পহেলগাঁওয়ের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কাশ্মীরের মানুষের কী অশ্বডিম্ব উপকার করবে? এক বিন্দু উপকার করবে– এমন দাবি করবে বিশ্বসংসারে এমন নিরেট মূর্খ আছে কি? সবচেয়ে বড় কথা, এই ধরনের সন্ত্রাস ভারতের মুসলমানদের অস্তিত্বকে নানাভাবে বিপন্ন করে তোলে, তা বোধহয় আইএসআই বা তার কর্তারা খেয়াল করে না। ভারতে সাম্প্রতিককালে যুদ্ধং দেহি হিন্দুত্বের যে চর্চা বিজেপি আর তার পৃষ্ঠপোষক আরএসএস করে চলেছে, রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী আর অন্যান্য ‘কারিয়ক্রম’-এর মধ্য দিয়ে– তার লক্ষ্য শুধু পাকিস্তান নয়, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ অধিবাসী মুসলমানেরাও।
গত ২২ এপ্রিল ভারতীয় কাশ্মীর (Kashmir) এলাকার পহেলগাঁওয়ের বৈসরনে যে জঙ্গি হানায় (Terror Attack) ২৬ জন ভারতীয় পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে, সে ঘটনা মর্মন্তুদ ও ভয়াবহ– তা নিয়ে নিয়ে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত শোকবিবরণ আমরা পেয়েছি, তার পুনরাবৃত্তি এখানে দরকার নেই। মানবতার বিরুদ্ধে এ আর-এক জঘন্য অপরাধ– এই কথাটাও পুনারবৃত্তিক্লিষ্ট, কারণ প্যালেস্তাইনে হোক, ইউক্রেনে হোক, ছোট আকারে বাংলাদেশে হোক– এ ধরনের অপরাধ হয়েই চলেছে। আমাদের আঘাত, বিস্ময়, ধিক্কার, বিবমিষা– কোনও কিছুর তোয়াক্কা না রেখেই।
এই ঘটনা কি বিশ্বব্যাপী যে ছোটবড় রাজনৈতিক ধর্মসংঘাত চলছে, তারই এক আকস্মিক ও আঞ্চলিক সংস্করণ? ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট উপমহাদেশে তার তো একটি নিজস্ব চরিত্রই তৈরি হয়েছে। সর্বনাশা ও ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে জাতীয়তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, তাকে ‘ভ্রান্ত’ প্রমাণ করেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, আবার তাকেও ভ্রান্ত, অর্থাৎ জিন্না সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্বই যথার্থ, তা প্রমাণ করতে প্রস্তুত হয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জনশাসন। কিন্তু পাকাপাকি কোনও সিদ্ধান্তে এখনও কেউ পৌঁছতে পারেনি, কোনও দিন পারবে বলেও মনে হয় না।ফলে এই উপমহাদেশে বিশেষত হিন্দু-মুসলমানের গোষ্ঠীগত অস্তিত্বে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, নাগরিকদের শান্তিতে বসবাসের জন্য যা অত্যাবশ্যক। একদিকে পাকিস্তানের নানা রকম জঙ্গি চক্রান্ত ও তৎপরতা, অন্যদিকে ২০১৪-র পরে ভারতে হিন্দুপ্রাধান্যবাদী বিজেপির উত্থান– কোনও ঘটনাই সে ভারসাম্য নির্মাণের পক্ষে সহায়ক হয়নি।
এই সময়েই কেন এই আক্রমণ ঘটল, তার কারণ হিসেবে অনেকেই ভারতীয় মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যাপারে ভারত সরকারের হস্তক্ষেপের বিষয়টির উল্লেখ করছেন। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের দাঙ্গার নেপথ্যেও নাকি ওই উদ্যোগ। আমি যতদূর বুঝেছি, ওয়াকফ সম্পত্তিগুলির কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোথাও কোথাও ব্যাপক দুর্নীতি ঘটেছিল, সমষ্টির সম্পত্তি ব্যক্তিগত কুক্ষীতে চলে আসছিল, অর্থেরও নয়ছয় ঘটেছিল। তা নিয়ন্ত্রণ করার ‘সাধু’ চেষ্টায় বিজেপি সরকার ওয়াকফের কমিটিতে অ-মুসলমানদের প্রবেশের একটি রাস্তা খুঁজছিলেন। এটা কি তাঁদের উর্বর মাথায় ঢুকেছিল যে, তাতে মুসলমানদের সম্প্রদায় হিসেবে অবিশ্বাসযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য করে তুলে ধরা হয়? আর অ-মুসলমানরা, নিশ্চয়ই তারা সরকারের পেটোয়া লোকই হবে, তারাই বা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে– তা কি আগে থেকে বলা যায়? এই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিত না করেও সরকার কেন মুসলমান প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের পরামর্শ নিয়ে সম্ভাব্য প্রতিবিধান খোঁজেনি, তা আমি জানি না। খুঁজেছিল কি? পাঠকেরা আমার অজ্ঞতা সংশোধন করবেন।
যাই হোক, ওয়াকফ কমিটি নিয়ে এই সরকারি উদ্যোগ যদি দাঙ্গা বা নিরীহ মানুষের হত্যায় এক শ্রেণির মানুষকে প্রবৃত্ত করে তার কোনও সমর্থন কোনও স্থিরবুদ্ধি মানুষ করবে না, তা সে যে সম্প্রদায়েরই হোক। তাই শুধু সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানরা নন– মনে রাখতে হবে, তাঁদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধানরাও আছেন– সর্বস্তরের মানুষ– হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-শিখ বা তার বাইরেও যত আছে সব– একবাক্যে নিন্দা করেছে। আমি নেতাদের নিয়ে খুব পীড়িত নই। ওমর আবদুল্লা বা তারিগামি কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তা নিশ্চয়ই আমার কাছেও এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি আলোড়িত করেছে টাট্টু ঘোড়ার সহিস কাশ্মীরি যুবক আদিলের আত্মদান, যে এক জঙ্গির হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিতে গিয়েছিল। আমি দেখেছি ২২ তারিখেই কাশ্মীরের মানুষ প্রতিবাদ-মিছিল করে এই বীভৎস হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে। সেই প্রতিবাদ এখনও কাশ্মীরের প্রতিটি জনপদে ধ্বনিত হচ্ছে। ২৩ এপ্রিলের কাশ্মীরের সংবাদপত্রগুলি প্রথম পৃষ্ঠা কালো রঙে ছাপিয়েছে এই ঘটনার প্রতি তীব্র বিরাগ ও ধিক্কার জানিয়ে। ২৩ তারিখ একটি সর্বাত্মকভাবে সফল ধর্মঘটও হয়েছে কাশ্মীর জুড়ে। আমি জানি কাশ্মীরের সমস্ত সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় পীড়িত ও মর্মাহত।
২.
এমন হওয়াই তো স্বাভাবিক। নিরীহ মানুষ, যারা কোনও শত্রুতার লক্ষ্য নিয়ে কাশ্মীরে গিয়েছে, একথা কোনও নৃশংস সন্ত্রাসীরও বলার স্পর্ধা নেই, তাদের প্রতি মানবিক সমবেদনা তো আছেই। আমি তাকে ছোট করে দেখছি না। কিন্তু কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের দুঃখ ও বেদনার কারণ তো আরও কাছের, তাঁদের দৈনন্দিন অস্তিত্বের সঙ্গে, তাঁদের বাঁচা-মরার লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িত। ভারতীয় পর্যটক হল কাশ্মীরি অর্থনীতির প্রাণ। ভূস্বর্গ কাশ্মীরে সারা পৃথিবী থেকেই পর্যটক নিশ্চয়ই আসে, ডাল ও অন্যান্য লেকে শিকারায় থাকে, হোটেলে থাকে, টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে লেকের ধারে, রাজপথে বেড়ায়, মন্দির-মসজিদ, আপেলের বাগিচা, চিনার গাছের সারি, টিউলিপ ফুলের বাগান বা দূরে বরফে ঢাকা পাহাড় ও উপত্যকা ইত্যাদি প্রকৃতিশোভাময় স্থান দেখতে যায়; কাশ্মীরি শাল, শুকনো ফল, শীতের পোশাক, কারুকার্যময় হস্তশিল্প ও বাসনকোসন ইত্যাদি কেনে এবং তাদের কাছ থেকে পাওয়া উপার্জনেই কাশ্মীরের মানুষ অনেকটা দিনাতিপাত করে। এই লেখকও তো গরম পড়ার পর থেকে ফেসবুকে ওয়াট্স্যাপে প্রিয় মানুষদের কাশ্মীর ভ্রমণের বিবরণ পড়ছে, তার ছবি দেখছে, তাদের আনন্দের স্বাদ যেন তাকেও ছুঁয়ে গিয়েছে বারবার।
শুধু বাইরের মানুষই কাশ্মীরে যায় তা নয়। কাশ্মীরের মানুষও এক সময় কাশ্মীর থেকে বেরিয়ে পড়ে, ভারতের দূর দূরান্তে শাল, মাফলার, শীতের পোশাক, শুকনো ফল ইত্যাদি নিয়ে যায়। পথে পথে হাঁকে, অনেক গৃহস্থের সঙ্গে স্থায়ী আত্মীয়বন্ধুর মতো হয়ে যায়। আমাদের বন্ধু আর আত্মীয়দের এরকম একাধিক কাশ্মীরি চাচা-ভাতিজা-বেরাদর আছে, যারা বছরে একবার করে আসে, কখনও তাদের সঙ্গে থাকেও। সেখানে কে কোন ধর্মের, কোন অঞ্চলের, কী কার বৃত্তি, কোনও বিবেচনাই আসে না। তো পহেলগাঁওয়ের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কাশ্মীরের মানুষের কী অশ্বডিম্ব উপকার করবে? এক বিন্দু উপকার করবে– এমন দাবি করবে বিশ্বসংসারে এমন নিরেট মূর্খ আছে কি? তা কি ওয়াকফ সমস্যার সমাধানে কোনও সাহায্য করল? ভারতীয় মুসলমানরা আন্দোলন ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তাঁদের কথা জানাচ্ছেন, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষ জনমত যেমন তাঁদের সমর্থন করছে, তেমনই আদালতও এই চেহারায় আইনটিকে গ্রহণ করতে রাজি নয়, তা বোঝাই যাচ্ছে। তো কীসের জন্য এই ভয়াবহ অমানবিক নিষ্ঠুরতা ?
এর নেপথ্যে যদি পাকিস্তান থাকে, বা অন্য কোনও রাষ্ট্র, তাহলে তাদের বুঝতে হবে যে এই সাংঘাতিক খেলায় তাদের কোনও স্বার্থের কণামাত্র সিদ্ধি হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। ভারত প্রত্যাঘাত করবেই জানা ছিল, এবং তার ফল পাকিস্তানের পক্ষে কি আনন্দের হতে চলেছে? সিন্ধুর জলবণ্টন চুক্তি বাতিল হল, তো পাকিস্তান তার ফল বুঝবে। ভারতের উপর পাকিস্তানকে খুব সামান্য সামান্য জিনিসের জন্য নির্ভর করতে হয়, এ কথা এই লেখক ২০০১ সালে পাকিস্তানে গিয়ে তখনকার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কাছে শুনেছিল। শুনেছিল যে, পান আর নুনের মতো জিনিসও ভারত থেকে নিতে হয় পাকিস্তানকে। জানি না, এখন তার কিছু সুরাহা হয়েছে কি না।
সবচেয়ে বড় কথা, এই ধরনের সন্ত্রাস ভারতের মুসলমানদের অস্তিত্বকে নানাভাবে বিপন্ন করে তোলে, তা বোধহয় আইএসআই বা তার কর্তারা খেয়াল করে না। কোনটা আগে আর পরে ঘটেছে তা নিয়ে ঐতিহাসিকেরা বিবাদ করুন, কিন্তু ভারতে সাম্প্রতিককালে যুদ্ধং দেহি হিন্দুত্বের যে চর্চা বিজেপি আর তার পৃষ্ঠপোষক আরএসএস করে চলেছে, রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী আর অন্যান্য ‘কারিয়ক্রম’-এর মধ্য দিয়ে– তার লক্ষ্য শুধু পাকিস্তান নয়, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ অধিবাসী মুসলমানেরাও। আমরা জানি পাকিস্তানের কাছে ভারতের কাশ্মীর এক মনোবেদনার কারণ, কিন্তু শত মনোবেদনার কারণ হোক, তা কখনও পাকিস্তানের অংশ হবে না। একাধিক যুদ্ধে পাকিস্তানের যদি সে শিক্ষা না হয়ে থাকে তবে সে মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। ইসলামের পরিচয় তার সুরক্ষার বর্ম হবে না– আফগানিস্তানের ইসলামি স্বৈরশাসন তার প্রাণের বন্ধু হয়নি। আবার ইদানীংকালে পুবদিকের বাংলাদেশের কিছু অপরিণতবুদ্ধি জনমত (জানি তা বাংলাদেশের সচেতন জনমতের অংশ নয়) পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পুবের কিছু অংশ নিয়ে এক বৃহৎ ইসলামি রাজ্য গঠনের বাতুল কথকতা ছড়াচ্ছে, তারও কোনও সুদূর সম্ভাবনা নেই।
ধর্মচিহ্নের বাইরে গিয়ে নিছক মানুষ হিসেবেই আমাদের উপমহাদেশে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে বাঁচতে হবে, এই নিয়তি যদি আমরা মেনে না নিই, তাহলে হিন্দু-মুসলমান সহ সকলেরই সমূহ সর্বনাশ ঘটবে। এই সহযোগিতা নানামাত্রিক: চাল-ডাল-আলু-ডিমের সঙ্গে, বিদ্যুৎ সরবরাহ আর নানা উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে, শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্যান্য দক্ষতা ও বইপত্র সাহিত্যসংস্কৃতির ব্যাপক আদানপ্রদান। ভারতের মাটিতে যেসব মুসলমান জন্মেছেন সেখানে তাঁদের জন্মগত অধিকার, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মাটিতে যেসব হিন্দু বা শিখ জন্মেছেন, সেখানে তাঁদের। ওয়াকফ সমস্যার সমাধানে ভারতীয় মুসলমানদের মতামতই গৃহীত হোক, তা আমরাও চাই। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়াতে সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে কোনও দেশের সীমানা বদলের অবাস্তব স্বপ্ন যেন কেউ না দেখে।
আমাদের এই বিভ্রান্ত প্রজন্ম যেন পরের প্রজন্মগুলিকে একসঙ্গে বাঁচার সহজ শিক্ষা দিয়ে যেতে পারি।
কবির কোনও ভ্যানিটি ছিল না। যেখানে সেখানে বসে পড়তেন চায়ের ঠেকে। কেউ চাইলেই এক টুকরো কাগজে কোনও কবিতার লাইন লিখে দিতেন। তারপর সেটার কী হত, জানতেও চাইতেন না। এমনিই ছিল তাঁর সরল জীবন-যাপন। সেই প্রয়াত কবি অরুণ চক্রবর্তীকে নিয়ে এই বিশেষ স্মৃতিচারণা।