কেন্দ্র সিএএ-এর বিধি প্রকাশ করে দিলে যে দেশজুড়ে ফের হইহই বাঁধবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। ভোটের মুখে কি বিজেপি সেই হইহইকে কাজে লাগিয়ে মেরুকরণ তীব্র করতে চায়? বাংলাতেও সিএএ-কে হাতিয়ার করে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশের আবেগ উসকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সিএএ চালু হলে রাজনৈতিক সংঘাত অবশ্যম্ভাবী।
লোকসভা ভোটের আগে কি আরও একবার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন তথা সিএএ-কে ঘিরে জ্বলে উঠবে দেশের কিছু অংশ? এমন প্রশ্ন সামনে আসছে সিএএ লাগু করা নিয়ে হঠাৎ কেন্দ্রীয় সরকার তৎপরতা শুরু করায়। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করার পর চার বছর অতিক্রান্ত হলেও যে আইনের বিধি তৈরি করা যায়নি, সেটাই হঠাৎ ভোটের মুখে চালু করতে চায় কেন্দ্র। সংসদে সিএএ পাশের পর অসম ও উত্তর-পূর্ব ভারত-সহ বেশ কিছু অঞ্চলে আগুন জ্বলতে দেখেছে দেশ। সেসময় বিক্ষোভের বাইরে রাজধানী দিল্লি, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, চেন্নাইয়ের মতো মেট্রো শহরগুলিও ছিল না। বিধি তৈরি অজুহাত মাত্র। আসলে যে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের চাপেই পিছু হটেছিল কেন্দ্র, তা বলাই বাহুল্য। ভোটের রাজনীতিই সম্ভবত আবার বিজেপিকে বাধ্য করছে সিএএ-কে সামনে নিয়ে আসতে।
সিএএ এমন একটি আইন, যেটি দেশের সংসদে পাস হওয়ার পর আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল আত্মা যদি হয় ধর্মনিরপেক্ষতা, তাহলে নিশ্চিত করেই সিএএ দেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করছে। ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব যে কোনও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এক অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার। ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা বলতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বোঝায়, রাষ্ট্র সব ধর্ম থেকে দূরে থাকবে। যদিও ভারতে এর অহরহ ব্যতিক্রম আমরা দেখে থাকি। জনগণের করের টাকায় যত্রতত্র মন্দির বা ধর্মীয় স্থান তৈরি হওয়া এদেশে জলভাত। কিন্তু সিএএ-তে যেরকম নগ্নভাবে ধর্মের পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি বলা হয়েছে, তা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে বসে কল্পনা করা যায় না। এই আইন হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, ভারতে কি এরপর মুসলিমরা নাগরিকত্ব খোয়ানোর পথে হাঁটবে? গোটা বিশ্ব একসুরে এই আইনকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে দেয়। যে দলে ভারতের চিরাচরিত বন্ধু রাষ্ট্রগুলিও ছিল। বিদেশ মন্ত্রককে রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রগুলিকে চুপ করাতে হয়েছিল।
সিএএ-তে বলা হয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, শিখ ও খ্রিস্টানরাই একমাত্র ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে পারে। অর্থাৎ, এই তিন দেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ভারতে আসা মুসলিমরা নাগরিকত্বের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এইভাবে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা কোনও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে কি? কেন্দ্রের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নিজেদের মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছে, তাই ভারত সরকার সেদেশের সংখ্যালঘুদের উপর ধর্মীয় নিপীড়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন। এর সঙ্গেই প্রশ্ন উঠেছে, শ্রীলঙ্কায় তামিল হিন্দুরা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার, চিনে তিব্বতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ নিপীড়নের শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী, মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তাহলে এই তিন দেশের সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেও কেন সিএএ কার্যকর হবে না? অমুসলিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি সম্পর্কে কি তাহলে ভারতের নীতি ভিন্ন? পাকিস্তানে হাজারা ও আহমেদিয়া মুসলিমরাও ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার। তারা ভারতে আশ্রয় নিলে কেন নাগরিকত্ব পাবে না?
সিএএ লাগু হলে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা নাগরিকত্ব পেতে শুরু করলে ওই এলাকাগুলি বাঙালি অধ্যূষিত হয়ে পড়বে বলে আতঙ্কিত অসম ও উত্তর-পূর্বের অন্যান্য জনগোষ্ঠীগুলি। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে রক্ষার আবেগ নিয়ে অসম ও উত্তর-পূর্বের মানুষ সিএএ বিরোধী আন্দোলন করেছিল। কেন্দ্র লোকসভা ভোটের মুখে বিধি চূড়ান্ত করে সিএএ লাগু করতে তৎপর হওয়ায় ফের অসমে আসুর মতো সংগঠন আন্দোলনে নামার হুমকি দিতে শুরু করেছে। বাংলা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, ঝাড়খণ্ড সহ অবিজেপি রাজ্যগুলি আগেই ঘোষণা করেছিল, তারা সিএএ মানবে না। ফলে কেন্দ্র সিএএ-এর বিধি প্রকাশ করে দিলে যে দেশজুড়ে ফের হইহই বাঁধবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। ভোটের মুখে কি বিজেপি সেই হইহইকে কাজে লাগিয়ে মেরুকরণ তীব্র করতে চায়? বাংলাতেও সিএএ-কে হাতিয়ার করে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশের আবেগ উসকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সিএএ চালু হলে রাজনৈতিক সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, সিএএ লাগু করার জন্য পোর্টাল তৈরি। এই পোর্টালে গিয়ে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী ছ’টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ আবেদন করলেই নাগরিকত্ব পাবেন। জেলাশাসকের দপ্তরে প্রামাণ্য নথি নিয়ে দৌড়দৌড়ির প্রয়োজন হবে না। পাঁচ বছরের বেশি ভারতে বাস করলেই পোর্টালে আবেদনের সুযোগ মিলবে। পোর্টালে আবেদন হলে সিএএ ঠেকানোর ক্ষেত্রে রাজ্যের কোনও ভূমিকা কি আদৌ থাকবে? নথি যাচাই ছাড়া এভাবে কি আদৌ নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব হবে? ক্রমশ ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে এইসব প্রশ্নকে ঘিরে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুুন: কিন্তু সেদিন সিংহটা রুখে দাঁড়ায়নি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
চারবছর আগের মতো যদি সিএএ বিরোধী আন্দোলনে দেশ উত্তাল হয়ে যায়, তাহলে কী হবে? অসমে ও ত্রিপুরায় বিজেপির সরকার। তারা কি আগুন নিয়ে খেলতে চাইবে? উত্তর-পূর্বের ২৫টি লোকসভা আসনের সিংহভাগ বিজেপির নিশানায়। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, শেষপর্যন্ত কি বিজেপি ভোটের মুখে সিএএ-এর বিধি প্রকাশের রাজনৈতিক ঝুঁকি নেবে? নাকি সিএএ-এর খুড়োর কল সামনে রেখে আরও একটি ভোট পার করাই বিজেপির লক্ষ্য? উত্তরের জন্য আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহূর্তে বিকল্প কিছু নেই।