পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণে কয়েক গোল খেয়ে বসেছিল হলুদ ট্যাক্সি। আত্মঘাতী গোল কি না– সে ভিন্ন আলোচনা। তবে পিছিয়ে পড়ছিল প্রতিযোগিতায়, তাই বেসরকারি অ্যাপ সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হলুদ ট্যাক্সিকে খেলায় জিইয়ে রাখার জন্য এই নতুন স্ট্র্যাটেজি। ‘যাত্রীসাথী অ্যাপ’ই রক্ষাকর্তার রূপ ধরে নেমে এসেছেন রাজপথে।
অ্যাপ ব্যাপারটাই আলসে। এক জায়গায় গেঁড়ে বসো, ফোনে অর্ডার দাও, বস্তু কিংবা বান্দা হাজির! বিজ্ঞান আশীর্বাদ বলুন বা অভিশাপ– যুক্তির বাবা হল প্রযুক্তি। মাছ-মাংস অ্যাপে। পূর্বপুরুষদের বাজারে গিয়ে কানকো টেনে ফুলকো দেখে টাটকা মাছের গোয়েন্দাগিরি, তারপর দরদাম করে মাছ কেনার ঐতিহ্যে জব্বর জং ধরেছে। অ্যাপ গড়ে দেয় জেনারেশন গ্যাপ।
বাঙালির জীবনে হলুদ ট্যাক্সির জমকালো ব্যাপার ছিল। হিন্দি ছবিতে দেখানো হলুদ ট্যাক্সি, গল্প-কবিতায়- উপন্যাসে উঠে আসা হলুদ ট্যাক্সি। ব্যক্তিগত অনুভূতির লঘুপাকে কলকাতাকে চিনতে পারা হলুদ ট্যাক্সি। যেন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে– ‘ফির লে আয়া দিল…।’ দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছনোর মুশকিল আসান। আশ্বাস দিয়ে বলতে পারা, ‘দাঁড়াও, একটা ট্যাক্সি ধরি।’ ‘পরশপাথর’ মনে করুন, তুলসী চক্কোত্তি তো ‘আজ দিনটা বড় ভালো’ বলে ট্যাক্সি চড়েই ড্রাইভারজির সঙ্গে কলকাতায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছিলেন! তবে কালে কালে যা দিন এলেছে, ‘আসছি’ বললেই হল না কি? ট্যাক্সি পেতে হবে, গড়িয়াহাট, গড়িয়াহাট খেলতে হবে। তারপর!
আরও পড়ুন: ‘রিজ’ কি ইংরেজি ভাষা এতদিনে জানল?
দেখবেন, একটার পর একটা ট্যাক্সি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাচ্ছে। ইমোশনাল ডামেজ। আপনি যত বড় লাট সাহেবই হোন, ট্যাক্সিওয়ালার কাছে চুনোপুঁটি। চওড়া কপাল হলেই তবেই মিলবে অ্যাপ্রুভাল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার সব রুটে যেতে প্রস্তুত, শুধু যে রুটে যাওয়ার কথা হচ্ছে, সেই রুটে যেতে অপারগ। যেন ওই রুটে যাওয়া জ্যোতিষীর বারণ। নইলে অমঙ্গল কে ঠেকায়!
এই শহরে একসময় একশ্রেণির ড্রাইভারের কাছে ট্যাক্সি চালানো দায়িত্ববোধের অঙ্গ ছিল। টাকাপয়সা বুঝে নিয়ে যাত্রীকে পৌঁছে দিতে হবে। আরেকটা অংশ যেন ট্যাক্সি নিয়ে বেরোতেন ‘না’ বলার জন্য। প্রেমের প্রস্তাবে ‘না’ বলার মতোই ব্যাপারটা। খুব ভদ্রসভ্য ব্যবহারের চালকেরও মেজাজের মাফিয়ার মতো। সব মিলিয়ে-জুলিয়ে হলুদ ট্যাক্সির দুনিয়া ছিল এই শহরের অবিচ্ছেদ্য ব্যাপার।
‘রক্তে মাখামাখি সেই দলা পাকানো ভিখিরিকে
ওরা পাঁজা করে কোলে করে ট্যাক্সির মধ্যে তুলে নিল।
চেঁচিয়ে উঠলো সমস্বরে, আনন্দে ঝংকৃত হয়ে,
‘প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে।’
ভালোবাসার প্রতি একসময় দূরত্ব তৈরি হয়। হলুদ ট্যাক্সি নিয়ে তৈরি হল মানুষের বিরক্তি, অবিশ্বাস। অথচ হলুদ ট্যাক্সির মধ্যে কত নস্টালজিয়া, কত পুরনো স্মৃতি। প্রথম ট্যাক্সি চড়া।
আরও পড়ুন: একলা চলো-য় জুড়ল না ভারত, জোটে জুড়ে থাকা কি শিখবেন রাহুল?
‘মিটারে যা উঠবে তাই দেবেন’ বলেছেন ড্রাইভার। যুবক উঠে পড়েছেন। গন্তব্য দুপুরের শোয়ে নিউ এম্পায়ার। ময়দানের পাশ দিয়ে চলেছে ট্যাক্সি। প্রেমিকার মাথা যেন অল্প হেলে পড়েছে প্রেমিকের কাঁধে। দূরে সবুজ মাঠ, খেলাধুলো চলছে। ঘোড়াদের ছুটোছুটি। খোলা জানলায় হাওয়ায় প্রেম পাচ্ছে খুব। ওদিকে মাথার মধ্যে ঘুরছে মিটারের কাঁটা! কোথায় থামবে কে জানে! হয়তো ট্যাক্সিভাড়া দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হবে। আপন মনে হিসেব কষে প্রেমিক। এমনই ছিল মধ্যবিত্তের ট্যাক্সিযাপন। তারপর সময়ের দাবি মেনে কলকাতায় সাম্রাজ্য গড়ল ক্যাব! পোষায় যাও, নইলে না। দরদামের গল্পই নেই।
হলুদ ট্যাক্সি নিয়ে দরাদরি বাজারে বাঙালির মাছ কেনার মতোই। ‘না না দেড়শোতে হবে না। দুশোই দিতে হবে।’ একে তাড়াতাড়ি যাওয়ার তাড়া, তাছাড়া ইজ্জত কা সওয়াল। ট্যাক্সিতে যাওয়ার প্ল্যান হয়েছে মানে যেতেই হবে। মেজাজটাই তো আসল রাজা! যাওয়া-আসার একটু শো অফ। লাকুক গোটা ৫০ টাকা বেশি! কুছ পরোয়া নহি। ভাঙা হিন্দিতে বাঙালিবাবু বলে উঠলেন, ‘ঠিক হ্যায়, গেট তক ছোড় দেনা। বচ্চা সাথে মে হ্যায়।’ তারপর গড়গড়িয়ে চলল ট্যাক্সি। সোজা মন্দিরতলা…
বাঙালি জীবনে ট্যাক্সির নানাবিধ রূপ। নানাভাবে জড়িয়ে থাকা জীবনের সঙ্গে। বাড়ি ফিরে বাবার কাছে জানতে পারলেন তিনি বেজায় ঠকেছেন ট্যাক্সি চালকের কাছে। মিটারে নিশ্চয়ই কারচুপি ছিল, নইলে ওই দূরত্বে অত ভাড়া হতেই পারে না। সেও এক অনবদ্য শিক্ষা!
হলুদ ট্যাক্সি চালকরা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আপনারা পাঁচশো-হাজার দিয়ে ক্যাবে যান, কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালাকে কুড়ি টাকা বাড়তি দিতে পারেন না৷ আমাদেরও তো খেয়ে পরে বাঁচতে হয়। গাড়ির সার্ভিসিং তো নয়, হাতিপোষা।’
দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপে এসে গেল হলুদ ট্যাক্সির অ্যাপ। সেই মিটার দেখে ভাড়া মেটানো কিংবা দামাদামির ব্যাপারটাই নেই। আপাতত যাত্রীসাথী অ্যাপে ফ্যালো কড়ি, চড়ো গাড়ি।
যাত্রীসাথী অ্যাপে গাড়ি এবং চালকের তথ্য অনলাইনেই পেয়ে যাবেন ব্যবহারকারীরা। সুবিধা আর নিরাপত্তার স্বার্থে এই অ্যাপ। কার সুবিধা, কোন শ্রেণির নিরাপত্তা? সে অপ্রীতিকর প্রশ্নকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবে নব উদ্যোগ। পুঁজিবাদ যেন গোষ্ঠমামা, পেতে দিয়েছেন ফাঁদ। বিষয়টা কি ওই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হলুদ টাক্সির অ্যাপ-ক্যাব? ‘দেখ্ বাবাজি দেখ্বি নাকি দেখ্রে খেলা দেখ্ চালাকি!’
পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণে কয়েক গোল খেয়ে বসেছিল হলুদ ট্যাক্সি। আত্মঘাতী গোল কি না– সে ভিন্ন আলোচনা। তবে পিছিয়ে পড়ছিল প্রতিযোগিতায়, তাই বেসরকারি অ্যাপ-ক্যাব সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হলুদ ট্যাক্সিকে খেলায় জিইয়ে রাখার জন্য এই নতুন স্ট্র্যাটেজি। ‘যাত্রীসাথী অ্যাপ’ই রক্ষাকর্তার রূপ ধরে নেমে এসেছেন রাজপথে। হাতের তালুতে প্রায় ২১ হাজার গাড়ি। এসি এবং নন-এসির অনলাইন পসরা। বুক করলেই রথ নিয়ে সারথী হাজির। ক্যাশ নেই? না তাতেও বেলাইন হওয়ার বিন্দুমাত্র ভয় নেই। অনলাইনেই পেমেন্ট হয়ে যাবে।
যাত্রীসাথীতে ট্যাক্সির ভাড়া নিয়ে দরাদরি নেই, বাড়তি টাকা গচ্চা যাওয়ার ভয় নেই৷ বেসরকারি অ্যাপ-ক্যাবের মতোই বেঁধে দেওয়া রেটচার্ট। ধোপদুরস্ত ব্যাপার।
‘দাদা তিরিশটা টাকা বাড়িয়ে দেবেন।’
‘হবে না দাদা। মাসের শেষ দশটাকা বাড়তি দিতে পারবো। গেলে বলুন।’
‘আচ্ছা চলুন।’
এমন ছোট ছোট গল্প জুড়ে থাকত হলুদ ট্যাক্সির মধ্যবিত্ত অ্যাডজাস্টমেন্ট।
তবে কি দরাদরি করে ট্যাক্সি চড়ার মধ্যবিত্ত সম্ভাবনায় ইতি পড়ে গেল? মাঝামাঝি দরদামে দু’দিকের স্বার্থরক্ষার মতো চিরকেলে ব্যাপারটায় দাড়ি পড়ল?
পুরোটাই অ্যাপ নির্ভর শপিং মল, নো দরদাম! মাঝেমধ্যে অল্প ডিস্কাউন্টের খুড়োর কল!