৯ তারিখ ও আজ, ১০ সেপ্টেম্বর, জি-২০ বিষয়টি আরও জনমানসে জায়গা করে নিল। যদিও ভারতের সামনে চ্যালেঞ্জগুলি সহজ ছিল না। গত কয়েক মাসে, জি-২০ গোষ্ঠীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। ভারত সভাপতিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তো বটেই। ভিন্নমতের মধ্যে সেতু নির্মাণও করেছে।
জি-২০ হল বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলির ফোরাম। সেইসব দেশ, যারা উন্নত, উন্নয়নশীল অর্থনীতির মুখ দেখেছে। জি-২০, অর্থাৎ, গ্রুপ অফ টোয়েন্টি। ২০ খানা দেশের আখড়া। তবে, শুধু অর্থনীতি নিয়েই যে এদের যত ব্যস্ততা, তা নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব, বিশ্ব উষ্ণায়ন, দূষণ এবং স্থিতিশীল উন্নয়নের মতো বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার প্ল্যাটফর্ম। রাজধানীতে আজই এই বৈঠকের পরিসমাপ্তি।
জি-২০ গোষ্ঠীর দেশগুলি জিডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রক। বৈশ্বিক বাণিজ্যেরও ৭৫ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা। পাশাপাশি, মানবসম্পদেও ভরপুর। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এই গোষ্ঠীর সদস্য দেশগুলির বাসিন্দা। ভারত শুধু বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের মধ্যে একটি নয়, সবচেয়ে বেশি যুব জনসংখ্যার দেশও– জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড)-এর হার সবার ওপরে। অর্থনীতি, শিক্ষা, ব্যাঙ্ক ডিজিটাইজেশন, গণ-পরিকাঠামো, ডিজিটাল পরিকাঠামো, মানব কল্যাণ, অন্তর্ভুক্তি এবং সামাজিক ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত সংস্কারগুলি একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং ভারতের বৃদ্ধি তার প্রমাণ। সব দিক বিচার করে বলা চলে, জি-২০-র মতো একটি গ্লোবাল ফোরামের সভাপতিত্বের ভার গ্রহণ নিঃসন্দেহে ভারতের মুকুটে এক নতুন পালকের সংযোজন। এই সভাপতিত্বের মেয়াদ এক বছর– গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে যা শুরু হয়েছিল, শেষ হবে ২০২৩-এর ৩০ নভেম্বর।
৯ তারিখ ও আজ, ১০ সেপ্টেম্বর, জি-২০ বিষয়টি আরও জনমানসে জায়গা করে নিল। আমরা দেখেছি, জি-২০ প্রেসিডেন্সি ঋণ জটিলতার কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মনোযোগ দিয়েছে, বিশেষ করে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর দেশগুলোর জন্য। জি-২০ দেশগুলির অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নররা অভিন্ন কাঠামোর মধ্যে এবং কমন ফ্রেমওয়ার্কের বাইরের দেশগুলির মধ্যে ঋণ প্রদানের অনুশীলনে ভাল অগ্রগতির কথা স্বীকার করেছেন। বিশ্বব্যাপী ঋণ পুনর্গঠন প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এবং জি-২০ প্রেসিডেন্সির যৌথ উদ্যোগ হিসাবে এই বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাপী সার্বভৌম ঋণ গোলটেবিল চালু করা হয়েছিল– ভারত যার অন্যতম অংশীদার। জি-২০ প্রেসিডেন্সি ভারতকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিষয়গুলিতে বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণে অবদান রাখার জন্য এক অনন্য সুযোগ করে দেবে বলে জানিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। এই সুযোগ ভারতকে বিশ্ব মঞ্চে নেতৃত্বদানকারীর ভূমিকায় উন্নীত করবে বলে আশা। পাশাপাশি, এই ফোরামের সভাপতিত্ব বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নততর করারও দারুণ সুযোগ। এর ফলে, ভবিষ্যতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সমর্থন পেতে সুবিধা হবে ভারতের। যুগ যুগ ধরে যে বাণী প্রচার করেছে ভারত, সেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-ই এই জি-২০-র মূল মন্ত্র।
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অর্থনীতি, খাদ্যব্যবস্থা, খাদ্যবণ্টন, খাদ্য-নিরাপত্তা, কৃষি, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শক্তি– বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিকাঠামোর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই আলোচনা হচ্ছে। আগামী দিনেও হতে থাকবে। কোপ-২১ প্যারিস সামিটে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে করা প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে, ভারতের জ্বালানি শক্তির মিশ্রণে সৌর ও বায়ুর অংশ অসাধারণভাবে বেড়েছে, ভারতীয় প্রেসিডেন্সি স্টার্টআপ-২০, এনগেজমেন্ট গ্রুপ-গিগ এবং প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের উৎসাহ প্রদান, আমাদের ফিনটেক প্রযুক্তি, ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস (UPI) এবং ই-রুপির প্রবর্তন– এই উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি বিশ্বের দরবারে মেলে ধরার একটি দুর্দান্ত সুযোগ ভারত পেয়েছে এবং পরবর্তীকালেও পাবে বলে আশা।
১৯টি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বকে কাজে লাগিয়ে শিল্প-বাণিজ্য থেকে শুরু করে শক্তি-নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির বিভিন্ন দিকে জাতীয় স্বার্থ আদায় করে নেওয়াটা এখন বিদেশনীতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অগ্রাধিকার। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির কাছ থেকে বিনিয়োগ টানার এই নীতি, ভারতের পক্ষে ফলদায়ক।
যদিও ভারতের সামনে চ্যালেঞ্জগুলি বড় সহজ ছিল না। গত কয়েক মাসে, জি-২০ গোষ্ঠীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। অভ্যন্তরীণ ফাটল ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছিল, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে। কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের অবস্থানের কারণে তাদের মধ্যে ভেদাভেদ রয়েছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর জন্য মস্কোকে দায়ী করতে নারাজ রাশিয়া ও চিন। অপরদিকে যুদ্ধের জন্য মস্কোর প্রতি কড়া নিন্দা জানানোকে যৌথ বিবৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে দেখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও কানাডা। ভারত সভাপতিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তো বটেই। ভিন্নমতের মধ্যে সেতু নির্মাণ করেছে।
এই বৈঠকে নীতি গৃহীত হয়। কিন্তু কাজ সমাধা হয়, এমন নয়।
জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থায়নের ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিতে হবে ভারতকে। মাঝারি ও নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে পুনর্নবিকরণযোগ্য শক্তি প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিরন্তর উৎসাহ দিতে হবে উন্নত দেশগুলিকে। তৎসঙ্গে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা। আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, ডব্লিউটিও-র (WTO) মতো অর্থনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক ফোরামগুলির সঙ্গে যৌথভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে।
ভারত-চিন, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত বিতর্কের আবহে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এই জি-২০ সম্মেলন রাজনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতদিন পৃথিবীর ‘অ্যাজেন্ডা’ তৈরি করত উন্নত দেশগুলো। এই প্রথমবার উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারত সেই কর্মসূচি তৈরি করল। চন্দ্রযান-৩ এর সফল অবতরণ, এসসিও শীর্ষ সম্মেলন, ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ, হকি ওয়ার্ল্ড কাপ, গ্লোবাল সাউথ সামিট ইত্যাদির মতো এই বছরে রেকর্ডকৃত ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে সম্প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। ভারত উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এক সুতোয় বাঁধার যে কর্মযজ্ঞে উদ্যোগী হয়েছে, তাতে কতদূর সাফল্য আসবে, তা সময়ই প্রমাণ করবে।