Robbar

নজরুলের কবিতার কোনও উত্তরসূরি যদি থাকেন, তিনি ভারভারা রাও

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 27, 2024 4:39 pm
  • Updated:November 27, 2024 4:39 pm  

আজ যখন মাত্র দশ জন ধনকুবের এর হাতে দেশ বেঁচে দিল্লি এখন গ্যাস চেম্বারে পরিণত, আমাদের জল, জমিন, জঙ্গল সব দখল করতে চাইছে বাজার, অনেক কষ্ট এর মাধ্যমে অর্জন করা আট ঘণ্টা শ্রম ভুলে গিয়ে গিগ কর্মীরা পুঁজির বাজারের দাসে পরিণত হয়েছে আর তবুও পান চিবোতে চিবোতে আমরা বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে বলছি– তখন আরও বেশি করে দরকার নজরুল ইসলামের ও ভারভারা রাওয়ের।

মৌমিতা আলম

বন্দুক উঁচিয়ে সেনাবাহিনী, গুলিতে লুটিয়ে পড়ছে তরতাজা প্রাণ, তবুও গাইছে–

কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী..

Kazi Nazrul Islam | Learning and Creativity - Silhouette
কাজী নজরুল ইসলাম

পাশের দেশ বাংলাদেশে এই দৃশ্যে শিহরন জাগেনি এমন লোক নেই। প্রতিরোধ ও বিপ্লবে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষকে সাহস জুগিয়েছে বন্দুকের নলকে কবিতায়-গানে পরাজিত করার এই দৃশ্য। সেই প্রতিরোধের ছোঁয়া আমারও মনে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ যাকে বলা হচ্ছে, সেই সময়ে ঘটনাচক্রে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাসে আমি শুরু করছিলাম নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটি লেখা। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা তো সবাই কাজী নজরুল ইসলামকে চেনো?’ সবাই চুপ। ওপার বাংলায় যখন নজরুল ইসলামের গান, কবিতাকে ঢাল করে নিরস্ত্র বাঙালি শাসকের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে, এপার বাংলায় বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ‘বিদ্রোহী কবি’। ক্লাস শেষে টিচার্স রুমে ফিরে এক শিক্ষক ভাইকে বললাম ঘটনাটা। সে বলল, নজরুল তো বাংলাদেশের! আরও স্পষ্ট হল– আমাদের বিস্মৃতির অন্তর্জলি যাত্রা।

যখন জানতে পারলাম, আমাদের প্রিয় কবি ও কমরেড ভারভারা রাও নজরুল ইসলামের কবিতা তেলুগুতে অনুবাদ করছেন, আর তা বই আকারে বেরোবে, প্রথম কথা যেটা মনে হল, ভারতে যদি এখন নজরুলের কবিতার সত্যিই কোনও যোগ্য উত্তরসূরি থাকে সেটা ভারভারা রাও।

Varavara Rao seeks bail on medical grounds due to inadequate prison hospital
ভারভারা রাও

জীবনের বেশি সময় জেলে কাটানো ভিভি অনুবাদ করছেন নজরুলকে! এক বিপ্লবী ছুঁয়ে দেখছেন আর এক জন বিপ্লবীর শব্দ! ভাষা আলাদা হলেও স্বপ্ন তো একই– মুক্তির স্বপ্ন, স্বাধীনতার স্বপ্ন আর কবে দেশ, ভূখণ্ডের বেড়াজাল মানে! তাই তো আমাদের মুক্তির প্রশ্নে, মুক্তির দাবির স্লোগান হয়ে ওঠেন ফইজ থেকে নেরুদা।

একদিকে সংখ্যাগুরুর উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিজম, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের মধ্যে বাড়ন্ত ধর্মীয় মৌলবাদ– এই দুইয়ের মাঝে নজরুল ইসলাম আর তাঁর প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির চেতনা থেকে। ভারভারা রাও-এর অনুবাদিত বিদ্রোহী কাব্যগ্রন্থে মোট ৬৪টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবি ও কমরেড ভারভারা রাও যখন বলেন কাব্যগ্রন্থটির ভূমিকা আমায় লিখতে হবে, আমার মনের মধ্যে চেপে বসল দ্বিধা– সত্যিই কি আমি যোগ্য লোক! কিন্তু নজরুল এবং ভিভি– স্বাধীনতার পালে মুক্তির হাওয়া সাহস জোগালো।

নয়ের দশকেও নজরুল ইসলামের সম্বন্ধে কথা হত আমার নিজের কমিউনিটিতে, হত নানারকম অনুষ্ঠান, কিন্তু একদিকে পুঁজির বাজারের তালা ও অন্যদিকে রাম জন্মভূমি আন্দোলনের তালা খোলার পর বদলে গেল সব সমীকরণ। তারপর জামাতের আবির্ভাব পীরের দরগায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সিন্নি দেওয়া মুসলিমদের সমাজে। নজরুল গীতির বদলে খোলা মাঠে ছড়িয়ে পড়ল জলসা। হিজাব হয়ে উঠল অত্যন্ত চেনা একটি শব্দ, যেমন দাড়ি-টুপি দেখলেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ– এই যে লাদেন! ততদিনে ঘটে গিয়েছে ৯/১১!

……………………………………………

একদিকে সংখ্যাগুরুর উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিজম, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের মধ্যে বাড়ন্ত ধর্মীয় মৌলবাদ– এই দুইয়ের মাঝে নজরুল ইসলাম আর তাঁর প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির চেতনা থেকে। ভারভারা রাও-এর অনুবাদিত বিদ্রোহী কাব্যগ্রন্থে মোট ৬৪টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবি ও কমরেড ভারভারা রাও যখন বলেন কাব্যগ্রন্থটির ভূমিকা আমায় লিখতে হবে, আমার মনের মধ্যে চেপে বসল দ্বিধা– সত্যিই কি আমি যোগ্য লোক! কিন্তু নজরুল এবং ভিভি– স্বাধীনতার পালে মুক্তির হাওয়া সাহস জোগালো।

……………………………………………

কবিদের কি ঘর হয় কখনও? দেশ হয়? ২৩ নভেম্বর হায়দরাবাদ প্রেস ক্লাবে যখন শুরু হল নজরুল ইসলামের কবিতার বই তেলুগু ভাষায় প্রকাশের অনুষ্ঠান, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গান দিয়ে, আবারও প্রমাণিত হল– কবিদের দেশ হয় না। প্রতিরোধের ভাষা চাপিয়ে গেল আক্ষরিক ভাষাকে।

নজরুল ইসলাম ও ভারভারা রাও– দু’জন তাঁদের নিজস্ব সময়ের সেরা হার না মানা স্বপ্ন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল লিখছেন,

আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্
ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য।
আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর–
চির উন্নত মম শির।

123rd birth anniversary of Kazi Nazrul Islam being celebrated | Prothom Alo
বিদ্রোহী কবি: তরুণ নজরুল

সেই একই স্বপ্ন যাপন ও ধারণ করে ভারভারা রাও লিখছেন তাঁর ‘শিকল এখন লেখে’ (Chains Write Now) কবিতায়:

তোমার ছায়া তোমায় সত্যি কথা বলছে না
তুমি যা শুনতে চাও তাই বলছে
তুমি জেলের বাইরে থেকেও একা
আমি জেলের ভিতর থেকেও আছি অনেকের মাঝে
আমার বিশ্বাস আমার সঙ্গী
যে বিশ্বাস জনগণের সাথে একসাথে
একদিন লাভা হয়ে উদগীরিত হবে
যদিও এখন এটা সুপ্ত।

এই লম্বা বন্দীত্বে
আমি আমার চিন্তায় শান দিচ্ছি।
ও স্বেচ্ছাচারী শাসক
আমার শিকল এখন লিখছে
আগামীকাল আমি আবার গলা খুলে
স্বাধীনতার গান গাইব।

অনমনীয় ভিভি

একই স্বপ্ন ও বিপ্লবের প্রশ্নে অটল দুই স্বপ্নদর্শীর মিলন হয় ভারভারা রাও অনুবাদিত তেলুগু ভাষায় অনূদিত কবিতা সমগ্র বিদ্রোহী-তে। ভারভারা রাও জানান জেলে তাঁর সঙ্গে থাকত নজরুল ইসলামের কবিতা। কতটা বিপ্লব শব্দে যাপন করলে ফিরে ফিরে আসা যায় প্রিয় কবির শব্দে, অন্য ভাষার মানুষ হয়েও!

নিজের জন্মস্থান পশ্চিম বাংলায় নজরুল ব্রাত্য। নজরুল চর্চা কিছু মানুষের কাছে শুধুই গবেষণার কাগজে আটকে। ১৯৭২ সালে পশ্চিম বাংলা ছেড়ে চলে যাওয়া নজরুল সম্বন্ধে বলতে গিয়ে অনেক পণ্ডিত মানুষ বলেন, নজরুল হয়তো আজ আর অত প্রাসঙ্গিক নন! আসলে যে মাটি নকশালবাড়ির জন্ম দিয়েছে, সেই মাটির সন্তানেরা নিজেদের শিরদাঁড়া বন্ধক দিয়ে এখন আধো বাংলা আর আধো হিন্দি মেশানো ভাষায় কম শয়তান, বেশি শয়তান এর তুলনা খুঁজে ভোট বাক্সে বিপ্লব খোঁজে! সেই বাংলায় নজরুল সম্বন্ধে এমন মন্তব্য শোনা স্বাভাবিক। কোনও পণ্ডিত অবশ্য এটাও বলেন, নজরুলের কবিতায় ক্রাফটসম্যানশিপ এর অভাব! এ অবশ্য চিরদিনের সমস্যা। কবিতা প্রতিবাদী হলেই তাকে স্লোগান বলে দেগে দিয়ে মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার বামুনবাদী প্রয়াস।

Kazi Nazrul Islam - Wikiwand

আজ যখন মাত্র দশ জন ধনকুবের এর হাতে দেশ বেঁচে দিল্লি এখন গ্যাস চেম্বারে পরিণত, আমাদের জল, জমিন, জঙ্গল সব দখল করতে চাইছে বাজার, অনেক কষ্ট এর মাধ্যমে অর্জন করা আট ঘণ্টা শ্রম ভুলে গিয়ে গিগ কর্মীরা পুঁজির বাজারের দাসে পরিণত হয়েছে আর তবুও পান চিবোতে চিবোতে আমরা বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে বলছি– তখন আরও বেশি করে দরকার নজরুল ইসলামের ও ভারভারা রাওয়ের।

ভারভারা রাও অনূদিত ‘বিদ্রোহী’

ভারাভারা রাও অনূদিত নজরুলের এই কাব্যগ্রন্থ– ‘বিদ্রোহী’ নিশ্চিত ভাবেই তেলুগু ভাষী ছাত্র, যুব ও বিপ্লবের পথে অনড় থাকা মানুষদের স্বপ্ন দেখাবে, সাহস জোগাবে। আর ক্রাফটসম্যানসিপ, নান্দনিক চিবানো বাঙালিদের জন্য থাকল আর এক বিপ্লবী কবি সরোজ দত্তের এই কথাগুলো:

কবিতা স্লোগান হয়ে উঠছে বলে
দুঃখ করছো
যদিও স্লোগান কবিতা হয়ে উঠেনি বলে দুঃখ করোনি
আমার দুঃখ এখানেই।

……………………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………………….

স্লোগান নাকি কবিতা– এসব বাতলামি ভুলে ভারভারা রাও ফিরিয়ে দিলেন নজরুলকে ভারতের মাটিতে। বিপ্লব কখনওই ক্ষণজীবী নয়, শুধু রিলে রেস এর মতন ব্যাটন পাল্টে আসে, এবার নজরুল ইসলামের কবিতার মশাল তুলে দিলেন ভিভি তরুণদের হাতে… প্রতিরোধের মৃত্যু হয় না কোনওদিন, মশাল জ্বলে ওঠে বিস্মৃতির অন্ধকার থেকেও।