলা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে আপাত কোনও বিরোধ ছিল না। তাঁরা প্রত্যেকেই জানতেন যে, ওই ভূমিকায় অভিনয় করছেন মাত্র। অথচ ছ’দিনের মধ্যেই এই নকল রক্ষীরা নকল বন্দিদের ওপর এমন অত্যাচার শুরু করেন যে, পরীক্ষাটি বন্ধ করে দিতে হয়। আবার কোনও কোনও মনোবিজ্ঞানীর মতে মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ অন্য মানুষের ওপর অকারণ অত্যাচার করতে পারে না। বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্ট সামাজিক পরিস্থিতি মানুষকে অমানবিক করে তোলে ও তার মধ্যে থেকে অপরাধবোধ কেড়ে নেয়।
গণপিটুনির ঘটনায় গ্রেফতারি এবং গ্রেফতার যদিও বা হয়, সাজা দেওয়ার হার অন্যান্য অপরাধের তুলনায় কম। উপরন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনরোষের দোহাই দিয়ে প্রশাসনের ভূমিকাকে লঘু করে দেখান। ২০১৭ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো গণপিটুনি ও ঘৃণাজনিত অপরাধের ওপর তথ্য পরিসংখ্যান সংগ্রহ করেছিল, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সাম্প্রতিককালে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর মতো অতীতে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতও গণপিটুনির ঘটনাকে লঘু করে দেখিয়েছেন। গণপিটুনি ভারতের ঐতিহ্য নয়, বরং অন্য ধর্ম থেকে আমদানি করা এমনটাও বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে গণপিটুনি প্রতিরোধে আনা বিল দীর্ঘকাল ধরে পাশ হতে পারেনি প্রশাসনিক চাপানউতোরে। এইসব গাফিলতিরও মাশুল দিয়ে ঝরছে একের পর এক প্রাণ। সমাজ হয়ে উঠছে আরও নির্মম, নির্লজ্জ, আর অসংবেদনশীল।
আমাদের আসলে পালানোর মতো কোনও জায়গা নেই৷ পকেটমারকে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে মারতে দেখেছে শৈশব, তার থেকে পালিয়ে আমরা যাব কোথায়? পিঁপড়েকে অকারণে দু’-টকরো করে ছিঁড়েছে যে হাত, যে মন চোখ উপড়ে নিতে চেয়েছে প্রতিপক্ষের, তার থেকে পালিয়ে কোথায় যাব আমরা? আমাদের থাকতে হবে এখানেই। থকথকে কাদার মতো রক্তে মুখ ডুবিয়ে, আজীবন। নেপথ্যে বাজবে গণপিটুনিতে মরতে থাকা ব্যক্তির আর্তচিৎকার। সেই চিৎকারের কোনও দল নেই, মতাদর্শ নেই, দেশ নেই।