লেডিস কম্পার্টমেন্ট আদতে বাইরে বেরোনো মেয়েদের এমন একটা সেফ হেভেন, যাকে আমরা আলাদা করে খেয়ালই করি না। যেখানে ভিড়ের মাঝে অপূর্ব একা হওয়ার সুযোগে ঘরের দায়দায়িত্ব আর বাইরের কাজের তালিকা থেকে কিছুক্ষণের ছুটি মিলে যায়। কাজ-পেরোনো ঘামের ঘ্রাণ, একলা হওয়া, মাথার ভিতর লুকোনো প্রেম নিয়ে প্ল্যাটফর্মের পর প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে তারা ফিরে আসে চেনা স্টেশনে, কিংবা নিশ্চিন্দিপুরে যাওয়ার আগে লেডিস কামরার কাছে চুপিচুপি বিদায় নিয়ে যায়। প্রেমিক বিশ্বাস ভাঙলে ঘর আর বাইরের নানা চোখের আড়ালে যে চার দেওয়াল কোনও মেয়েকে চোখ মোছার আরাম দেয়, সেও লেডিস কম্পার্টমেন্ট।
কাকভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে, ঘরের উনকোটি চৌষট্টি কাজ সেরে, যে মেয়েটি ঘরে টাকা আনার জন্য ছুটে বাইরে বেরচ্ছে এবার, তার মনে লাইটহাউস হয়ে আছে একটা লেডিস কম্পার্টমেন্ট। যে মহিলা শ্বশুর-শাশুড়িকে চা-জলখাবার খাইয়ে, স্বামীর অফিসের ভাত বেড়ে আর টিফিন গুছিয়ে, সন্তানকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে আর টিফিনবক্সে গ্রিলড স্যান্ডউইচ ভরে স্কুলে পাঠাতে গিয়ে নিজে আর মুখে কিছু দেওয়ার সময় করে উঠতে পারেননি, কাজে যাওয়ার সময় তাঁর ভরসা হয়ে আছে ওই লেডিস কম্পার্টমেন্ট। ছুটতে ছুটতে মুহূর্তের জন্য বসতে না-পারা মেয়েটির, মেয়েদের ভরসা– অইখানে তার জন্যে, তাদের জন্য তুলে রাখা আছে একচিলতে বসার পরিসর। অবসরও।
ওহো, মেয়েদের বসার কথা আবার খোলাখুলি বলা মুশকিল। আরামে বা কষ্টেসৃষ্টে যাই হোক, মেয়েরা একটুখানি হাত পা গুটিয়ে বসতে পেলে পুরুষদের একাংশ যে ভারী চটে যান, এ লোকাল ট্রেনের অভিজ্ঞতায় সামনে থেকেই দেখা। লেডিস কম্পার্টমেন্ট নিয়ে তাঁদের ভারি গোঁসা! অনেকেরই ধারণা, ‘লেডিস কম্পার্টমেন্ট’ নামক বিষয়টি আসলে গড়ের মাঠেরই একটা লোকাল ট্রেন ভার্সন! তাই লেডিসে সব্বাইকে তুলে দেওয়া যায়। বেড়াতে যাওয়ার সময় বড় বড় বাক্সপ্যাঁটরা-সহ বউ, যে কোনও প্রকার বাচ্চা এবং বুড়ো মানুষ, বস্তাভর্তি সবজি, বিক্রি হওয়ার জন্য ছাগল, সব কিছু। উঁহু, দু’পেয়ে নয়, একেবারে চারপেয়ে ছাগলই বটে। একদিন বর্ধমান থেকে নৈহাটি ফেরার পথে ব্যান্ডেল লোকালে উঠে সত্যিই দেখেছিলাম, লেডিস কম্পার্টমেন্টের করিডরে বাঁধা এক ছাগল, আর তার সামনে স্তূপীকৃত কাঁঠালপাতা। লেডিস কম্পার্টমেন্টের কথা জানা থাকলে হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন মেলা থেকে কেনা গাধাটাকে যে ট্রেনের পিছনে রাখতে যেতেন না, সে কথা বলাই বাহুল্য।
সবজির বস্তা নিয়ে অবশ্য যাঁরা ওঠেন, তাঁরা লিঙ্গপরিচয়ে মহিলাই। তবুও বিক্রেতাদের জন্য ভেন্ডার কামরা থাকা সত্ত্বেও যে তাঁরা যাত্রীবাহী লেডিজ কম্পার্টমেন্টটিকেই বেছে নেন, তা থেকে মনে হয় ভেন্ডার কামরাগুলিতেও একরকম পুংলিঙ্গের শাসন চলা অসম্ভব নয়। ভুল হতে পারে, তবুও মনে হয় প্রায় বছর বাইশের ডেলিপ্যাসেঞ্জার জীবনে কখনওই ভেন্ডার কামরায় কোনও মহিলা ব্যবসায়ী বা বিক্রেতাকে উঠতে নামতে দেখিনি। জেনারেল কম্পার্টমেন্ট কিংবা জেনারেল সিট তো লোকমুখে সর্বদাই ‘জেন্টস’, অতএব নির্দ্বিধায় পুরুষশাসিত। নিত্যযাত্রী মেয়েরা জানেন, স্রেফ রুজিরোজগারের তাগিদেই এখন যত সংখ্যক মেয়েকে রোজ ট্রেনে চড়তে হয়, তাতে দুটো লেডিস কম্পার্টমেন্টেও কুলোয় না। তবুও, ঠাসা ভিড়ের মধ্যেও এইটুকু নিশ্চিন্তি, নিজের শরীরটাকে পাহারা দেওয়ার দরকার নেই। আর সেইটুকু সুবিধার জন্যই, লেডিস কম্পার্টমেন্ট মেয়েদের আপন সই।
সই। সখী। সহ্য করাও। এই যে যে-কোনও অসুবিধাজনক জিনিস বা মানুষকে লেডিস কম্পার্টমেন্টে তুলে দেওয়ার দীর্ঘলালিত অভ্যাস, তার সমস্ত ভরসা কায়েম হয়ে আছে মেয়েদের সয়ে নেওয়ার ক্ষমতায়। ঘরে যারা নিত্যদিন এত কিছু সইছে, বাইরে তারা এইটুকু সয়ে নেবে এ তো ভেবে নেওয়াই যায়। অতএব, আদতে সুবিধাবাদী সহাবস্থানই করা যেত। তবুও, লেডিস কামরা দেখলেই কামড় দেওয়ার অভ্যাসও বদলায় না। স্বচক্ষেই দেখা, ট্রেনের সামনের দিকে থাকা একখানা লেডিস কম্পার্টমেন্ট দু’-আধখানা করে সামনে পিছনে ভাগ করে দেওয়া হল, তারপর ন’-বগির ট্রেনগুলো ১২ বগি হওয়ার দরুন সেইসব অর্ধেক কামরা গোটা কামরার মর্যাদা পেল, আর এসবের মধ্যে শিয়ালদা লাইনের নানা শাখায় একসময় চালু করা হল একটি কি দু’টি লেডিস স্পেশাল ট্রেন; আর এইসবের সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিকভাবে বেড়ে চলল পুরুষ যাত্রীদের ক্ষোভ আর বিরক্তি। সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ার এক পোস্টে দেখা গেল, এক বীরপুরুষ সগৌরবে ঘোষণা করেছেন লেডিস কম্পার্টমেন্টে পাথর ছোড়ার বীরত্বটি, কেন-না তাঁর করের টাকায় মহিলাদের আরামে ট্রেনযাত্রা করার সুবিধা দিতে তিনি নারাজ। অফিসটাইমের সবেধন নীলমণি লেডিস স্পেশালে মেয়েদের ভিড় দেখে আন্দাজ করা যায় তা কত কর্মরতা মহিলার পক্ষে সুবিধাজনক, তবুও তা নিয়ে বিরক্তিপ্রকাশে পিছপা নন কোনও কোনও মহিলাও। যাঁরা ট্রেনে ওঠেন কালেভদ্রে, তবে লেডিস স্পেশালে কেন প্রেমিককে নিয়ে ওঠা যাবে না তা নিয়ে কড়া সওয়াল করতে ভোলেন না। অবশ্য লোকাল ট্রেনের সংখ্যা বাড়ালেই যে পরবর্তী ট্রেনের জন্য অপেক্ষার সময় কমে আসত সে কথা তলিয়ে ভাবার দরকার পড়ে না, যেমন ভোট পাওয়া কিংবা না-পাওয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে আমরা স্রেফ লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের প্রতি বিদ্রুপেই উড়িয়ে দেওয়া অভ্যাস করেছি।
মেয়েদের যে-কোনও ‘এক্সক্লুসিভ’ প্রাপ্তির প্রতি সমাজের একটা বড় অংশের মনোভাব ঠিক কেমন, লেডিস কামরা তার ভেন ডায়াগ্রাম আঁকতে পারে দিব্যি। কেবল বাইরে থেকে আসা এইসব পাথর বা মন্তব্য নয়, তার চার দেওয়ালের ভেতরেও পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে যে কতরকমের দড়ি টানাটানি! ট্রেনে মানুষ বসার কিংবা দাঁড়ানোর জায়গার বাইরে আর কী-ই বা পাবে! এদিকে বাইরের জগতে মেয়েদের অংশগ্রহণ যত বেড়েছে, ট্রেনের কামরা তো আর সে অনুপাতে বাড়েনি। ফলে সে জায়গা নিয়ে নিত্য টানাপড়েন। ক্ষণিকের দেখা সহযাত্রীকে তিলেকের বসার সুখ দিতে অনেক মহিলাই নিতান্ত নারাজ হয়ে পড়েন, ফলে সিটের ধারে বসার বদলে ঝুলতে হয় অধিকাংশ যাত্রিণীকেই। ‘কোথায় নামবেন’ এ প্রশ্নের উত্তরে আবার কেউ কেউ এমন তূষ্ণী নীরবতা অবলম্বন করেন যে আশঙ্কা হয়, সুজাতা পায়েসের বাটি হাতেও এ বোধি ভাঙাতে পারতেন না। আসলে, ওই যে না-পাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি অভ্যাস। সংসারে অনেক দেওয়ার বিনিময়ে যেটুকু যা খুদকুঁড়ো জোটে তা দিয়েই টেনেবুনে জীবন সাজানো। অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়। রান্নাঘর হোক কি ট্রেনের সিট, কোনও কিছুকেই কি আঁকড়ে না ধরে থাকা যায়!
ট্রেনের সিট যাঁরা একেবারেই আঁকড়ে ধরেন না, তাঁদের যাবতীয় লোভ দরজার ধারে পাওয়া ধারবাকি হাওয়ার উপর। সেই উমেদারের তালিকায় ঠেলেঠুলে সামনে হাজির সবজিবিক্রেতা কিংবা গৃহপরিচারিকারা। সারাদিনের খাটুনির পর ঘরফিরতি ট্রেনের দরজায় গুছিয়ে বসে তাঁরা টিফিনবাটি খোলেন। সকালে আনা মাখামাখি ভাত-তরকারি কি সন্ধেবেলায় কেনা মুড়ি-তেলেভাজার সস্তা নৈশভোজে মেখে নেন পথের হাওয়ার গন্ধ। জানায় বা অজানায়, লেডিজ কম্পার্টমেন্ট আসলে তার পেটের ভিতর থাকা সব মেয়েদের শরীরেই ওই পথের বাস মাখিয়ে দেয়। যে গন্ধের নাম ছুটি। এমনিতে লেডিস কম্পার্টমেন্ট জুড়ে কাপড় শুকোনোর ক্লিপ, বোতল পরিষ্কারের ওষুধ, মোজা রুমাল টুপির হাঁকডাক। মেয়েরাই কেনে। সংসার যাদের মাথায় বাসা বেঁধে আছে। আবার সেই মেয়েরাই দরদাম করে কেনে সিটি গোল্ডের বালা। শ্রেণি কিংবা শখে যারা আলাদা, তারা বেছে বেছে দ্যাখে রূপদস্তার গয়না, রঙিন ওড়না। ওইটুকু শখ। ওইটুকু মুক্তি। ওইটুকু নিজে। যে নিজের কাছে ফেরা যায় লেডিস কামরার সময়-বাঁধা অবকাশে। কামরার পাশে পাশে দৌড়তে থাকে কন্যাদায়ের চিন্তায় অস্থির বাবা, আবদেরে ভাইবোন, মুখরা শাশুড়ি, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত স্বামী। লেডিস কম্পার্টমেন্ট আদতে বাইরে বেরোনো মেয়েদের এমন একটা সেফ হেভেন, যাকে আমরা আলাদা করে খেয়ালই করি না। যেখানে ভিড়ের মাঝে অপূর্ব একা হওয়ার সুযোগে ঘরের দায়দায়িত্ব আর বাইরের কাজের তালিকা থেকে কিছুক্ষণের ছুটি মিলে যায়। কাজ-পেরোনো ঘামের ঘ্রাণ, একলা হওয়া, মাথার ভিতর লুকোনো প্রেম নিয়ে প্ল্যাটফর্মের পর প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে তারা ফিরে আসে চেনা স্টেশনে, কিংবা নিশ্চিন্দিপুরে যাওয়ার আগে লেডিস কামরার কাছে চুপিচুপি বিদায় নিয়ে যায়। প্রেমিক বিশ্বাস ভাঙলে ঘর আর বাইরের নানা চোখের আড়ালে যে চার দেওয়াল কোনও মেয়েকে চোখ মোছার আরাম দেয়, সেও লেডিস কম্পার্টমেন্ট। গার্লস স্কুলের মতোই লেডিস কম্পার্টমেন্ট বহু মেয়ের বাইরে বেরোনোর ছাড়পত্র। তাই তার দেওয়ালেই ঝুলতে থাকে ‘বাহিরে ঝুঁকিবেন না’-র নিষেধতর্জনীও।
……………………………….
আরও পড়ুন লেডিস স্পেশাল নিয়ে মৌমিতা আলম-এর লেখা: আমরা ক’জন একই ট্রেনে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ
……………………………….
স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন। ঝমঝম করে প্ল্যাটফর্ম পেরনো ট্রেন। গন্তব্যের দিকে ছুটে যাওয়া ট্রেন। তাদের সবার মধ্যে এক-একটা মেয়েদের কামরা। গড়পড়তা মেয়েদের জীবনে যে দাঁড়িয়ে থাকার অবসর নিতান্তই বিরল, আর নিজের জন্য ছুটে যেতে যাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, যেন তাদের সকলের বহু বাসনাকে বুকে চেপে রয়ে যাচ্ছে এক-একটা লেডিস কম্পার্টমেন্ট।
………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………