সত্যি বলতে, পশ্চিম ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন ঘটে হুগলি নদীর তীরে এই শহরটিতে। ১৭৫৭-তে ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণ করে দখল করে নেন। ১৭৬৫-তে প্যারিস সন্ধির ফলে চন্দননগর ফরাসিদের ফেরত দেওয়া হয়। ১৭৭৮-এ ইউরোপে ইংল্যান্ড-ফ্রান্স যুদ্ধ, এখানে চন্দননগর ইংরেজদের দখলে। পাঁচ বছর পর ইউরোপে সন্ধি, চুক্তি মতে শহরটি আবার ফরাসিদের। ১৭৯৩-তে ফরাসি বিপ্লবের সূত্র ধরে আবার ফরাসিদের হাতছাড়া হয় চন্দননগর। মোট চারবার ইংরেজদের অধীনে থাকার পর ১৮১৬ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত শহরটি ছিল ফরাসিদের দখলে।
চন্দননগরে ফরাসি বণিকদের আগমনের পূর্বেই দুপ্লেসি নামে জনৈক ফরাসির আবাসস্থল ছিল বর্তমান চন্দননগরের উত্তরপ্রান্তে বোড় কিষাণপুর নামক পল্লিতে। ১৬৭৩-’৭৪ সাল নাগাদ তিনি ৬০ বিঘা পরিমাণ জমি কিনে ওই অঞ্চলে বাস করতে শুরু করেন। তাঁর বসতবাড়ির দক্ষিণে গড়ে উঠেছিল ফরাসি বাণিজ্য কেন্দ্র। ১৬৮৮-তে ফরাসিরা বাদশাহের কাছ থেকে কিনে নেয় ৯৪২ হেক্টর জমি। এরপর থেকেই
চন্দননগরের উন্নতি। ১৬৯৩ থেকে তারা পেয়ে যায় অবাধ বাণিজ্যের অধিকার। এই সময়ে পাশাপাশি বণিক-কুঠিগুলিকে দ্রুত দুর্গে পরিণত করার কারণ ঘটেছিল মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণায় বেতুয়া জমিদারির তালুকদার শোভা সিংহের আক্রমণ। তাঁকে আটকাতে না পেরে হুগলির ফৌজদার নুরুল্লা খান পালিয়ে যান। হুগলি দখল করে শোভা সিংহ চুঁচুড়ার দিকে অগ্রসর হন। আক্রমণের আশঙ্কায় ফরাসিরা দ্রুত দুর্গ গড়ে তোলেন।
বিখ্যাত আরলাঁ দুর্গের অবস্থান ছিল বর্তমান লালদিঘির পূর্ব দিকে। চন্দননগরের শ্রীবৃদ্ধি উত্তরোত্তর বেড়ে চলে ১৭৩১-এ ফ্রাঁসোয়া দুপ্লের আগমনের পর থেকে। শহরটিকে পরিকল্পনামাফিক সুন্দর করে তিনিই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। নদীর তীরবর্তী স্ট্র্যান্ড, প্রশাসক আবাস, এখন যা ‘অ্যাস্তুত দ্য চন্দননগর’, সেন্ট যোসেফ কনভেন্টের অভ্যন্তরীণ চ্যাপেল (১৭২০ সালে নির্মিত) প্রভৃতি ফরাসি আমলের
বহু স্মারক গোটা শহরে এখনও ছড়িয়ে আছে।
ফরাসি চন্দননগরকে আলাদা করে রাখার জন্যে নির্মিত হয়েছিল দু’টি ফটক। উত্তরেরটি অনেক দিন আগেই বিলুপ্ত প্রায় ৷ একটি স্তম্ভের সামান্য একটু অংশ ফুটপাতের দোকানঘরের আড়ালে ঢেকে গিয়েছে। দক্ষিণেরটি এখনও দৃশ্যমান। চন্দননগরের প্রাচীনতম দু’টি হোটেলের একটি বর্তমানে আদালত ভবন, অন্যটি কলেজ প্রাঙ্গণের মধ্যে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ পর্যন্ত চন্দননগরে ফরাসিদের দাস ব্যবসা ভালোই চলত। বলা যেতে পারে, রীতিমতো দাসদাসীর আড়ত ছিল। তাদের হাট বসত, নৌকো বোঝাই হয়ে দাসদাসী স্থানান্তরে চালান যেত। ফরাসিরা বাণিজ্যকুঠি বিস্তারের জন্য এদেশি মানুষদের চাকরি ও ইজারা দিতে শুরু করে। ফলে ফরাসি কর্তাদের সঙ্গে শহরের এক বিশেষ শ্রেণির মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। তিনি ছিলেন চন্দননগর শহরের ইজারাদার। চন্দননগরের মানুষদের তাঁকে কর দিতে হত। তিনি আবার ফরাসি কোম্পানিকে কর দিতেন। ফরাসি উপনিবেশবাদী শাসক ও এদেশের জনগণের মধ্যবর্তী শাসক ছিলেন তিনি। এভাবেই তিনি বিপুল বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। লালবাগান অঞ্চলে তিনি প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন এবং ১৭৪০ সালে তৈরি করেন নন্দদুলাল মন্দির।
ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায় এখানে ঔপনিবেশিক বৈষম্যের জগৎ ছিল। সাদা মানুষদের চোখে চন্দননগরের নাগরিকেরা ছিলেন অবজ্ঞার পাত্র। শহর বিভক্ত ছিল সাদা মানুষ ও কালো মানুষদের অঞ্চলে (Ville Blanche ও Ville Noire)। প্রথমদিকে ফরাসিরা এখানে আসে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা করতে। দুপ্লে সেই ব্যবসা ঠিকমতো চালাতে পারেননি। অন্যদিকে পাশের শহরে ডাচেরা চুঁচুড়ায় রমরমিয়ে ব্যবসা করছেন। যাই হোক, পরে ফরাসিরা জমিয়ে তুলেছিল প্রধানত রপ্তানি ব্যবসা। এখান থেকে রপ্তানি হত চাল, ডাল, গম, ছোলা, তিল, সরষে, পোস্ত, ঘি,চর্বি, তিসি, আফিং, মসলিন, বিভিন্ন সুতি ও রেশম বস্ত্র, কাঠের জিনিস, মাটির জিনিস প্রভৃতি। বড়লাট ক্লাইভ চন্দননগরে লক্ষীগঞ্জ বাজারের চালের আড়ত দেখে বলেছিলেন, ‘চন্দননগর হলো বাংলার শস্যাগার।’ উচ্চাভিলাষী ইংরেজ অনেকবারই চন্দননগর আক্রমণ, দখল ও লুণ্ঠন চালায়।
পরে আবার স্বাক্ষরিত চুক্তির বলে হাত বদল করে।
সত্যি বলতে, পশ্চিম ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন ঘটে হুগলি নদীর তীরে এই শহরটিতে। ১৭৫৭-তে ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণ করে দখল করে নেন। ১৭৬৫-তে প্যারিস সন্ধির ফলে চন্দননগর ফরাসিদের ফেরত দেওয়া হয়। ১৭৭৮-এ ইউরোপে ইংল্যান্ড-ফ্রান্স যুদ্ধ, এখানে চন্দননগর ইংরেজদের দখলে। পাঁচ বছর পর ইউরোপে সন্ধি, চুক্তি মতে শহরটি আবার ফরাসিদের। ১৭৯৩-তে ফরাসি বিপ্লবের সূত্র ধরে আবার ফরাসিদের হাতছাড়া হয় চন্দননগর। মোট চারবার ইংরেজদের অধীনে থাকার পর ১৮১৬ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত শহরটি ছিল ফরাসিদের দখলে। ভদ্রেশ্বর ও চাঁপদানির মধ্যবর্তী গরুটি বা গৌরহাটিতে ছিল ফরাসিদের একটি ছিটমহল। দুপ্লে চন্দননগরে গভর্নর হয়ে আসার পর এখানে একটি ‘ফ্রেঞ্চ গার্ডেন’ নির্মাণ করেন। বাগানের মধ্যে ছিল একটি সুদৃশ্য উৎকৃষ্ট প্রাসাদ। এই প্রসাদেই হয়েছিল বঙ্গদেশের সর্বপ্রথম নাট্যাভিনয়। এই গৌরহাটিতেই দুপ্লে গোপনে গড়ে তুলেছিলেন সামরিক ঘাঁটি। তিনি বুঝেছিলেন চন্দননগর প্রবেশের নদীর বাঁকের মুখে এই অঞ্চলটি নৌ-সামরিক ঘাঁটি হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এই ভাবনা মোটেই কার্যকর হয়নি। ক্লাইভ চন্দননগর দখলের সময় এই অঞ্চলটিও দখল করে নেন। ১৭৫৭-র মার্চে চন্দননগর দখল করে এসে এখানেই অপেক্ষা করেন। মে মাস নাগাদ এখানকার প্রাসাদে মীরজাফরের সঙ্গে গোপন শলা করার পর ১৩ জুন যাত্রা করেন মুর্শিদাবাদ অভিমুখে। এরপরের ঘটনাতেই সম্পূর্ণ বদলে যায় বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
‘প্রাচীন স্মৃতি’ বলতে এখন শুধু ফরাসি আমলের থানা ছাড়া আর কিছুই নেই গৌরহাটিতে। সেই অব্যবহৃত থানাটি এখনও প্রাচীন ইতিহাসের স্মৃতি বহন করে চলেছে। চন্দননগরে এখনও শতাব্দী প্রাচীন বেশ কিছু সৌধ ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ও ফরাসি সরকারের মিলিত উদ্যোগে এখানকার আটটি প্রাচীন সৌধের সংস্কার করার কাজ শুরু হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে ১৮৭৫ সালে তৈরি হওয়া ফরাসি প্রশাসন ভবন বা রেজিস্ট্রি অফিস, প্যারিসের সঁ জেরাম্যাঁ চার্চের অনুকরণে ১৮৭৫ সালে বারোক শিল্পরীতিতে তৈরি সেক্রেড হার্ট চার্চ, ১৮৬২ সালে নির্মিত চন্দননগর কলেজ, দুপ্লে কলেজ, এখন যার নাম কানাইলাল বিদ্যামন্দির, জি টি রোডের ধারে দৃশ্যমান লিবার্টি গেট ইত্যাদি।
বেলজিয়ান বা ফ্লেমিশ বণিকেরা এই অঞ্চলে ব্যবসা করতে আসে ১৭২০ সালের কাছাকাছি সময়ে। মোটামুটি জানা যায়, ১৭২৩ সাল নাগাদ তারা ভদ্রেশ্বর কুঠি নির্মাণের অনুমতি পায়। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা চলে যায় নদীর অন্য পারে বাঁকিবাজার অঞ্চলে। এখন যেখানে ‘ইছাপুর গান ফ্যাক্টরি’। তবে এই বিষয়ে দ্বিমত আছে। অন্য মতে, জার্মান বা প্রুশিয়ান বণিকেরা ওই সময়েই ব্যবসা করতে এসে প্রথমে ঘাঁটি গড়ে দিনেমার কুঠি– অর্থাৎ বর্তমানে গোন্দলপাড়ার দক্ষিণে। পরে প্রুশিয়ান ও অস্ট্রিয়ানদের মিলিত ‘অস্টেড কোম্পানি’ এইখানে কুঠি নির্মাণ করে। এদের উন্নতমানের বাণিজ্য ও সততার জন্যে অল্প সময়ের মধ্যে খ্যাতি এবং ব্যবসায় সুফল লাভ করে। তুলনায় ইংরেজ, ফরাসি, ডাচদের বাণিজ্য ছিল দুর্নীতিপূর্ণ, উৎপীড়নমূলক ও নিকৃষ্ট পণ্যনির্ভর। একই সঙ্গে সমান দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন তৎকালীন নবাব। নবাবের কাছে মিথ্যা অতিরঞ্জিত সংবাদের সাহায্যে ফরাসি ও ইংরেজ বণিকদের দল অস্টেড কোম্পানির বিরুদ্ধে লাগায়। আলিবর্দির আদেশে নায়েব ফৌজদার মীরজাফরের আক্রমণে তারা বিতাড়িত হয়। ভেঙে দেওয়া হয় তাদের দুর্গ। এদের কোনও চিহ্ন আজ অবশিষ্ট নেই। ১৭৩২-এ অস্টেড কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে প্রুশিয়ান বণিকেরা এককভাবে ১৭৪৪ পর্যন্ত বাঁকিবাজারে ব্যবসা চালানোর চেষ্টা করেছিল। প্রুশিয়ানরা চলে যাওয়ার পর ভদ্রেশ্বর অঞ্চলটি ইংরেজদের দখলে আসে। ভদ্রেশ্বর গঞ্জের খ্যাতি আগের মতো ইংরেজদের আমলেও ছিল। পুরনো স্মৃতি বলতে এখনও আছে গঞ্জের কয়েকটি গুদাম ও রেলের ভদ্রেশ্বর ঘাট স্টেশনের কাছে প্রাচীন বৃহৎ মাল নামানোর জেটি। প্রসঙ্গত ভদ্রেশ্বর স্টেশন থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে নদীর ধারে এই ভদ্রেশ্বর ঘাট সাইডিংটি তৈরি হয়েছিল পূর্ব রেল প্রতিষ্ঠার বছর খানেকের মধ্যে। অর্থাৎ ১৮৫৫ সালের কয়েক বছরের মধ্যেই।
(পরের পর্বে সমাপ্ত)
……………………………………………………………………………….
গঙ্গাপাড়ে ইউরোপাড়া প্রথম পর্ব: মোগল বনাম পর্তুগিজদের দেড় মাসের যুদ্ধে হুগলি পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে
দ্বিতীয় পর্ব: উদ্যানপ্রিয় হল্যান্ডবাসীদের থেকেই বাঙালিরা বাগান নির্মাণে উদ্যোগী হয়
……………………………………………………………………………….