হিমালয়ের গহীনে আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিক অবশেষে উদ্ধার হলেন। বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আনা হয়েছিল। যন্ত্রও। তাতে সর্বশেষ সফটওয়্যারও ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি। কোনও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়, কোনও স্বয়ংক্রিয় যান নয়, মানুষকেই খুঁড়ে বের করতে হয়েছে তার সহযোগী ও সহযোদ্ধাদের।
মানুষই যে শেষ কথা বলে এখনও, সেটা এভাবেই মাঝে মাঝে আমাদের ঝাঁকুনি দিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ গত কয়েক বছরে এআই নিয়ে এত হইচই, যে, মনে হয়, মানুষের আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্লেষণ করছে, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর কোড করছে, ছবি আঁকছে, কবিতা লিখছে। কবিতাগুলো অবশ্য অখাদ্য হচ্ছে, কিন্তু প্রথম-প্রথম ওরকম একটু হবেই। একটু রবিঠাকুর ‘সহজ পাঠ’ আর নীরেন চক্কোত্তির ‘কবিতার ক্লাস’ পড়িয়ে দিলেই হবে। আর সঙ্গে যদি স্রেফ দুটো হাত আর পা লাগিয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই নিজেই কলম বাগিয়ে লিখবে, প্লেনে উঠে পাইলট হবে, খনি খুঁড়ে সোনা বের করবে, এমনকী, বলা যায় না, প্রেমিক হয়ে আদরও করে দিতে পারে।
এ অবশ্য নতুন কিছু না। মাঝেমাঝেই এরকম হুজুগ ওঠে। বছর বিশেক আগে এরকম গল্প শোনা গিয়েছিল জিন নিয়ে। মানুষের সমস্ত গোপন রহস্য নাকি লুকিয়ে আছে জিনের গহনে, একবার সেই সংকেত পড়ে ফেলতে পারলেই মানুষের ফর্দাফাঁই। জিন তো নয়, যেন মাইক্রোচিপ। হার্টের ব্যামো? স্রেফ জিনে ঢুকে সংকেতের এক লাইন বদলে দিলেই হবে। গায়ের রং পছন্দ না? আসুন জিন, একটু এডিট করে দিই। মোট কথা আর প্রকৃতি নির্ভরতা নয়, ডিজাইনার মানুষ বানানোর সব রহস্য জিনের ভিতরে, এই নিয়ে কোটি-কোটি ডলার খরচ, জনপ্রিয় পত্রিকায় দিস্তে দিস্তে লেখা।
এ-ও প্রথমবার না। পৃথিবীতে বৃহদায়তন অটোমেশনের পথিকৃত হেনরি ফোর্ড যখন জেনারাল মোটর্সের কারখানায় সেই বিখ্যাত অ্যাসেম্বলি লাইন বানাচ্ছিলেন, তখন পণ্ডিতরা মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রায় একই রকম মত প্রকাশ করেছিলেন। অচিরেই এমন দিন আসবে, পুরো প্রক্রিয়াটাই এমন স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাবে, যে, মানুষ স্রেফ হয়ে যাবে স্রেফ বাড়তি, অপ্রয়োজনীয়, এই ছিল চিন্তার লাইন। এরও প্রায় শ’খানেক বছর আগে, শিল্পবিপ্লবের গোড়ার দিকে মেরি শেলি লিখছেন, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, যেখানে যন্ত্র-যন্ত্রীর ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, ছিনিয়ে নিচ্ছে আধিপত্য, দখল করছে সবকিছু।
মোদ্দা কথা, অন্তত ২০০ বছর ধরে, শিল্পবিপ্লবের গোড়ার দিন থেকে মানুষের মৃত্যুঘণ্টা বাজানো চলছে। তাতে বিশেষ কিছু এসে যায়নি। যখন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন লেখা হচ্ছে, অথবা জন হেনরির করুণ লোকগাথা, আসলে তার কয়েক দশকের মধ্যেই লন্ডনের কোনও এককোণে বসে এঙ্গেলস লিখছেন ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা। লেখা হচ্ছে কমিউনিস্ট ইশতাহার। ফোর্ড যখন কারখানায় অটোমেশন চালু করছেন, তা ক্রমশ জন্ম দিচ্ছে বিশাল এক সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়নের। জ্যাক লন্ডন ততদিনে গল্পই লিখে ফেলেছেন, এই বিপুল ট্রেড ইউনিয়নের জাল কী করে পুঁজিপতিদের নাকানিচোবানি খাইয়ে ক্ষমতা দখল করে ফেলল। তারপর অটোমেশন থামেনি, বেড়েছে, ট্রেড ইউনিয়ন বেড়েছে-কমেছে, কিন্তু মানুষ স্বয়ংক্রিয়তার দাসে পরিণত হয়নি।
জিন নিয়েও একই গল্প। জিন গবেষণা মানুষের প্রচুর কাজে লাগছে এবং লাগবে। কিন্তু জিন জেনে ফেলে মানুষের চাবিকাঠির দখল নিয়ে নেওয়া যাবে, এই শিশুসুলভ দাবি জনপ্রিয় লেখকরা আর করেন না। হুজুগটা চলে গেছে। কিন্তু এই সিরিজের সর্বশেষ যে শিশুটি এখন হইচই ফেলে দিয়েছে, সে এখনও আছে, তার নাম ‘এআই’। সে ফোনে ঢুকে কথোপকথন চালায়, সে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালাচ্ছে রাস্তায়। এই প্রযুক্তিরও উন্নতি হবে, এবং হয়েই চলবে, মানবকল্যাণেরই কাজে লাগবে, আন্দাজ করা যায়। কিন্তু মানুষের দখলদারি নেওয়ার মতো জায়গায় সে এখনও পৌঁছয়নি। জটিল অভাবনীয় পরিস্থিতি, অকল্পনীয় অবস্থা, যেখানে উদ্ভাবন প্রয়োজন হয়, সেখানে স্বয়ংক্রিয়তা, তার বুদ্ধিমত্তা নিয়েও এখনও ডাহা ফেল! এখনও সেখানে মানুষকেই লাগে। এখনও ডাক পড়ে জন হেনরির, লাগে তার বুদ্ধি ও পেশিশক্তি।হিমালয়ের উদ্ধারকার্য নিশ্চিত করেই দেখিয়ে দেয়, যে কথা অনেক দিন ধরে চমস্কি বলে আসছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বয়ংক্রিয়তা একটি কৃত্রিম জিনিস, মানুষের বিকল্প না।