১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫– প্রায় ৯০ বছর রাজত্ব করার পর ১৮৪৫-এর ২২ ফেব্রুয়ারি দিনেমাররা সাড়ে ১২ লক্ষ টাকায় শ্রীরামপুর শহরটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে স্বদেশে ফিরে যায়। দিনেমাররা চলে গেলেও নদীর তীরবর্তী তাদের তৈরি অট্টালিকাগুলি এখনও ডেনমার্কের কথা মনে করিয়ে দেয়। রিষড়ায় গ্রিক এবং কোন্নগরে আর্মেনীয় বণিকদের কুঠি নির্মাণের উল্লেখ থাকলেও ঠিক কোন সময়ে এবং কোথায় তাদের কুঠি ছিল, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত তাদের বাণিজ্যতরী কিছুদিনের জন্যে এইসব অঞ্চলে নোঙর ফেলে বাণিজ্য সেরে দেশের দিকে পাড়ি দিত। আবাস গড়লেও তা ছিল সাময়িক।
৪.
ডেনিসরা বাংলার অভ্যন্তরে প্রথম ব্যবসা করার অনুমতি পায় ১৬৭৬ সাল নাগাদ। হুগলিতে তারা একটি ছোট কুঠি তৈরি করে। সম্রাট ঔরঙ্গজেব পরের বছর তাদের স্থায়ীভাবে বাংলায় বাণিজ্য করার ফরমান দিলেও তারা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। ডেনমার্কের বণিকেরা এরপর কুঠির জন্যে বেছে নিয়েছিল চন্দননগরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের গোন্দলপাড়া অঞ্চলটি। আসলে বেছে নিয়েছিল বললে ভুল বলা হবে।
ফরাসিরা, পাশের দেশ ডেনমার্ককে হাতে রাখতে সৌজন্যবশত অঞ্চলটিতে দিনেমার বণিকদের কুঠি গড়তে অনুমতি দেয়। বেশ কয়েক বছর তারা সেখান থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ চালিয়ে যায়। যদিও খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। জায়গাটি এখনও ‘দিনেমারডাঙা’ নামেই পরিচিত। ছোট জায়গার জন্যই ১৭৫৫-তে নবাব আলীবর্দি খাঁর অনুমতি পেয়ে শেওড়াফুলির রাজা মনোহর রায়ের কাছ থেকে ৬০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে তারা চলে আসে শ্রীরামপুরে। প্রথমে আকনা ও পেয়ারাপুর গ্রাম দু’টি নেয়, পরে ১৭৫৯-এ মনোহরপুত্র রাজচন্দ্রের কাছ থেকে শ্রীপুর, গোপীনাথপুর ও মোহনপুর– গ্রাম তিনটি নিয়ে, মোট পাঁচটি গ্রাম বার্ষিক ১৬০১ টাকা খাজনায় নিজেদের বসতের ব্যবস্থা করে নেয়। নিজেদের রাজার নামে শহরের নাম রাখে ফ্রেডরিক নগর, ডাকনাম শ্রীরামপুর। ঘাট বাঁধানো, রাস্তা নির্মাণ, প্রশাসনিক বাড়িঘর প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ছাড়াও তারা কোন্নগরের কাছে হাতিরকুল নামক গ্রামে একটি পোতাশ্রয় নির্মাণ করে। শ্রীরামপুর অঞ্চলটি পছন্দ করার নেপথ্যে ডেনদের আরেকটা ভাবনা মাথায় ছিল। ডেনরা কৃষিপ্রিয় জাত। শ্রীরামপুরের পশ্চিমদিকে গ্রামাঞ্চল থাকায় কৃষির কথাও তারা চিন্তা করেছিল।
১৭৭৮ সালে ডেনিস কোম্পানির হাত থেকে শ্রীরামপুরের দায়িত্ব নেন ডেনমার্কের রাজা। ততদিনে শ্রীরামপুরে প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে আসেন কর্নেল ওলবি। ১৭৭৬ থেকে ১৮০৫ পর্যন্ত শ্রীরামপুরের প্রশাসক ছিলেন তিনি।তিনিই শ্রীরামপুরকে একটি ঐশ্বর্যমণ্ডিত সুন্দর নগরীর রূপে গড়ে তোলেন।
দিনেমারদের গভর্নরের আদি বাড়িটি কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ছিল শ্রীরামপুরের আদালত ভবন। এখন বাড়িটি হেরিটেজ ভবনের তকমা পেয়ে শ্রীরামপুরের ইতিহাস বিষয়ক স্থায়ী প্রদর্শন-গৃহের মর্যাদা পেয়েছে। শ্রীরামপুরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মার্শম্যান, ওয়ার্ড এবং উইলিয়াম কেরির নাম। ১৭৯৯-তে প্রথম শ্রীরামপুরে আসেন মার্শম্যান ও ওয়ার্ড, দুই মিশনারি।
আসলে ঠিক ওই সময় ব্রিটিশদের নিয়মে বাংলায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার ছিল নিষেধ; ফলে তাঁরা আশ্রয় নেন শ্রীরামপুরে দিনেমারদের নিকট। ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি এঁদের সঙ্গে যোগ দেন উইলিয়াম কেরি। এঁরাই ১৮০১-এ প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রীরামপুর মিশন প্রেস’। বাংলা মুদ্রণের সূচনাপর্বে এঁদের দান অনস্বীকার্য। মিশন প্রেসের প্রাথমিক কার্যালয় এবং পরের বাসভবনটি এখনও সযত্নে রক্ষিত। দিনেমারদের সমাধিক্ষেত্রেই দেখা
যায় এই তিন মিশনারির সমাধি।
আদালত ভবনের পাশেই ১৭৬১-তে নির্মিত ক্যাথলিক চার্চটি এখনও অতীত ইতিহাসের সাক্ষী। এই চার্চটি এখনও শ্রীরামপুরের অন্যতম ঐতিহ্য স্মারক। ১৮০১ থেকে ১৮০৬-এর মধ্যে নির্মিত চার্চটি ২০১১ সালে বিপজ্জনক সৌধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। চার্চটির এই অবস্থায় এগিয়ে আসে ডেনমার্কের ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম’। তাঁদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন, রাজ্য সরকার গির্জাটির সংরক্ষণ ও সংস্কার করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছে। গর্বের কথা, সংরক্ষণের জন্যে এশিয়া প্যাসিফিকের সেরা তিনটি ঐতিহ্যবাহী ভবনের মধ্যে অন্যতম হিসেবে ইউনেসকো হেরিটেজ অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত হয়েছে এই সেন্ট ওলাভস চার্চ। চন্দননগরের মতো শ্রীরামপুরেও নদীর তীরবর্তী দু’টি বিখ্যাত টেভার্নে-র উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তার অবস্থান সম্বন্ধে কিছু জানা যেত না। কিন্তু কয়েক বছর হল তাদের মধ্যে একটিকে নির্দিষ্ট করা যায়। এবং সেটিকে আদ্যন্ত সংস্কার করে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে।
১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫– প্রায় ৯০ বছর রাজত্ব করার পর ১৮৪৫-এর ২২ ফেব্রুয়ারি দিনেমাররা সাড়ে ১২ লক্ষ টাকায় শ্রীরামপুর শহরটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে স্বদেশে ফিরে যায়। দিনেমাররা চলে গেলেও নদীর তীরবর্তী তাদের তৈরি অট্টালিকাগুলি এখনও ডেনমার্কের কথা মনে করিয়ে দেয়। রিষড়ায় গ্রিক এবং কোন্নগরে আর্মেনীয় বণিকদের কুঠি নির্মাণের উল্লেখ থাকলেও ঠিক কোন সময়ে এবং কোথায় তাদের কুঠি ছিল, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত তাদের বাণিজ্যতরি কিছুদিনের জন্যে এইসব অঞ্চলে নোঙর ফেলে বাণিজ্য সেরে দেশের দিকে পাড়ি দিত। আবাস গড়লেও তা ছিল সাময়িক। কুঠি নির্মাণ বা দেশ দখলের উদ্দেশ্য তাদের ছিল না, যেমন ছিল বিশেষ করে কুচক্রী ইংরেজদের। একথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না, পর্তুগিজদের পরে একমাত্র ইংরেজরাই এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৃষিজ এবং অবশ্যই সামাজিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।
ইংরেজরা শাসক হওয়ার পর বাংলার শিল্পকে ধ্বংস করতে ছিল বদ্ধপরিকর। চেষ্টা শুরু করে দেশটাকে কাঁচামালের আড়তে পরিণত করতে। রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ১৭৯৫-’৯৬ সালে এখান থেকে নীল রপ্তানি হয়েছে ৬২,৫১,৪২৪ সিক্কা টাকার, চিনি গিয়েছে ৮,২০,১৮৬ সিক্কা টাকার। ১৮১৮ সালে ভারত থেকে তুলো গিয়েছে মোট ৫,২৮,৫২,৪০০ সিক্কা টাকার। ১৮৭২-’৭৩-এ পাট গিয়েছে ৭০,৬১,৯৫১ হন্দর পরিমাণ। তাদের বণিকবুদ্ধি বাংলার উর্বর ফসল ক্ষেতে খাদ্য ফসলের পরিবর্তে বাণিজ্য ফসল উৎপাদনে তৎপর হয়। তারা বুঝেছিল ধান, গম, আখের পরিবর্তে নীল, পাট ইত্যাদি বাণিজ্য ফসল ফলিয়ে অন্য দেশে রপ্তানি করতে পারলে মুনাফার অঙ্ক উত্তরোত্তর বাড়বে। ১৭৭২-এ জনৈক ইংরেজ প্রথমে চুঁচুড়ার তালডাঙায়, পরে গোন্দলপাড়ায় প্রথম ভ্যাট বানিয়ে নীল কুঠি-স্থাপন করেন। মাত্র বছর দশেকের মধ্যেই ১৭৮৩-তে বাংলা থেকে কেবল ইংল্যান্ডে নীল রপ্তানি হয়েছিল ১৩০০ মণ। ১৮০৪-’০৫ সালে পরিমাণ দাঁড়ায় ৬২ হাজার মণ। ধানী জমিতে নীল চাষের ফলে ওই জমিতে বেশ কয়েক বছরের জন্য অন্য কোনও চাষও করা যেত না। ইংরেজরাই একসময় হুগলিকে বলত বাংলার ‘চাবিকাঠি’। চন্দননগরে ধানের আড়ত দেখে ক্লাইভ বলেছিলেন, ভারতের শস্যাগার। এইসব ধীরে ধীরে নষ্ট হতে শুরু করে। জমির ক্ষতি ছাড়াও স্থানীয় ব্যক্তিদের সামান্য মাইনে-তে নীলকুঠিতে কাজ করতে বাধ্য করা হত। পাট চাষের ফলে বস্ত্রবয়নের পরিবর্তে কারিগরেরা চটের থলি নির্মাণে বাধ্য হত। বেনিয়া ইংরেজ রাজশক্তির লোভে অবলুপ্ত হয়ে গেল বাংলার বিশ্বখ্যাত তাঁত আর রেশম শিল্প, যাবতীয় কুটির শিল্প এবং লবণ শিল্প। তুলো ও রেশম চাষের পরিবর্তে জোর দেওয়া হত পাট চাষে। তাদেরই বদান্যতায় বস্ত্র রপ্তানির পরিবর্তে আমদানি হতে থাকে ম্যাঞ্চেস্টারি কাপড়। তাঁত বা পরে কাপড়ের কলের পরিবর্তে হুগলি জেলাতেই ১৮৫৫ থেকে কয়েক বছরের মধ্যেই গড়ে ওঠে ১৩টি পাটকল। ভারতের প্রথম পাটকলটি তৈরি হয়েছিল রিষড়ায়। রিষড়ার হেস্টিংস জুট মিলের মধ্যেই রয়েছে ‘হেস্টিংস হাউস’। ৬০ বিঘা জমির ওপর ওয়ারেন হেস্টিংস নির্মিত সুরম্য বাগানবাড়ি। এখনও খুঁজে পেতে পাওয়া যাবে নীলকুঠি ও তৎসংলগ্ন ভ্যাটগুলি। ঐতিহ্যশালী ভবনের পাশাপাশি এসবও তো সংরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। ঐতিহ্যের (!) এ-ও তো একটা দিক!
সুখের কথা, স্থানীয় ইতিহাস-সচেতন মানুষ, গবেষক, সরকার এবং ওইসব দেশের সরকার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাড়িঘর সংরক্ষণের জন্যে এগিয়ে আসছে। ১৯৯৬-র ডিসেম্বরে হল্যান্ড থেকে একদল পরিদর্শক চুঁচুড়া শহর দেখে গিয়ে তাদের সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছিল। চন্দননগরের ঐতিহ্যশালী ভবনগুলির জন্য ইতিমধ্যেই ফরাসি সরকার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এসবও যথেষ্ট নয়। এর জন্যে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকেও। অবিলম্বে প্রয়োজন প্রত্যেকটি প্রাচীন সৌধ, মন্দির-মসজিদ-গির্জা, সমাধিক্ষেত্র, বিদ্যায়তন এবং অবশ্যই হুগলি নদীর ঘাটগুলির গায়ে বিবরণ সম্বলিত ফলক লাগানো। ব্যান্ডেল-হুগলি থেকে কোন্নগর– এই ১৫ মাইলের মধ্যে একদা ১০ বিদেশি শক্তি এদেশে এসেছে বাণিজ্য করতে, তার মধ্যে আট দেশ কুঠি গড়েছিল। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এ এক অনন্য নজির। ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিকে সুসংহত করে গড়ে তোলা যায় পর্যটন শিল্প বিকাশের এক সম্ভাবনা, যা আকৃষ্ট করবে শুধু অনুসন্ধিৎসু দর্শক নয়, বিদেশি পর্যটকদেরও। বিদেশি পর্যটকেরা আসে, তবে তা অতি সামান্যই। এই নিবন্ধে সূত্রটুকু ধরিয়ে দেওয়া হল মাত্র। সরকারের উচিত বিষয়টি নিয়ে সুসংবদ্ধ একটি পর্যটনক্ষেত্র গড়ে তোলা।