ঘটনা ঘটেছিল সেই ১২ নভেম্বর। সিলকিয়ারা-বারকোটের নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গে নামল ধস, আটকে পড়লেন ৪১ জন। সংবাদ এসেছিল, তবে তখনও তা তেমন করে নজর কাড়েনি। তথ্য আসে অহরহ, ওজন অনুযায়ী নির্মাণ হয় খবরের। একেবারে গোড়ার দিকে এই তথ্যও ওজনদার খবর হয়ে সামনে আসতে পারেনি। সময়টা উৎসবের। দীপাবলি তখন ঝলমলিয়ে উঠেছে গোটা দেশে। ২২ লক্ষ দীপ জ্বলেছে সরযূ নদীর তীরে। রেকর্ড আলোয় সেদিন আর মনে পড়েনি, কোথায় কোন ৪১ জন পড়ে আছেন অন্ধকারে।
প্রায় এক পক্ষ। সুড়ঙ্গের কৃষ্ণ অন্ধকারে আটকে থাকলেন ৪১ জন শ্রমিক। অবশেষে মুক্তির আলোটুকু দেখা গিয়েছে বটে, তবে গোটা দেশকেই এক জরুরি সংকটের কথা মনে করিয়ে দিলেন শ্রমিকরা। শ্রমিক-ই বা বলা কেন! তাঁরা আমাদেরই সহনাগরিক, ভারতবাসী। অন্ধকারে যাঁরা বন্দি হয়ে আছেন সবার ওপরে তাঁরা মানুষ। এভাবেই বলা যেত; যদি তা বলার অধিকার অর্জন করা সম্ভব হত। ১৪১ কোটির দেশ তবু প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তাঁরা শ্রমিকই। নইলে মাটির নিচে অন্ধকারে তাঁদের বিপর্যস্ত অবস্থায় রেখে ওপরে এমন অঢেল উৎসব জাঁকিয়ে চলতেই বা পারল কী করে!
ঘটনা ঘটেছিল সেই ১২ নভেম্বর। সিলকিয়ারা-বারকোটের নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গে নামল ধস, আটকে পড়লেন ৪১ জন। সংবাদ এসেছিল, তবে তখনও তা তেমন করে নজর কাড়েনি। বিপুলা এ দেশে প্রতিদিন কত ঘটনাই ঘটিতে থাকে। তথ্য আসে অহরহ, ওজন অনুযায়ী নির্মাণ হয় খবরের। একেবারে গোড়ার দিকে এই তথ্যও ওজনদার খবর হয়ে সামনে আসতে পারেনি। সময়টা উৎসবের। দীপাবলি তখন ঝলমলিয়ে উঠেছে গোটা দেশে। ২২ লক্ষ দীপ জ্বলেছে সরযূ নদীর তীরে। রেকর্ড আলোয় সেদিন আর মনে পড়েনি, কোথায় কোন ৪১ জন পড়ে আছেন অন্ধকারে। আমরা কি নয় তেমন খবরসচেতন! অতিবড় নিন্দুকেও সে-কথা বলবে না। আমরা দেখেছি, মন দিয়েই দেখেছি, হিমাচলে সেনার পোশাকে দীপাবলি উদযাপন করছেন প্রধানমন্ত্রী। ক্রিকেট বিশ্বকাপে তখন অপ্রতিরোধ্য ভারতের অশ্বমেধের ঘোড়া। মুম্বইয়ের পিচে সন্ধের সামুদ্রিক হাওয়া আর শিশিরের আনুপাতিক সমন্বয়ে ঘূর্ণিবলের কেরামতি কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা নিয়ে আমরা কম চিন্তত হইনি! দেখেছি, কীভাবে গোটা জাতি সমবেত প্রার্থনায় কামনা করেছে দেশের জয়। সেই দেশের ক’জন মানুষ যে তখনও অনিশ্চিত অন্ধকারে, উল্লাসের ফ্লাডলাইট সেখানে আলো ফেলতে পারেনি। শামি-এক্সপ্রেসে ভর করে সেমির অলৌকিক জয়টুকুই তখন আমাদের দেশ, বাকি থেকে গিয়েছিলেন শুধু ওই ৪১ জন। এ বঙ্গেও তখন নানা রঙ্গ! ভুলে যাওয়ার আগে শেষ দফা চলছে নজরুলগীতির বিকৃতিতে রহমানের মুণ্ডপাত। সেই আবেগের ঢেউ মিলিয়ে যেতে না যেতেই এসে পড়েছে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের গ্রেপ্তারি সম্পর্কিত নানা আপডেট। মুহুর্মুহু রাজনৈতিক জল্পনা আলপনা দিচ্ছে খবরের ঘরদুয়ারে। ওদিকে রাহুল গান্ধী তখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন শচীন পাইলট আর অশোক গেহলটের হাতে-হাত রেখে অসম্ভবপর এক রাখিবন্ধনের। এরই মাঝে বড় বেদনার মতো বেজে উঠল বিশ্বকাপে পরাজয়। যে দেশে সকলেই ক্রিকেট সমঝ্দার, যে দেশের আছে মস্ত ক্রিকেট-বাজার, সে-দেশ ক্রিকেটে হেরে কী করে যেতে পারে! ততদিনে প্রায় পেরিয়ে গিয়েছে আট দিন, সুড়ঙ্গের নিচেই অন্ধকার ভবিতব্যে বন্দি হয়ে আছেন ৪১ জন। প্রধানমন্ত্রী যখন শামিকে বুকে টেনে নিলেন, আর সে-ছবি দেখে আমরা যখন উজ্জ্বল এক দেশের আনন্দে বুঁদ হলাম, তখন উদ্ধার বিলম্বিত হবে জেনে ভাত-রুটি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে তাঁদের কাছে, যাঁরা মাটির নিচে আছেন বলে আমাদের উৎসব-আয়োজন মুলতবি হয়নি। বরং ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতির চিরকালীন গাঁটবন্ধনের যে এবার এক অভূতপূর্ব উচ্চকিত প্রদর্শন চোখে পড়ল, আলোচনার টেবিলে সেটিকেই প্রথম সারিতে টেনে এনে আমরা বৌদ্ধিক তৃপ্তি লাভ থেকেও বিরত থাকলাম না। ইত্যবসরে বাংলার মুখ হিসাবে পাওয়া গেল আদরের ‘দাদা’-কে। আমাদের মনোযোগ এভাবেই গড়িয়ে যেতে থাকে নব তরঙ্গে, নতুন রঙ্গে। ৪১ জন তখনও ছিলেন অন্ধকারে, আমাদের যেন মনেই ছিল না।
উদ্ধারকাজ এগিয়েছে, যন্ত্র ভেঙেছে, থমকেছে, শেষমেশ হাতে খোঁড়া শুরু হল। তা সাফল্যের মুখ দেখুক, এই এখন প্রার্থনা। তবে যা নিয়ে ভাবিত হওয়ার কথা ছিল, তা যেন নজরেই পড়ল না। যেমন, প্রকল্পে উল্লিখিত সেফ প্যাসেজ কেন বাস্তবে ছিল না; ঘটনার দিন সাতেকের মাথায় বিশেষজ্ঞ কমিটি সে-কথা জানিয়েছিল। এই ধরনের পার্বত্য অঞ্চলে সুড়ঙ্গের কাজে যে ধরনের পরামর্শ, সতর্কতা এবং নৈমিত্তিক নিরীক্ষণ দরকার, সেসব যথাযথ ছিল কি না, তাও স্পষ্ট নয়। আটকে পড়ার পর যে যুদ্ধকালীন তোড়জোড়, তা যদি আগে থাকত, তাহলে এমন মারাত্মক বিপর্যয় আটকানো যেত। তবে, চারধাম যাত্রার রাস্তা যতটা জরুরি, শ্রমিকদের জন্য সাবধান হওয়া যে তার থেকেও বেশি জরুরি, এমনটা আশা করাও বাড়াবাড়ি। কেননা এ তো স্পষ্টই যে, সুড়ঙ্গের মধ্যে ৪১ জন প্রাণ হাতে করে বসে থাকলেও আমাদের সামূহিক মোচ্ছবে তেমন কোনও টানাটানি পড়নি। অর্থাৎ যাঁরা এই কাজ করেন, করে থাকেন, তাঁদের যে কতখানি গুরুত্ব সামগ্রিক ভাবে দেশবাসী দেন, তা পক্ষকালের হিসাব থেকেই স্পষ্ট। অতএব সমগ্র বিপর্যয়ের গোড়ায় ভ্রান্তি যদি কিছু থেকেও থাকে, ঝুঁকি যদি নেওয়া হয়েই থাকে, তাও এক অর্থে এই নির্বিকার দেশবাসীরই অনুমোদনক্রমে। কেননা উৎসবে নেশাতুর এই দেশ স্পষ্টতই জানিয়ে দেয়, পাশের মানুষের বিপদের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিত্যনতুন চমকের খোয়াবনামা। এই প্রবণতাও কম বিপদের নয়! ৪১ জনের পরিচয় যদি নির্মাণশ্রমিক না হয়ে অন্য কিছু হত, তাহলে কি অপারেশন কাবেরী, সরস্বতী নামে কোনও কর্মসূচি নেওয়া হত না! সারা দেশ তটস্থ হয়ে উৎকণ্ঠায় বিনিদ্র রজনী যাপন করত না! অন্তত দেশের নেতারা তো তা করতেনই। কেননা এ দেশে জল পড়ে পাতা নড়ে আর নেতারা মানুষ দেখলে হাত নাড়ে। ফলে যেখানে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোটের যন্ত্রে জুড়ে দেওয়া যায়, সেখানে তাঁরা প্রতিযোগিতার খেলায় পিছপা হতেন না। উত্তরকাশীর ক্ষেত্রে সেসব যে প্রায় কিছুই হল না, তার কারণ এই ৪১ জনের জীবনকে তেমন গুরুত্ব দেননি তাঁদের সহনাগরিকরাই। তাঁদের কাছে দীপাবলি কিংবা ক্রিকেট অনেক বেশি জরুরি মনে হয়েছে। তাই নেতাদের উৎসাহের আস্তিনও ঢিলেঢালা হয়েই পড়ে থেকেছে। মাটির তলায় থাকা মানুষগুলো এতটাই অকীর্তিত যে, তাঁরা রাজনীতির বিষয়ও হয়ে উঠতে পারেননি। দেখতে গেলে, দেশের ভিতর যে বহু রকমের দেশ বহমান এবং তার মধ্যে এক-এক শ্রেণির জীবন আর জীবনে নেমে আসা বিপর্যয় যে নিয়তিনির্দিষ্ট, এ-কথাটা বাকিরা মেনেই নিয়েছি। সংখ্যালঘুর প্রতি অবিরত অবজ্ঞার অনুশীলনে প্রয়োজনমাফিক তৈরি করে নিচ্ছি উপেক্ষার পাত্র। ধর্ম দিয়ে তার শুরুটা হয়ে পৌঁছচ্ছে সেই বর্গের হিসাবেই। ৪১ জন নির্মাণশ্রমিককে সেই সুবাদেই সংখ্যালঘু করে দিতে বাকি দেশের অস্বস্তি হয়নি। অথবা যৎসামান্য যদি হয়েও থাকে উৎসবের মৌতাতে তা আড়াল করা গিয়েছে বেশ ভালোভাবেই। হয়তো অসহায়তা, বিপন্নতা থেকেই এই অবস্থান। চটকদারি আধিপত্যবাদী রাজনীতি মানুষের থেকে দূরে এভাবেই ঠেলে নিয়ে গেছে মানুষের ভাবনাকে। আর তাই মানুষের বিপদে সহমর্মী হয়ে ওঠার থেকেও উৎসবের মদ অনেক বেশি গ্রহণীয় হয়ে উঠছে। নইলে ভিনদেশের মিচেল মার্শ তাঁদের জেতা বিশ্বকাপের ট্রফিতে পা রেখেছেন বলে দেশবাসীর ভাবাবেগে চোট লাগে, এফআইআর অবধি হয়; আর এই দেশেরই কয়েকজন মানুষকে মাটির নিচে রেখে ওপরে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকায় আমাদের ভাবাবেগ অরক্ষিত থাকল কী করে! অন্তত মানুষগুলোর ফিরে আসার কামনায় সমবেত প্রার্থনার আয়োজনও তো হতে পারত। সিনেতারকা অসুস্থ হলেও তো এ-দেশে যজ্ঞ করা হয়। অন্তত প্রশাসনের কাছে উদ্বেগের প্রশ্নগুলো রাখা যেত। সেসবের কিছুই যে তেমন চোখে পড়ল না, তার কারণ এই, অন্যের জন্য দেশের প্রাণ আর কাঁদে না। অথবা ধূর্ত রাজনীতির কুমিরের মতো সে-ও সিলেক্টিভ অশ্রুতে বিশ্বাস করতে শিখে গেছে। জানে, কোন কান্নায় কত লাভ!
আরও পড়ুন: ভারত সুড়ঙ্গে আটকে, তীর্থযাত্রায় পুণ্যলাভ রাজনীতির
শেষমেশ মুক্তির আলোটুকু দেখা গিয়েছে। তবে, এই সংকট যেন গোটা দেশকেই পৌঁছে দিল আর এক সংকটের কাছে। বিপদ তো লোক বুঝে আসে না। তা অন্যভাবে ঘুরে আসতে পারে তথাকথিত এই নিরাপদ, নিরুপদ্রব জীবনেও। সেদিন সহমর্মিতার আশা করা বৃথা! উত্তরকাশী যেন দেখিয়ে দিল আমরা নিজেরাই রচনা করছি আমাদের অবমানবীয় নিষ্ঠুর ইতিহাস। যার শিকার হতে পারি একদিন নিজেরাই। বিশ্ববন্দিত সিনেমায় আমরাই তো দেখেছি, ওপরে উৎসব আর সুড়ঙ্গের মধ্যে থাকা মানুষের বেঁচে থাকার দুর্বিষহ বৈপরীত্য কী অভিঘাত নিয়ে নেমে আসতে পারে। তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে বিস্তর। দৃশ্যের ব্যঞ্জনা থেকে নেমে এসে যখন তা আমারই দেশে ঘোরতর বাস্তব, তখন নির্বিকার উদাসীনতা আয়নাকেও দূরে সরিয়ে রাখে। মানুষ-ভাঙা রাজনীতি যা চায়, মানুষ নিজেই যেন সেই আগুনে ঘি ঢালে। সে রাজনীতির ‘প্যারাসাইট’ হলে বাড়ে অপরায়নের আবাদ। শ্রেণির সুবাদে, ৪১ জন মানুষকে অনায়াসে ‘অপর’ ভেবে নিতে তাই দ্বিধা হয় না। অন্যের খোপে ঢুকে পড়া মানুষ কেউই আসলে কাউকে ভালোবাসে না। কারও বিপদেই প্রতিবেশী কারও বিকার হয় না। সমস্ত খোপের সামনে অবধারিত নেমে আসে অনিবার্য অস্বীকার। সহমর্মী, সমব্যথী হওয়ার অনুশীলন নেই বলেই আমরা নিজেদের বন্দি করে ফেলেছি নিজেদের এই নিষ্ঠুর জেলখানায়। সেখানে আলো নেই, অন্ধকারও তীব্র। মাটি খনন করে সুড়ঙ্গের সংকট থেকে হয়তো মুক্তি মিলল, কিন্তু সভ্যতার এই সংকট থেকে মুক্তি কীভাবে!
জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।