প্যালেস্তাইনে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থানের জায়গায় যে এশীয় রাজনীতিবিদরা জোর দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে গান্ধীজি গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের প্রভাবে এবং পাশ্চাত্য প্ররোচনায় আরবদের নিজভূমিতে কোণঠাসা করে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। বিশেষত যেখানে খিলাফত আন্দোলনের সূত্রে পশ্চিম এশিয়ায় আরবদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে সামনে রেখে তিনি একটা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ইজরায়েল একটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের মডেল হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে, তা তিনি আন্দাজ করেছিলেন। আর আখেরে তা প্যালেস্তিনীয়দের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে, সে কথা তিনি সম্যক বুঝেছিলেন।
খিলাফত আন্দোলনের শেষ দিকে, ১৯২১ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জর্জ লর্ডের হস্তক্ষেপে যেখানে অবিভক্ত প্যালেস্তাইন ছিল, সেই ভূখণ্ডে ট্রান্সজর্ডন তৈরি হয়। ব্রিটিশরাজের হস্তক্ষেপে ‘লিগ অফ নেশনস’-এ ১৯২২-এ পাশ হয় ‘সালেম্যান্ডেট ফর প্যালেস্তাইন’। যার ফলে খলিফার হাত থেকে এই অঞ্চল ব্রিটিশ ও পাশ্চাত্যশক্তির আধিপত্যে চলে যায়। যদিও সরাসরি নয়, একজন আমির বা ‘এমিরেট অফ ট্রান্সজর্ডন’-কে ক্ষমতায় বসিয়ে ব্রিটিশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন প্যালেস্তাইনকে আরব দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া মজবুত হল। ধীরে ধীরে এই ভূখণ্ডে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে বসত বাড়তে শুরু করল ইহুদি সেলটারদের। সময় যত এগোতে থাকে, বদল ঘটতে থাকে আরব-ইহুদি বাসিন্দার অনুপাতে। এরই সমান্তরালে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। সহনশীলতা ও সৌহার্দের নয়, বরং অসহিষ্ণুতা ও হিংসাত্মক মনোভাবই চাগাড় দিতে থাকে। মধ্য ১৯৩০ নাগাদ প্রতি বছর প্রায় গড়ে ৩০ হাজার ইহুদি মানুষ প্যালেস্তাইনে আস্তানা গাড়তে শুরু করল। দুয়ের দশকে যেখানে দশজন আরব পিছু একজন ইহুদি বাস করত প্যালেস্তাইনে, সেখানে তিনের দশকের শেষদিকে দেখা গেল প্রতি তিনজন আরব পিছু একজন করে ইহুদির বসত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আগন্তুকরা আরব কৃষিজীবী মানুষদের কাছ থেকে জায়গা জমি কিনে নিল। দু’দিকের মানুষেরই শুরু হল সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের সংকট। সন্দেহের এই বাতাবরণ গাঢ় হওয়ার অন্যতম কারণ এই নতুন পরিস্থিতি ইহুদি-ফিলিস্তিনি ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়নি, তা তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষার তাগিদে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে, ১৯১৭ সালে বেলফোর্ড ডিক্লারেশন মোতাবেক প্যালেস্তাইনে ইহুদি মানুষের জাতীয় ভূমি প্রতিষ্ঠার কথা ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে, যা বাস্তবায়নের প্রসঙ্গটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নুরেমবার্গ বিচারপর্বের সময় আবার বিবেচিত হতে শুরু করে। প্যালেস্তাইনে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ ক্রমে পরিষ্কার হতে থাকে। যদিও মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুশভেল্ড আরবদের কথা দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা ব্যতিরেকে কোনও পদক্ষেপ করা হবে না। পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টের মাথায় অবশ্য অন্যরকম পরিকল্পনা ঘুরছিল। ট্রুম্যান পশ্চিম এশিয়ায় ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগ নিতে থাকেন। কারণ তিনি বোঝেন যে, ইজরায়েল পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার সামরিক প্রভাব তৈরিতে সহায়ক হবে। ঠান্ডা যুদ্ধে আমেরিকার প্রতিপত্তি বজায় রাখার স্বার্থেই বলা যেতে পারে, মার্কিনদের আগ্রহ ছিল ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার।
১৯৪৭ সালে, নভেম্বর মাসে ইউএনও পার্টিশন অফ প্যালেস্তাইন প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং এই প্রস্তাবে স্থির করা হয় প্যালেস্তাইনের ভূমি আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে, যাতে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষিত হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকা সেই নবগঠিত রাষ্ট্রকে স্বাগত জানায় ও মান্যতা দেয়। এই প্রক্রিয়ায় কোথাওই আরবদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি বলা যেতে পারে। বলা যায়, প্যালেস্তাইনের অধিবাসীদের ওপর পাশ্চাত্য শক্তির স্বার্থ রক্ষায় ইজরায়েল রাষ্ট্রকে বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়। তার ফল কী হয়েছে, সেটা আজকের দিনে বসেও আমরা বুঝতে পারছি। রক্তক্ষয়ী যে সংগ্রাম প্যালেস্তাইন এবং ইজরায়েলের মধ্যে আমরা দেখে আসছি, তার দীর্ঘস্থায়ী সূচনাটা হয়ে গেল ওই ১৯৪৮ সালে।
আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদত সত্ত্বেও ইজরায়েলের যাত্রাটা খুব একটা সহজ হল না। লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, মিশর, জর্ডন এবং বলা বাহুল্য, প্যালেস্তাইনের আঞ্চলিক অধিবাসীরা এই নতুন রাষ্ট্রকে তাদের হকের জমিতে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ বলেই মনে করল। জন্মলগ্নেই ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল পশ্চিম এশিয়ার একাধিক শক্তির। আজ যারা হামাসের মতো মিলিশিয়াদের প্রবল সমালোচনা করছে এবং চোখের জলে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল ভাসিয়ে দিচ্ছে, তাদের জেনে রাখা ভাল যে, ১৯৪৮-’৪৯ নাগাদ আরব শক্তিগুলির প্রতিরোধের বিরুদ্ধে প্রথম সন্ত্রাসবাদী আক্রমণগুলি কিন্তু চালিয়েছিল ইজরায়েলের কিছু গুপ্তগোষ্ঠী। গুপ্ত ঘাতক গোষ্ঠী তৈরি করা, রাষ্ট্রের মদতে সন্ত্রাস ছড়ানোর কাজটা কিন্তু ইজরায়েল রাষ্ট্র একেবারে জন্মলগ্ন থেকে কুক্ষিগত করেছিল। তারপর জর্ডন নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ক্রমাগত প্যালেস্তিনীয়রা পিছু হটতে হটতে আজ তারা গাজা স্ট্রিপ এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে একেবারে মুষ্টিমেয় সংখ্যার সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতকে কেন্দ্র করে পশ্চিম এশিয়ায় বারবার রক্ত ঝরেছে সাধারণ নাগরিকের। অশান্ত গাজা স্ট্রিপ এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কেবল মৃত্যু, হিংসা আর লেলিহান আগুনের শিখা আমাদের কাছে যেন প্যালেস্তাইনের ইমেজ হয়ে উঠেছে আজ।
প্যালেস্তাইনে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের এই প্রক্রিয়া বিশ শতকের দুয়ের দশক থেকেই বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছিল। তবে সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ অবস্থানই ছিল কৌশলগত। নীতিগত অবস্থানের জায়গাটায় যে এশীয় রাজনীতিবিদরা জোর দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে গান্ধীজির নাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের প্রভাবে এবং পাশ্চাত্য প্ররোচনায় আরবদের নিজভূমিতে কোণঠাসা করে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। বিশেষত যেখানে খিলাফত আন্দোলনের সূত্রে পশ্চিম এশিয়ায় আরবদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে সামনে রেখে তিনি একটা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। পশ্চিম এশিয়ায় আরবদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে তিনি নীতিগত অবস্থান হিসেবেই খিলাফত আন্দোলন-পরবর্তীকালে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩১ সালে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের পরে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জেরুজালেম রয়েছে ইহুদিদের হৃদয়ে, তাকে ভৌগোলিক মানচিত্রে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কোনও প্রয়োজন নেই। যদিও গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর ইহুদি বন্ধুদের যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর আন্দোলনের পক্ষে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন হার্মান কালেনবাখের মতো ইহুদি বুদ্ধিজীবী, যিনি গান্ধীজির সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিনিক্স আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতেও সহযোগিতা করেছিলেন। কালেনবাখ ছাড়াও হেনরি পোলক ও এল ডাব্লু রিশের মতো গান্ধীজির একাধিক বিশিষ্ট ইহুদি বন্ধু ছিলেন।
খ্রিস্টধর্ম যেভাবে পশ্চিমের সমাজে ইহুদিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছিল, তার তীব্র নিন্দা গান্ধীজি একাধিক লেখায় করেছেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ভারতবর্ষে অস্পৃশ্যতার ভেদাভেদের মতোই পাশ্চাত্য সমাজেও খ্রিস্টধর্মীরা ইহুদিদের সম্পর্কে একইরকম নিন্দনীয় মনোভাব পোষণ করে। ইহুদি সমাজের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা এবং বন্ধুত্বের মনোভাব থাকা সত্ত্বেও নীতিগতভাবে তিনি প্যালেস্তাইনের মানুষকে উচ্ছেদ করা ও তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হরণ করে ইজরায়েল নামক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রীতিমতো বিরোধী ছিলেন। যদিও সময়ের সঙ্গে ইহুদিদের ওপর পাশ্চাত্য সমাজে অত্যাচার যত বাড়তে থাকে, ততই গান্ধীজির মনোভাব কিছুটা নরম হয়। ১৯৩৭ সালে ৪ জুলাই বিশ্ব ইহুদি সঙ্ঘের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁর একটা আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় ইহুদি সঙ্ঘ কালেনবাখকে প্রতিনিধি দলের নেতা করে পাঠিয়েছিল প্রস্তাবিত ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি গান্ধীজির সহানুভূতি আদায় করতে।
অর্ধশতাব্দী ধরে এই আলোচনার সারমর্ম গোপন ছিল। সেন্ট্রাল জায়নিস্ট এজেন্সি, জেরুজালেম পরবর্তীকালে তা আনক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট হিসেবে প্রকাশ করে। এই আলোচনায় গান্ধীজির প্রথম পরামর্শ ছিল ব্রিটিশের সমস্ত ম্যান্ডেট ও চুক্তি অগ্রাহ্য করে খোলা মনে পরিস্থিতিটা ভাবতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুই দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনায় সমাধান সূত্র বের করতে হবে। আর তিন, কোনও অবস্থাতেই ব্রিটিশ ও অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তিগুলি প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে তাদের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেছিলেন, আরবদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে হবে এবং সেখানে ইহুদিদের ধর্মীয় দাবি পরিত্যাগ করে এগোতে হবে। যেটুকু স্বেচ্ছায় ফিলিস্তিনিরা দিতে রাজি থাকবে, সেটুকু নিয়েই ইহুদিদের খুশি থাকতে হবে। বলা বাহুল্য, গান্ধীজির এই সমাধান সূত্র ইজরায়েলপন্থীরা গ্রহণ করেননি। বন্ধু কালেনবাখের দৌত্য এবং ইহুদিদের প্রতি নাৎসি নির্মমতার খবর গান্ধীজিকে কিছুটা হলেও সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল ইহুদিদের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর লিখছেন, প্যালেস্তাইন বিলংস টু দ্য আরবস অ্যাজ ইংল্যান্ড বিলংস টু দ্য ইংলিশ অর ফ্রান্স টু দ্য ফ্রেঞ্চ। ‘দ্য জুইস’ নামে হরিজন পত্রিকায় এই লেখাটা বেরিয়েছিল। এই লেখায় গান্ধীজি ইহুদিদের ইজরায়েলের দাবি পরিত্যাগ করতে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ বৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু সে সময় জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম ইউরোপে ইহুদি সম্প্রদায় যে ভয়ংকর বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে, তার প্রতি গান্ধীজি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল নন এটা অনেকেরই মনে হয়েছিল। ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই এর ফলে গান্ধীজির মন্তব্যে মর্মাহত হন ও গান্ধীজির প্রতি ক্ষুব্ধ হন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের ক্ষোভ গান্ধীজির কাছে লিখিত আকারেও পাঠিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে গান্ধীজির আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয়। যার শিরোনাম ছিল ‘জুইস অ্যান্ড প্যালেস্তাইন’। এই প্রবন্ধে তিনি ইহুদিদের প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতিশীল থেকেও যে রক্তাক্ত পদ্ধতিতে ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে, তার তীব্র সমালোচনা করেন। যেভাবে তাদের ঘেটোবন্দি করা হয়েছিল, তার তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। একথাও বলেন যে, যখন একজন ব্যক্তি-ইহুদি কোনও ভুল করে, তখন দেখা যায় সমস্ত ইহুদি জাতির প্রতি ঘৃণা বর্ষিত হয়; অথচ যখন ইহুদিদের মধ্যে থেকে একজন আইনস্টাইন উঠে আসেন, তখন বলা হয় এ হল ব্যক্তিগত প্রতিভা! ঘৃণা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ যেভাবে পাশ্চাত্য সমাজে ইহুদিদের কোণঠাসা করেছে, তার তীব্র সমালোচনা তিনি করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ইজরায়েল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে একটা জরুরি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘হোয়াই শুড দে রেসর্ট টু ‘টেররিজম’ টু মেক দেয়ার ফোর্সিবল ল্যান্ডিং ইন প্যালেস্তাইন?’’
তাঁর পশ্চিম এশিয়া সম্পর্কে ধারণা ও বিশ্ব রাজনীতির তৎকালীন ওঠাপড়া সম্পর্কে ধারণা কতটা ঠিক ছিল, বা কতটা ভুল ছিল সে আলোচনায় না গিয়ে বলা যায় যে, ইজরায়েল একটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের মডেল হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে, সে কথা তিনি আন্দাজ করেছিলেন। আর আখেরে তা প্যালেস্তিনীয়দের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে, সে কথা তিনি সম্যক বুঝেছিলেন। আমার মনে হয় চারটি বিষয় তাঁকে নীতিগত অবস্থান নিতে সাহায্য করেছিল। এক, ঔপনবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মৌলিক শর্ত হল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে আপোষহীন মনোভাব। যা তিনি প্যালেস্তাইন বিষয়ে দেখিয়েছেন। দুই, অহিংসা ছিল তাঁর প্রধান নৈতিক অবস্থান। ইজরায়েল সেখানে গোড়া থেকেই বাহুবল ও অস্ত্রবলের ওপর প্রতিষ্ঠা পেতে চেয়েছিল। ফলে ইজরায়েলকে তিনি কখনওই মেনে নিতে পারেননি। তিন, ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের বিপদ তিনি বুঝেছিলেন। তাই ইহুদি বনাম মুসলমান এরকম ভাগাভাগিতে তাঁর আপত্তি ছিল। চার, পশ্চিমের জাতি-রাষ্ট্রের মডেলটির প্রতি তিনি যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। তার রূপ কী হতে পারে, তা তাঁর অজানা ছিল না। আর ইজরায়েল যেন হয়ে উঠতে চাইছিল জাতি-রাষ্ট্রে এক উদগ্র মডেল। তাই ইজরায়েল গঠনে তাঁর অনুমোদন ছিল না। বরং তাঁর পূর্ণ নৈতিক সমর্থন ছিল ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি।