চলতি বছরে হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে সরকার জানিয়েছে, ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার ৭৮ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। তাই সেদিন থেকে হরিয়ানার সমস্ত স্কুলে শিক্ষকদের উদ্দেশ্য করে আর ‘সুপ্রভাত’ কিংবা ‘গুড মর্নিং’ বলতে পারবে না পড়ুয়ারা। বলতে হবে ‘জয় হিন্দ’। তাতে নাকি শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ গড়ে উঠবে! তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী হবে। জানবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াই ও আত্মত্যাগের কথা। কীভাবে জানবে, তা নিয়ে কিছু বলা নেই স্কুল শিক্ষা দপ্তরের নির্দেশিকায়। অর্থাৎ, বইপত্রের জোগান, কর্মশালার আয়োজন ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁরা নীরব। জোর দেওয়া হচ্ছে শুধু ‘জয় হিন্দ’ সম্ভাষণেই।
কোনও রাজ্যে বা দেশে ভোট আসছে বুঝবেন কী করে? যখন দেখবেন, সরকার বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘অস্বাভাবিক’ আচরণ করছেন।
কী রকম? যেমন, যাঁদের ভোট মিটতেই টিকি দেখা যেত না, তাঁরা যখন ঘনঘন ছুতোয়-নাতায় এলাকায় ‘হাজিরা’ দেন। রক্তদান শিবির তো বটেই, পারলে চলে আসেন জন্মদিন-অন্নপ্রাশনেও। দ্বিতীয়ত, কোনও সাহায্য চাইতে গেলে আগে মুখ ঝামটা শুনতে হত, দূর দূর করে ভাগিয়ে দিত চামচারা। ভোট এলেই অযাচিতভাবে তাঁরা উপুড় হস্ত হয়ে, সাহায্যের ঝুলি হাতে ছুটে আসেন। তিন, চেগে উঠে উত্তেজক ভাষণ দেওয়া। কোনও ভাবে প্রচারের আলোয় থাকার চেষ্টা। যাতে টিকিট পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া না হয়। শীর্ষ নেতৃত্বের নজর পড়ে।
আরও একটা লক্ষণ আছে। হঠাৎ দেশপ্রেম উথলে ওঠা। জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগে উসকানি দিয়ে প্রমাণ করতে চাওয়া, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য তাঁরা কতটা চিন্তিত! সহ-নাগরিকদের ভালো-মন্দের কথা ভেবে তাঁদের রাতের ঘুম ‘হারাম’ হয়ে গিয়েছে। সেই দেশপ্রেম দেখানোর জন্য কখনও বিষোদ্গার করতে হয় প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে, কখনও সেনাবাহিনীর সাফল্যে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠতে হয়, কখনও বা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অহেতুক কদর্য আক্রমণ করে প্রমাণ করতে হয়, তাঁরা কতটা দেশপ্রেমিক। আর থাকে কিছু উদ্ভট পদক্ষেপ, চিন্তাভাবনা। কখনও ট্রেনে-বাসে, সিনেমা হলে বাজতে থাকবে জাতীয় সংগীত। কখনও ‘নির্দেশ’ আসবে, প্রতি বাড়িতে টাঙাতে হবে জাতীয় পতাকা। দেশপ্রেম কি এভাবে লোক দেখিয়ে জানাতে হবে? যাঁরা তা করবেন না, তাঁরা দেশপ্রেমিক নন? স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান, দেশাত্মবোধক গান, তেরঙ্গা পতাকা হাতে মিছিল দরকার ছিল। এখনও সাধারণতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসে এ-ধরনের অনুষ্ঠান হয়েই থাকে। কিন্তু শয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু দেশ-দেশ করলেই হবে? কাজেও তো কিছু করে দেখাতে হবে। গঠনমূলক, ইতিবাচক কাজ। যাতে দেশের মানুষের উপকার হয়। দেশ সমৃদ্ধ হয়। তা না করে শুধু পতাকা নাড়িয়ে ‘জনগণমন’ আর ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ গেয়ে দিন কাটালে আর দেখতে হবে না। জনসংখ্যা দেখতে দেখতে ১৪০ কোটি থেকে ২৮০ কোটি হয়ে যাবে। কিন্তু ভারত যে তিমিরে ছিল, সেখানেই থেকে যাবে।
এত গৌরচন্দ্রিকা করার দরকার হল কেন? কারণ, হরিয়ানা সরকারের এক ‘অভিনব’ নির্দেশ। চলতি বছরেই সেখানে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে সরকার জানিয়েছে, ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার ৭৮ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। তাই সেদিন থেকে হরিয়ানার সমস্ত স্কুলে শিক্ষকদের উদ্দেশ্য করে আর ‘সুপ্রভাত’ কিংবা ‘গুড মর্নিং’ বলতে পারবে না পড়ুয়ারা। বলতে হবে ‘জয় হিন্দ’। তাতে নাকি শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ গড়ে উঠবে! তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী হবে। জানবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াই ও আত্মত্যাগের কথা। কীভাবে জানবে, তা নিয়ে কিছু বলা নেই স্কুল শিক্ষা দপ্তরের নির্দেশিকায়। অর্থাৎ, বইপত্রের জোগান, কর্মশালার আয়োজন ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁরা নীরব। জোর দেওয়া হচ্ছে শুধু ‘জয় হিন্দ’ সম্ভাষণেই।
……………………………………………
এখনও সাধারণতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসে এ-ধরনের অনুষ্ঠান হয়েই থাকে। কিন্তু শয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু দেশ-দেশ করলেই হবে? কাজেও তো কিছু করে দেখাতে হবে। গঠনমূলক, ইতিবাচক কাজ। যাতে দেশের মানুষের উপকার হয়। দেশ সমৃদ্ধ হয়। তা না করে শুধু পতাকা নাড়িয়ে ‘জনগণমন’ আর ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ গেয়ে দিন কাটালে আর দেখতে হবে না।
……………………………………………..
আপাতদৃষ্টিতে এতে অনেকেই হয়তো আপত্তি করবেন না। কারণ, ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান হয়ে উঠেছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। এখনও সেনা-সমাবেশে, দেশাত্মবোধক অনুষ্ঠানে এই স্লোগান ওঠে মুহুর্মুহু। আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর আবিদ হাসান ‘জয় হিন্দুস্তান কি’ স্লোগান ছোট করে এই নয়া স্লোগান চালু করেন। এবং দ্রুত তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আবালবৃদ্ধবনিতার মনে। কিন্তু সমাজে থাকার পূর্বশর্ত হিসাবে দেশপ্রেমকে দেখানোর চেষ্টা করা কি সঙ্গত? আমি কাউকে ভালোবাসি। সেটা কীভাবে প্রকাশ করব, সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিষয়। লোক দেখিয়ে, ঘটা করে প্রকাশ্যে প্রেম নিবেদন যেমন সবসময় সত্যি হয় না, তেমনই প্রকাশ্যে দেশপ্রেমের প্রদর্শন আদৌ আন্তরিক কি না, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? গান্ধী টুপি পরে দেশের নেতারা জনগণকে কম ‘টুপি’ পরাননি। তাঁরা নাকি গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত!
সমস্যাটা স্লোগানের নয়, তাকে সামনে রেখে মেকি দেশপ্রেমের বাহ্যিক প্রদর্শন এবং জোরজবরদস্তিতে। যেমন, জাতীয় সংগীত বাজলে দাঁড়াতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সেটাই যদি বাধ্যতামূলক হয়, তাতে সমস্যা হতে পারে। বিভিন্ন সিনেমা হলে ছবি শুরুর আগে জাতীয় সংগীতের সময় দাঁড়াতে অপারগ বিশেষভাবে সক্ষমদের ওপর হামলা হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত কম নেই। এমন প্রত্যাশা কার্যত ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ। যাঁরা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে দেশপ্রেমের ধ্বজা ওড়ান, হলফ করে বলা যায় যে, তাঁদের অনেকেই জাতীয় পতাকার বিভিন্ন রং ও চক্রের অর্থ, তাৎপর্য, পতাকা উত্তোলনের নিয়ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। ছোট থেকে শিখিয়ে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনী পড়িয়ে, ঐতিহাসিক নানা ঘটনা ব্যাখ্যা করে দেশাত্মবোধ তৈরি করতে হয়। সর্বোপরি, শিশুদের সামনে দেশের প্রতি আবেগ ও শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। দেশের সাফল্যে গর্বিত হলে সেটাই অনুসরণ করবে শিশুরা। আমাদের আদর্শ নাগরিক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যা একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। অথচ, এখন দেশের সামনে আদর্শ নেতা-ব্যক্তিত্বের বড়ই অভাব। দুর্নীতি, দূষণে জর্জরিত সমাজ। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ শিখবে কী করে? শুধুই স্লোগান দিয়ে? জোর করে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও? এমন অবাস্তব ভাবনা যে সরকারের মাথায় আসে, তাদের বোধ-বুদ্ধি নিয়েও সংশয় জাগতে বাধ্য।
………………………………………………………
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: রক্তদানেও ‘আমরা-ওরা’ মানসিকতা অসহিষ্ণুতার বার্তা বয়ে আনছে
………………………………………………………
উত্তর, মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে ‘জয় সিয়ারাম’, ‘রাম রাম’ সম্ভাষণের সহজ উপায়। কাউকে স্বাগত বা বিদায় জানাতে ব্যবহার হয়। কালের নিয়মে যা কিছুটা বদলে ‘জয় শ্রী রাম’ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দক্ষিণপন্থী সংগঠন। রাম, রামলালা বহু মানুষের পূজ্য, উপাস্য। অথচ সংকীর্ণ স্বার্থে সেই রামের নামে, ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে সংখ্যালঘুদের আক্রমণ, খুন, ধর্ষণ করতে অনেকে দ্বিধা করেনি। ওই স্লোগান আর উগ্র হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ এখন সমার্থক। ‘জয় হিন্দ’-এর মতো স্লোগানও ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহৃত হলে তার গুরুত্ব, তাৎপর্য হারাবে। দেশাত্মবোধের জিগির তুলে শেষ পর্যন্ত তা সামাল দেওয়া যাবে কি না, সেটাও ভেবে নেওয়া দরকার।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………