সম্প্রতি দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে মাছের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ করতে প্রায় ‘হুমকি’ দিয়েছেন একদল হিন্দুত্ববাদী। কেন? কারণ পাশেই রয়েছে একটি মন্দির। এবং সেই মন্দিরে আসা লোকজনের নাকি এই মাছ বিক্রির কারণে ভাবাবেগে আঘাত লাগছে। ভাবাবেগ অতি বিষম বস্তু! গত কয়েক বছরে এই মুহুর্মুহু আঘাতের ছড়াছড়ি দেখা গিয়েছে। যদিও মেছো বাঙালির তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু খাদ্যাভাসের ওপর ক্রমাগত ছড়ি ঘোরানোর যে রীতি হিন্দুত্ববাদীদের, তা বাঙালির মাছপ্রীতিকে কোনওভাবে আঘাত করলে, তার ফল বোধহয় সুখকর হবে না।
দিল্লিতে সরকার বদল হয়েছে। বহুদিন পর, আম আদমি দলের সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। সেই দিল্লিরই অন্যতম একটি অঞ্চলের নাম চিত্তরঞ্জন পার্ক। সেখানে মূলত বাঙালিরা থাকেন। নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি নয়, উচ্চবিত্ত বাঙালিরাই সেখানে বসবাস করেন অনেক দিন হল। যেখানে বাঙালিরা থাকবেন, সেখানে যে গড়ে উঠবে মাছের বাজার, এ আর আশ্চর্যের কী! চিত্তরঞ্জন পার্কেও তার ব্যত্যয় হয়নি। সম্প্রতি সেই চিত্তরঞ্জন পার্কের মাছের বাজারের একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন তৃণমূলের সাংসদ মহুয়া মৈত্র এবং তা থেকেই এক বিতর্কের সূত্রপাত। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কিছু মানুষ এসে ওই মাছের বাজারের ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছে এই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে! বলা হচ্ছে, যেহেতু ওই বাজারের পাশেই একটা মন্দির আছে এবং সেই মন্দির যাঁরা আসেন তাঁদের ভাবাবেগে আঘাত লাগছে। ঘটনাচক্রে এই মন্দিরটি বানিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ীরাই।
বেশ কিছুদিন ধরে, ‘বাংলাদেশী’ বলে বাংলাভাষী গরিব মুসলমান মানুষকে আক্রমণ করা শুরু হয়েছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে বিজেপির বহু নেতা-মন্ত্রী– নানা সময়ে বাঙালির খাদ্যাভাস নিয়ে কথা বলেছে এবং হেয় করেছেন। বিশিষ্ট অভিনেতা পরেশ রাওয়াল অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর প্রতিবেশী এক বাঙালি মাছ খান বলে তাঁর অসুবিধা হয়। পরে অবশ্য তিনি বলেন যে, কারও খাদ্যাভাস নিয়ে এই বিরূপ মন্তব্য তিনি করেননি, কিন্তু এই বিতর্ক বহুদিনের। কেন্দ্রে বিজেপি এবং বিভিন্ন রাজ্যে এই সনাতনী সাজা হিন্দুত্ববাদীরা বাঙালির খাদ্যাভাস নিয়ে কথা বলেছে, কার ফ্রিজে কী মাংস আছে– তা খতিয়ে দেখে পিটিয়ে মেরেছে। সুতরাং আজকে যে বাঙালির মাছ খাওয়া নিয়ে বিতর্ক হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ‘দেখে শুনে চেয়ে খাও, যেটা চায় রসনা, তা না হলে কলা খাও– চটো কেন বসো না–’ তাঁর কথাগুলো বাঙালি জীবনের একেবারে সঠিক রূপায়ণ। বাঙালিরা খাবারের সঙ্গে আবেগকে যুক্ত করে, তা তুলে ধরে সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই। বাঙালিদের কাছে খাবার শুধু বেঁচে থাকার হাতিয়ার নয়; তাঁদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যও বটে।
মুঘল, পারস্য এবং তুর্কি যুগের আগেও, বাংলার রন্ধনপ্রণালীতে দেশীয় স্বাদের অনুরণন ছিল এবং এখনও একই অবস্থা। তখন থেকে, বাংলার রন্ধনপ্রণালী তার ঊর্বর মাটি এবং প্রচুর নদীর দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। যদিও বাংলার ঊর্বর জমি ধান চাষের জন্য বেশি উপযুক্ত ছিল, তবুও মিঠা পানির প্রাচুর্যপূর্ণ নদীর জটিল প্রণালী মাছকে তাদের খাদ্যতালিকার একটি প্রিয় অংশ করে তুলেছিল।
বাঙালির খাদ্যতালিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাছ সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। মাছের দেখা পাওয়াকে একটি শুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হত, যা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান এবং আচার-অনুষ্ঠানে স্থান করে নেয়।
এটি কেবল বাঙালির থালায় একটি খাবার নয়; বরং এটি একটি সম্মানিত ঐতিহ্য। বিশেষ করে, বিবাহ-পূর্ব উদযাপনের সময়, মাছের বিভিন্ন পদের এক বিশাল সমাহার ভোজের টেবিলে শোভা পায়। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের একটি অংশ, মনোরম রীতি, তত্ত্ব থেকে একটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে সজ্জিত রুই মাছকে কেন্দ্রবিন্দুতে দেখা যায়, যা ভাগ্য এবং সুখে ভরা ভবিষ্যতের জন্য সম্মিলিত আশার প্রতীক। এমনকী, যখন একজন কনে তাঁর নতুন বাড়িতে প্রবেশ করে, তখনও বাঙালি সংস্কৃতিতে মাছকে আনন্দময় এবং পরিপূর্ণ বিবাহিত জীবনের জন্য একটি হৃদয়গ্রাহী আশীর্বাদ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আসুন, একটু পিছিয়ে যাই এবং বিবাহ-পূর্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে কথা বলি, যেখানে ‘আইবুড়োভাত’ ভোজের আসরে প্রধান ভূমিকা পালন করে অন্তত একটি মাছের পদ। এখানে, অবিবাহিত দম্পতিদের জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে আপ্যায়ন করা হয় এবং এই ভোজের কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই মাছ থাকে। যদিও এই অনুষ্ঠানটি মহিলা বা পুরুষদের প্রাক-বিবাহ যৌন সম্পর্কের শংসাপত্র ছাড়া কিছু নয়, কিন্তু তাও তার বদলে ওই অনুষ্ঠানের খাবার বা সঠিক অর্থে সেখানে মাছকে খাদ্য হিসেবে দেখানোটাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
ইলিশ মাছ বাঙালি সংস্কৃতিতে সবসময়ই একটি বিশেষ স্থানাধিকার করে আছে। পশ্চিমবঙ্গের ‘রাজ্য মাছ’ হিসেবেও বিবেচিত হয় ইলিশ। এখানে প্রতীকী ইলিশকে গর্বের প্রতীক এবং রন্ধন সম্পর্কীয় সম্পদ হিসেবে দেখা হয়। ইলিশ-চিংড়ি নিয়ে ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের বিতর্কও বহুদিনের। বিভিন্ন চলচ্চিত্রেও রান্না করা মাছের মাথার দৃশ্য দেখা গিয়েছে তবে ভবিষ্যতে যাবে কি না, তা বলা মুশকিল, কারণ যদি আগামিদিনে বিজেপি বাংলায় ক্ষমতা দখল করে, তাহলে খাদ্যাভাসের ওপর আক্রমণ যে বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
মাছের বাজারে যাওয়া বাঙালিদের জন্য নিত্যদিনের ব্যাপার। বাজারের কথোপকথন, সেরা মাছের দরাদরি এবং মাছের সহজলভ্যতা নিয়ে আলোচনাই বাঙালির বৈশিষ্ট্য। এই বাজারি আড্ডা মানুষে মানুষে তৈরি করে বন্ধন। এই বাজারগুলো এমন একটি জায়গা হতে পারে যেখানে বাড়ির বয়স্ক মানুষেরা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে মাছ চেনান, খাদ্যগুণ সম্পর্কে জানান। এই বাজারগুলোই বাঙালিদের আত্মীয়তার জায়গা। এমনকী, যখন বাঙালিরা তাঁদের জন্মস্থান থেকে দূরে থাকেন, তখনও তাঁরা ঐতিহ্যবাহী রন্ধনসম্পর্কীয় সংস্কৃতি অনুসরণ করে। মাছ কেবল বাঙালিদের খাবার নয়; এটি তাদের শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটি উপায় এবং তাঁদের সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করে, এমন ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি।
প্রতিটি মাছের পদ আসলে অতীত দিয়ে বর্তমানকে সমৃদ্ধ করার কৌশল। বাঙালির প্রাণবন্ত সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর অন্যতম উপায়। তাই, পরের বার যখন মাছ খাবেন, মনে রাখবেন যে, আপনি কেবল একটি খাবার উপভোগ করছেন না; আপনি বাঙালি জীবনের এক টুকরো অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন, যেখানে খাবারই ভালোবাসা এবং ভালোবাসাই খাবার।
সেই খাবারে যদি হাত পড়ে, বাঙালিও কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে রুখে দাঁড়াবে। দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে যাঁরা থাকেন, তাঁরা প্রাথমিকভাবে কিছু না বললেও, আগামিদিনে তাঁরা সমস্ত বিভেদ ভুলে যে ওই মাছের ওপর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায়। সুতরাং, যে-বাঙালির মূল মন্ত্র হচ্ছে ‘ধরিব মাছ খাইব সুখে’ সেই বাঙালিকে হিন্দুত্ববাদী শক্তি যত চেষ্টাই করুক মাছ খাওয়া বন্ধ করাতে পারবে না। দিল্লির এই ঘটনা কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জন্যও একটা সতর্কবার্তা। যতই ‘হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই’ জাতীয় স্লোগান দেওয়া হোক, মাছে-ভাতে বাঙালি কিন্তু এই একটা বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকবে, তা নিশ্চিত।