জি-২০-র বৈঠক উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু যে আমন্ত্রণপত্র অতিথিদের পাঠিয়েছেন, তাতে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’। এই লেখা দেখার পরই জল্পনা তৈরি হয়েছে, তাহলে কি ‘ইন্ডিয়া’ নামটিকে বিদায় জানানো হচ্ছে? নাকি বিরোধীরা তাদের জোটের নাম ‘ইন্ডিয়া’ দেওয়াতেই মোদি দেশের নাম ‘ভারত’ করতে তৎপর হয়েছেন?
নরেন্দ্র মোদির জমানায় নামবদল নতুন কোনও ঘটনা নয়। ঔপনিবেশিক চিহ্ন মুছে ফেলার নামে মোদির আমলে দেশে প্রচুর শহর ও ঐতিহাসিক স্থানের নামবদল হয়েছে। বর্তমান নাম বদলে দিয়ে পৌরাণিক নাম এসেছে। এবার বিশ্বের দরবারে খোদ দেশের নাম বদলে দিতে মোদি উদ্যোগী হয়েছেন বলে জল্পনা চলছে। জি-২০-র বৈঠক উপলক্ষে নৈশভোজে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু যে আমন্ত্রণপত্র অতিথিদের পাঠিয়েছেন, তাতে বড় বড় করে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’। এই লেখা দেখার পরই জল্পনা তৈরি হয়েছে, তাহলে কি ‘ইন্ডিয়া’ নামটিকে বিদায় জানানো হচ্ছে?
বিরোধীরা তাদের জোটের নাম ‘ইন্ডিয়া’ দেওয়াতেই কি মোদি দেশের নাম শুধু ‘ভারত’ করতে তৎপর হয়েছেন? বিরোধীরা তেমনই দাবি করছেন। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ প্রথম টুইটটি করেন। পরে একে একে মুখ খোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা। সকলেই বলছেন, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ভয়েই মোদি দেশের নাম শুধু ‘ভারত’ রাখতে চাইছেন। এ ব্যাপারে সরকারি কোনও বক্তব্য মেলেনি। বিরোধীদের জল্পনা, ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে সংসদের যে বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে, সেখানেই ‘ইন্ডিয়া’ নামটি বাদ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব আসবে। সংবিধানের এক নম্বর ধারায় বলা রয়েছে, ‘ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত, শ্যাল বি আ ইউনিয়ন অফ স্টেটস’। অর্থাৎ, সংবিধানে ‘ভারত’ নামটি রয়েছে। সংবিধান সংশোধন করে বাদ দিতে হবে ‘ইন্ডিয়া’ নামটি। রমেশ তাঁর টুইটে লেখেন, ‘‘এবার সংবিধানের এক নম্বর ধারাটি হয়তো লেখা হবে এইভাবে, ‘ভারত, দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া, শ্যাল বি আ ইউনিয়ন অফ স্টেটস’।’’
ঔপনিবেশিক শাসকের নাম বদলে দেওয়াও বিশ্বে নতুন নয়। ঘরের কাছে ‘বার্মা’ নাম বদলে ‘মায়ানমার’ হয়েছে। ‘সিলন’ হয়েছে ‘শ্রীলঙ্কা’। ‘রোডেশিয়া’র নাম বদলে হয়েছে ‘জিম্বাবোয়ে’। বিশ্বের দরবারে ‘ইন্ডিয়া’ নামটারই পরিচিতি রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে হিন্দুস্তান নামটির পরিচিতি ছিল। দেশ দু’-টুকরো হয়েছিল হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানে। পরে ‘ভারত’ ‘ইন্ডিয়া’ নামটিকে গ্রহণ করে নেয়। এতে আপত্তি ছিল মহম্মদ আলি জিন্নার। তিনি তাঁর আপত্তির কথা শেষ ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন। জিন্নার ক্ষোভ ছিল, ‘ইন্ডিয়া’ নামটি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভারত’ অবিভক্ত ইন্ডিয়ার উত্তরাধিকারটিও পেয়ে যায়। যেটি পাকিস্তান পায়নি। ‘ইন্ডিয়া’ নামটিতে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আপত্তি ছিল। হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দুস্তান নামটিতে বেশি স্বচ্ছন্দ ছিল। হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তা দামোদর সাভারকরের স্লোগান ছিল ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান’। যদি বিদেশি নামই পরিত্যায্য হয়, তাহলে ‘হিন্দুস্তান’ নামটি হতে পারে না। ‘হিন্দুস্তান’ হল একটি পার্সি শব্দ। সেক্ষেত্রে সংস্কৃত শব্দ ‘ভারত’ই দেশের প্রাচীনতম নাম। মহাভারতে বর্ণিত দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার ছেলের নাম ভারত। সেই ভারত রাজার উত্তরসূরী আমরা। তখন থেকে এই ভূখণ্ড ‘ভারত’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
দেশের নাম শুধু ‘ভারত’ করার দাবিটি তাই নতুন নয়। সুপ্রিম কোর্টেও বারবার মামলা হয়েছে। একবার প্রধান বিচারপতি মামলাটি অপ্রাসঙ্গিক বলে খারিজ করেন। কিছুদিন আগে তৎকালীন দেশের প্রধান বিচারপতি এস. এস. বোবদে মামলাকারীদের কেন্দ্রের কাছে আবেদন করতে বলেছেন। সম্প্রতি সংঘ প্রধান মোহন ভাগবত ‘ভারত’ নামের পক্ষে সওয়াল করেন। সদ্য শেষ হওয়া সংসদের বাদল অধিবেশনে বিজেপির দু’-তিনজন সাংসদ সংবিধান সংশোধনের দাবি তুলেছিলেন। তখন অবশ্য বোঝা যায়নি যে ‘ইন্ডিয়া’ আতঙ্কে সংবিধান সংশোধনের ভাবনা বিজেপিতেই রয়েছে।
আসলে ২০২৪-এর আগে জাতীয়তাবাদের কোনও আবেগ মোদি হাতছাড়া করতে রাজি নন। বিরোধীরা ‘ইন্ডিয়া’ নামটি নিয়ে নেওয়ায় এককদম এগিয়ে গিয়েছে বলে মোদির ধারণা। সে কারণে তিনি কিছুদিন যাবৎ ‘ইন্ডিয়া’ নামটিকে আক্রমণ করছিলেন। ‘ইন্ডিয়া’-র সঙ্গে ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন’, ‘পিএফআই’-এর মতো জঙ্গি সংগঠনের নাম জুড়ছিলেন। এখন ‘ইন্ডিয়া’ নামটির সঙ্গে ঔপনিবেশিকতার গন্ধ লাগিয়ে দিয়ে ‘মোদি ব্রিগেড’ হয়তো বিশ্বের দরবারে ‘ভারত’ নামকরণকে জাতীয়তাবাদী জিগির তোলার হাতিয়ার করতে চাইছে। সংসদের বিশেষ অধিবেশনে সত্যিই এ নিয়ে কোনও বিল আসে কি না– সেটাই এবার দেখার।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved