ভারতের অন্যান্য প্রদেশের পুরুষদের তুলনায় বাঙালি কোথাও যেন খানিক দুর্বল– ভারতীয় পুরুষতন্ত্রের এমন একটা প্রচার আছে। হতে পারে সে কখনও স্বাধীনতা-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নকশাল আন্দোলনে নাম লিখিয়েছিল, সাহিত্য-সিনেমায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হাসিল করেছিল কিংবা খেলায় দেখিয়েছিল দাদাগিরি কিন্তু এখন তার সেসব সাহস কিংবা শক্তির প্রতি অনেকেই সন্দিহান।
৪.
সপ্তগ্রামের ভূমিপুত্র নবকুমার গঙ্গাসাগর থেকে ফেরার সময় পথ হারিয়ে এক নির্জন দ্বীপে এসে উপস্থিত হয়। নৌকাডুবিতে সঙ্গীসাথীদের সলিলসমাধি হলে নবকুমার সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে। গাঢ় অন্ধকার দ্বীপে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা জর্জরিত নবকুমারের যখন প্রায় উন্মাদ হওয়ার উপক্রম, তখন এক পূর্ণিমা রাতে পরমাসুন্দরী এক কন্যা কোথা থেকে হঠাৎ এসে মায়াভরা কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘পথিক! তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ নবকুমার কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। পথ তো সে সত্যিই হারিয়েছে। কিন্তু এই অনাবিল সৌন্দর্যের অধিকারিণী মেয়েটি কী তাকে অন্য কোনও অপূর্ব পথের সন্ধান দিতে পারে? নবকুমারের কথা আটকে যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নায়ক নবকুমার অবশ্য সমগ্র উপন্যাসে খুব যে কিছু পরিচ্ছন্ন বক্তব্য রাখতে পারে, তা নয়। নবকুমারের চরিত্রের একটি দিক তার কোমলতা। যার ফলস্বরূপ এই দীর্ঘসূত্রতা। সময়ের সিদ্ধান্ত সময়ে নিতে পারে না বলে কপালকুণ্ডলার প্রতি তার অনেক ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও একদিন সে তাকে হারিয়ে ফেলে। গভীর দুঃখের নদীতে কপালকুণ্ডলার সঙ্গেই নবকুমারকে ঝাঁপ দিতে হয়। শুধু ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে নয়, বঙ্কিমচন্দ্রের আরও বহু লেখায় বাঙালি পুরুষের এই চারিত্রিক গঠনটি চোখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ এমন চরিত্রকে নির্দ্বিধায় বলেছেন ‘অলসতা’। তরুণ বয়সে স্কুলপাঠ্যে তাঁর ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় পড়েছিলাম– ‘তৈল ঢালা স্নিগ্ধ তনু/ নিদ্রারসে ভরা/ মাথায় ছোটো বহরে বড়ো/ বাঙালি সন্তান!’
এখানে বাঙালি সন্তান বলতে প্রাথমিক ভাবে যে পুরুষদের বোঝানো হয়েছে, তা আমরা জানি। এই এক-দেড়শো বছরে বাঙালি পুরুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি কী এক রয়ে গেছে? সময়ের সঙ্গে সব দেশের, সব কালের মানুষদের চরিত্রগত পরিবর্তন আসে। বাঙালি পুরুষের ক্ষেত্রে কি তা হয়েছে? তবে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়– পরিবর্তন আসুক না আসুক বাঙালি পুরুষের চরিত্র যুগ যুগ ধরে পরীক্ষাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আতসকাচের তলায় এসেছে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ যেমন বাঙালি পুরুষকে সমালোচনার চোখে দেখেছেন, তেমনই পরবর্তীকালে নীরদ সি. চৌধুরী এবং আরও অনেকে ভালোরকম কাটাছেঁড়া করেছেন তার চালচলন, জীবনযাপন নিয়ে। দশকের পর দশক একটা ধারণা যেন বাঙালি পুরুষকে নিয়ে গড়ে উঠেছে যে, সে উদ্যম-উদ্যোগহীন। মিথ্যা আস্ফালন তার স্বভাব। ন’টা-পাঁচটার চাকরি-জীবনের নিস্তরঙ্গতা তার পছন্দ। সে ব্যবসা পারে না। তার আড্ডাকে সময় নষ্ট হিসেবে প্রতিভাত করা হয়েছে। তার জ্ঞানগম্যি-বিদ্যাকে আঁতেল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তার অবয়ব হয়ে উঠেছে টেনশনে-ভোগা, বোরোলিন-জেলুসিলে ভরা, মাঙ্কি-টুপি পরিহিত ভুঁড়িওয়ালা পুরুষের প্রতিফলন। সে ইংরেজিতে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে। ফুটবল আর রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠলে মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠে কেবল। সাপ্তাহিক পাঁঠার মাংসে তার লোভ। মিষ্টি তাকে আরও প্রলোভিত করে। সে সারাজীবন মায়ের আঁচল ধরে থাকা কোনও বাবু, বাবান, বুবু, বুবাই, বাবুসোনা! তার দৌড় খুব বেশি হলে দিঘা-পুরী-দার্জিলিং পর্যন্ত। তাকে যেন সঠিকার্থে পুরুষোচিত বলা চলে না। বাঙালি পুরুষের বিশ্লেষণে ইতিহাস সব সময়ই নির্দয় থেকেছে। কিন্তু কেন?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কোণঠাসা হতে হতে এখন বাঙালি পুরুষের নতুন উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে বাংলাবাদী সংগঠনগুলির প্রচার-প্রয়াসে। তাকে বার বার বোঝানো হচ্ছে ভূমিপুত্র হওয়া সত্ত্বেও তার জমি, তার সংস্কৃতি, তার মানস আর তার অস্মিতা কেড়ে নিচ্ছে অবাঙালিরা। অতএব, বাঙালি পুরুষকে জাগতে হবে। নবজাগরণের ডাকে বাঙালি পুরুষের কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এর কারণ পুরুষ বলতে আমাদের সামনে অতি শক্তিশালী, পরাক্রমী, শারীরিকভাবে তথাকথিত উঁচু-লম্বা এক ব্যক্তিত্বের ছবি এঁকে দেওয়া হয়েছে। তার নরম হলে চলে না। তার সব ক্ষমতাই দৈত্যাকার হওয়া প্রয়োজন। পুরুষতন্ত্র খুব চালাকির সঙ্গে এ-কাজ করে থাকে। এই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে না পারলে সে পুরুষ যেন ঠিক পুরুষোচিত হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু বাঙালি পুরুষ তথাকথিত পুরুষোচিত নয়? ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম যে জাতি প্রায় লড়েছে, ফাঁসিকাঠে অবলীলায় ঝুলেছে, দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দিয়েছে এবং দরকারে গুলি-বন্দুক-বোমার ভাষায় ব্রিটিশদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে তারা যদি পুরুষোচিত না হয় তবে তো পৌরুষের সংজ্ঞা নিয়ে সন্দেহ জাগে! নিস্তরঙ্গ জীবনই যদি চাইবে বাঙালি তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এত মিছিল, মিটিং, সংগ্রাম, আন্দোলনে কেন জড়াবে? কেন সমাজ, ইতিহাস, ধর্ম এবং অন্যান্য সব অচলায়তনকে ভেঙে ফেলার চেষ্টায় উদ্যত হবে সে? কিংবা প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়ে জর্জরিত করবে প্রতিষ্ঠানকে? আর বাঙালি পুরুষ শুধু ন’টা-পাঁচটার চাকরি করেনি সে ভারতীয় চাকরি-সংস্কৃতিতে এনেছে সংগঠনের অধিকার, সঠিক বেতন কাঠামো, চাকরির নিরাপত্তা আর মালিক পক্ষের চোখে চোখ রেখে নিজের মূল্য বুঝে নেওয়ার স্পর্ধা। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এগুলোর দাম নেই তাই বাঙালি পুরুষ সমালোচিত হয়েছে। কর্মী হিসেবে তার অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে চালিয়াতি বলে, কাজ না করে বেতন নেওয়ার ফন্দি বলে। বাঙালি তো শুধু বুদ্ধির চর্চা করেছে তা নয়, সাহিত্য-সিনেমায় দুনিয়াজোড়া নাম করেছে। আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিয়ে এসেছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। কোণঠাসা হতে হতে এখন বাঙালি পুরুষের নতুন উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে বাংলাবাদী সংগঠনগুলির প্রচার-প্রয়াসে। তাকে বার বার বোঝানো হচ্ছে ভূমিপুত্র হওয়া সত্ত্বেও তার জমি, তার সংস্কৃতি, তার মানস আর তার অস্মিতা কেড়ে নিচ্ছে অবাঙালিরা। অতএব, বাঙালি পুরুষকে জাগতে হবে। নবজাগরণের ডাকে বাঙালি পুরুষের কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে!
তবে এও সত্য যে এই আলোচিত বাঙালি পুরুষ; উচ্চজাতির, উচ্চবিত্তের, বিসমকামী পুরুষ, যে সামাজিক সমস্ত সুযোগ-সুবিধাগুলি কয়েক শতক উপভোগ করে এসেছে, সে কিন্তু একই সমাজে তার সমকামী-রূপান্তরকামী প্রতিরূপকে সম্মান তো দূরের কথা, তাদের প্রতি এতটুকু সহমর্মিতা দেখায়নি। জাতিভেদ তার সমাজে নেই বলে সে দাবি করেছে অথচ দেখা গেছে সামাজিক সব ক্ষেত্র জুড়ে বসে আছে কেবল উচ্চজাতির পুরুষেরা। সেদিক থেকে এমনকী, সাহিত্য-সিনেমা-খেলাধূলাও ব্যতিক্রম নয়।
ভারতের অন্যান্য প্রদেশের পুরুষদের তুলনায় বাঙালি কোথাও যেন খানিক দুর্বল– ভারতীয় পুরুষতন্ত্রের এমন একটা প্রচার আছে। হতে পারে সে কখনও স্বাধীনতা-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নকশাল আন্দোলনে নাম লিখিয়েছিল, সাহিত্য-সিনেমায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হাসিল করেছিল কিংবা খেলায় দেখিয়েছিল দাদাগিরি কিন্তু এখন তার সেসব সাহস কিংবা শক্তির প্রতি অনেকেই সন্দিহান। আবার আপন সংগ্রামী পথযাত্রায় বাঙালি পুরুষ নিজেও সামাজিক ভাবে তার থেকে দুর্বলতর জায়গায় থাকা পুরুষমানুষ কিংবা যে কোনও লিঙ্গ-জাতি-যৌনতা ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়নি, এটাও ভুলে গেলে চলবে না।
(সমাপ্ত)
…পড়ুন মাসকুলীন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩: মহিলা রাজনীতিকেরা রান্নাবান্নায় পটু কি না, যে কোনও সাক্ষাৎকারে সে প্রশ্ন অযৌক্তিক
পর্ব ২: সেই তরুণরা আলোচনায় আসে না, যাদের কল্পজগতে নেই কোনও মনিকা বেলুচ্চি
পর্ব ১: কেন ‘যৌন’ শব্দের সঙ্গে ‘ক্ষমতা’ বা ‘শক্তি’ জুড়ে পুরুষের যৌনতা বোঝানোর দরকার পড়ে?