কলকাতায় ‘দ্য ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ ইন্ডিয়া’-র সিএ ছাত্রছাত্রীদের জন্য আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ‘BAPS’-এর স্বামী নারায়ণ মন্দিরের স্বামী জ্ঞানবৎসল আমন্ত্রিত ছিলেন প্রধান বক্তা হিসেবে। সেখানেই তাঁর ‘দাবি’– মেয়েদের সরিয়ে দিতে হবে তাঁর চোখের সামনে থেকে। বাধ্য হয়ে মেয়েদের প্রথম পাঁচটি সারণি ছেড়ে বসতে বলা হয়। এমন ফতোয়া জারি হওয়ায় মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদেরও কার্যত বসতে হল হলের পিছনে। অবাক হতে হয়, এরপরও তিনি ‘বিকশিত ভারত’ নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন!
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘একটি রাষ্ট্রের অগ্রগতি জানার সবচেয়ে ভাল উপায় হল সেই রাষ্ট্রে নারীর অবস্থান।’ আরেক স্বামীজির কাছে নারীরা দু’চোখের বিষ। তাঁর মননে নারীদের অবস্থান পিছনের সারিতে। পুরুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই কলকাতায় জ্ঞানবর্ষণ করতে এসে স্বামী জ্ঞানবৎসল সমস্ত ছাত্রী ও মহিলা অতিথি, শিক্ষিকা এবং বিশেষজ্ঞদের প্রথম পাঁচটি সারণি থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন! বাদ যাননি স্টেজে উপস্থিত মহিলা স্বেচ্ছাসেবক এবং আয়োজকরাও। এটাই তাঁর ‘প্রোটোকল’! কারণ বিশ্বখ্যাত ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’-এর ‘ব্রহ্মচর্য’ বিঘ্নিত হচ্ছিল। তিনি এলেন, জ্ঞান দিলেন, কিন্তু মন জয় করতে পারলেন না।
কলকাতায় ‘দ্য ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ ইন্ডিয়া’-র সিএ ছাত্রছাত্রীদের জন্য আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ‘BAPS’-এর স্বামী নারায়ণ মন্দিরের স্বামী জ্ঞানবৎসল আমন্ত্রিত ছিলেন প্রধান বক্তা হিসেবে। সেখানেই তাঁর ‘দাবি’– মেয়েদের সরিয়ে দিতে হবে তাঁর চোখের সামনে থেকে। বাধ্য হয়ে মেয়েদের প্রথম পাঁচটি সারণি ছেড়ে বসতে বলা হয়। এমন ফতোয়া জারি হওয়ায় মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদেরও কার্যত বসতে হল হলের পিছনে। অবাক হতে হয়, এরপরও তিনি ‘বিকশিত ভারত’ নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন!
……………………………………………………………………………………………………………..
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনও সাধুসন্তকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলই বা কেন? এটা তো কোনও ধর্মীয় সভা নয়! যে সংস্থা সিএ হিসেবে মেয়েদের এগিয়ে আসা নিয়ে গর্ব করে, সেই প্রতিষ্ঠানে মহিলাদেরই এমন অবমাননা! প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট রঞ্জিৎকুমার আগরওয়ালও মহিলাদের সিএ পদে অগ্রগতি নিয়ে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেন এদিন।
……………………………………………………………………………………………………………….
প্রশ্ন হল, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনও সাধুসন্তকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলই বা কেন? এটা তো কোনও ধর্মীয় সভা নয়! যে সংস্থা সিএ হিসেবে মেয়েদের এগিয়ে আসা নিয়ে গর্ব করে, সেই প্রতিষ্ঠানে মহিলাদেরই এমন অবমাননা! প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট রঞ্জিৎকুমার আগরওয়ালও মহিলাদের সিএ পদে অগ্রগতি নিয়ে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেন এদিন। প্রতি তিনজনের একজন এখন মহিলা সিএ। এই যেখানে ছবি, সেখানে মেয়েদের সরিয়ে দেওয়ার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগানটি কি স্রেফ স্লোগান?
জানা যাচ্ছে, এই কাণ্ড তিনি এর আগেও ঘটিয়েছেন। ২০২০ সালে। মহিলাদের সামনের সারিতে বসে থাকতে দেখে তিনি ভাষণ না দিয়েই একটি ইভেন্ট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আয়োজকরাও তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেননি। অডিটোরিয়ামের নারীদের অপমান না করে বরং তাঁরা স্বামীজিকে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। কিন্তু এটাই লজ্জাজনক যে, আইসিএই নারীদের সেই মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হল।
…………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন সৌমি জানা-র কপি: ‘কাদম্বিনী মরিয়াও’ প্রমাণ করিতে পারে না যে তার উপর যৌন নির্যাতন হয়েছিল
…………………………………………………………………………………………………….
ভগবান স্বামী নারায়ণের থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত স্বামী জ্ঞানবৎসল। কথিত, একবার একজন মহিলার ওড়না নাকি স্বামীজিকে স্পর্শ করে ফেলে। তারপর তিনি তিনদিন নির্জলা উপবাস করে ছিলেন। প্রশ্ন হল, তাঁর ব্রহ্মচর্য পালন কি এতই ঠুনকো? এ কেমন সাধনা যেখানে চোখের সামনে নারী দেখলে ব্রহ্মচর্য টলে যায়! এটা ভ্রম না মতিভ্রম? ব্রহ্মচর্য বেছে নেওয়া কোনও মানুষের নিজস্ব নির্বাচন। কিন্তু জনসমক্ষে নারীদের অপমান করার কোনও অধিকার কারও নেই। যেখানে নারীর অবমাননা হয়, সেই সমাজের কোনও উন্নতি হতে পারে না। ফেমিনিজম মানে পুরুষ বিদ্বেষ নয়। ফেমিনিজম শেখায় নারী-পুরুষের সমানাধিকার। তা সে বাড়ি হোক বা কর্মক্ষেত্র। কোনও পুরুষকর্মীর চেয়ে কোনও অংশে নারীর অবদান কম নয়। কিন্তু যাবতীয় ডিসিশন মেকিং এবং বড় দায়িত্বে এখনও পুরুষই এগিয়ে। ছোট থেকে নানা মুখে শুনে আসি আমরা– অঙ্কে ছেলেরা একটু বেশি ভাল হয়। তাহলে শকুন্তলা দেবীকে কী বলব আমরা? শকুন্তলা দেবী ছিলেন একজন লেখক এবং গণিত বিশারদ। ‘মানব কম্পিউটার’ নামে ডাকা হত তাঁকে। অসাধারণ গণন-ক্ষমতার জন্য ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ তাঁর নাম রয়েছে। ছেলেরা সায়েন্স পড়বে আর মেয়েরা পড়বে আর্টস! ছেলেরা নাচ শিখলে বলা হয় ‘মেয়েলি’। খেলাধুলোর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মেয়েদের পারফর্মিং আর্টস শেখা? আচ্ছা, সুনীতা উইলিয়ামস মহাকাশে গিয়ে কি চু কিত কিত খেলছিলেন? কলা বিভাগে পড়াশোনা কিংবা পারফর্মিং আর্টস– কোনওটাকেই অসম্মান করছি না। কিন্তু ভেদাভেদের এমন স্টিরিওটাইপ ধারণা কেন? পুরুষ-নারীর এই বিভেদ কেউ মায়ের পেট থেকে শিখে আসে না। এই যে একটা শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুরুজনরা, সমাজ তার ভেতরে বপন করছে তফাতের বীজ, তার ফলস্বরূপ সে তো সযত্নে লালন করছে পিতৃতন্ত্রের বুনিয়াদ। তাই কথাচ্ছলে একটা ছেলে বলে ফেলতেই পারে– ‘সব কাজ মেয়েদের দ্বারা হয় না।’ কিংবা ‘মেয়েরা বেশি বাইরের জগৎ দেখে ফেললে মুশকিল!’ নিজেকে ‘শিক্ষিত’ আর ‘প্রগতিশীল’ প্রমাণ করার তাগিদে বেশিরভাগ মানুষ যতই ‘পলিশড’ হওয়ার চেষ্টা করুক, অনেক সময়ই বেকায়দায় মুখ ফসকে ‘অন্ধবিশ্বাস’ বেরিয়েই পড়ে। ‘ঘরের বউ বাইরে চাকরি করতে গেলে সংসার সামলাবে কে? বাচ্চারা তো বিনা শাসনে উচ্ছন্নে যাবে!’ এমন আলগা কথায় গা ভাসিয়ে দেয় অনেকেই। নিরাপত্তা প্রত্যেকের জন্যই একটি মৌলিক অধিকার। সেটা জীবনের হোক, কিংবা সম্মানের। রাতের শহরে বিপদ শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও হতে পারে। কিন্তু তাও কেন মেয়েদের ওপরই নিয়ন্ত্রণ বেশি? এই প্রতিবন্ধকতা কি কোনও পুরুষকে মোকাবেলা করতে হয়? ধর্ষণ হলে কেন মুখ লুকোতে হবে ধর্ষিতাকে? তার কী ভুল এখানে? মেয়েরা নিজের জীবনের গতি নিজেরাই সামাল দিতে পারে। পারলে নিজের ছেলেকে সুশিক্ষা দিন, যাতে সে বাইরে বেরিয়ে কোনও মেয়েকে বিরক্ত করতে না পারে। অধিকাংশ মেয়েকে তার স্বামীর কাছে শুনতে হয় তাকে বেশি ছাড় দিয়ে রাখার কারণে সে নাকি মাথায় চেপে বসেছে! কিন্তু সেই পতি পরমেশ্বর কি ভাবল ছোট থেকে সে বেশি আশকারা পেয়েছে বলেই তার স্ত্রীকে অপমান করার সাহস আজ রপ্ত করতে পেরেছে? কেন এই ‘শিক্ষিত’ সমাজের পুরুষ এখনও মনে করে ‘সব’ মেয়ের কাছে উপযুক্ত পাত্র সরকারি চাকুরে! মেয়েরা বরের টাকা তছনছ করে! নারী সক্ষম নিজের প্রয়োজন মেটাতে। যারা চাকরি করে না, তাদের কেন শুনতে হবে– ‘সারাদিন বাড়িতে বসে কী কাজ করো?’ আর এই মানসিকতার কারণেই এইসব সাধুসন্ত নারীকে অপমান করার সুযোগ পান। যার প্রতিবাদ সেই সভার উচ্চপদস্থ কোনও পুরুষ করে না। এমনকী মহিলারাও সবটা মুখ বুজে মেনে নেয়। কারণ তাদেরও হয়তো ছোট থেকে শেখানো হয়েছে পুরুষই সর্বময় কর্তা!
এই সমাজব্যবস্থা কি প্রকৃত অর্থে নারীর অধিকার বাস্তবায়ন করতে পেরেছে? না কি সেটা শুধুমাত্র লিখিত এবং মৌখিকভাবে জাহির করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
‘লাপাতা লেডিজ’ ছবিতে একটা সংলাপ রয়েছে– ‘দেখ ফুল, অওরত আনাজ উগা ভি সকতি হ্যায়, পাকা ভি সকতি হ্যায়। বাচ্ছা পেদা ভি কার সকতি হ্যায়, বড়া ভি কার সকতি হ্যায়। দেখনে যায়ে তো আরতোঁ কো মর্দ কি কৌনো খাস জরুরাত ওয়াইসে হ্যায় নহি। পার ই বাত অগর আউরতোঁ কো পাতা চল গয়ে তো মর্দ বিচারা কা বাজা না বাজ যায়েগা?’ দেখতে গেলে নারী একাই পারে নিজের জীবনপথে স্বাধীনভাবে চলতে। পুরুষের প্রয়োজন সে অর্থে নেই। তারা থাকতে চায় ভালোবেসে, তার কাছেই থাকতে চায় যে পুরুষ তাকে সম্মান দিয়ে রাখবে। পিতৃতন্ত্রের ‘ভাঁওতাবাজি’-তে মেয়েমানুষকে ঠকানো অত সহজ নয়।