ক্লাসের মুসলিম ছেলেটিকে এসে এসে চড় মেরে যাচ্ছে সহপাঠীরা। শিক্ষিকার নির্দেশে। তাঁর উদ্দেশ্য ‘মহামেডান’-দের বিদেয় করা। এইভাবে তিনি ছোট শিশুদের মধ্যে গেঁথে দিচ্ছেন বিভেদের বীজ, যে বীজ একদিন মহীরুহ হবে, নিশ্চিতভাবেই। আজ তিনি নাহয় লড়িয়ে দিচ্ছেন ক্লাসের এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশকে, কিন্তু কাল সে লড়াই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাবে।
দু’টি গল্প। ‘দোস্তজী’ নামের সিনেমাটি বড়পর্দায় দেখে ফেলেছেন অনেকেই। একটি গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে থাকে ভিন্নধর্মের দুই বন্ধু– পলাশ আর সফিকুল। তাদের বন্ধুত্ব, একসঙ্গে স্কুল যাওয়া-আসা, জোনাকি-ধরার খেলা, কিংবা হাত ছাড়িয়ে উড়ে যাওয়া ঘুড়ির সুতোর মায়াটানে বাঁধা পড়েছেন অসংখ্য দর্শক, গত কয়েক মাসে।
দ্বিতীয় গল্পটি সাম্প্রতিক। একটি ভিডিও ঘুরছে মিডিয়ায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। স্কুলের ক্লাসঘর। শিক্ষিকা চেয়ারে বসে আছেন, পাশে দাঁড়িয়ে একটি ছাত্র, যে ধর্মে মুসলিম। ‘মহামেডান’-দের প্রতি আক্রোশ ঝরে পড়ছে শিক্ষিকার স্বরে, তিনি অন্য ছাত্রদের তাদের বসার জায়গা থেকে ডেকে তুলে এনে তাদের দিয়ে এই ছেলেটিকে চড় মারাচ্ছেন। কান্নায় ভেঙে পড়ছে আক্রান্ত ছেলেটি।
মুশকিল হল, দ্বিতীয় গল্পটি কোনও কাল্পনিক কাহিনি নয়, ঘোর বাস্তব। ঘটনাটি উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরের অন্তর্গত একটি গ্রামের। যে দিদিমণি এই কাজটি করেছেন, তিনি নিজেই বিদ্যালয়ের প্রধানা শিক্ষিকা। ভিডিও দেখে যেটুকু মনে হচ্ছে, বড় শহরের উচ্চবিত্ত স্কুল নয় ঠিকই, কিন্তু নিতান্ত হতদরিদ্রও নয় স্কুলটি। পরিচ্ছন্ন ঘর, সুন্দর দেওয়াল, বাইরে টবে গাছ। ছাত্রছাত্রী সবারই ছিমছাম ইউনিফর্মে। অর্থাৎ পড়াশুনোর জন্য যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ।
এবং, সেখানে ঘৃণার চাষ হচ্ছে। মুসলিম হওয়ার অপরাধে মার খাচ্ছে একটি ছেলে।
ছেলেটির বাবা জানিয়েছেন যে, তিনি ছেলেকে স্কুলে আর পাঠাবেন না, কিন্তু স্কুলের বা শিক্ষিকার বিরুদ্ধে অভিযোগও জানাবেন না কিছু। স্পষ্ট, তিনি আতঙ্কিত।
বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে আসে, ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে। বেশ কিছু স্তর।
প্রথমত, একজন শিক্ষিকা এইভাবে কোনও বিশেষ ধর্মের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ব্যক্ত করছেন ক্লাসরুমে, ভিনধর্মের ছাত্রকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত করছেন– এমন ঘটনা ভয়াবহ। যিনি শিশুদের পাঠদানের মতো দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন কাঁধে, তিনি সমদর্শী হবেন, তাঁর কাছে সব ধর্মের, সব আর্থসামাজিক শ্রেণির ছাত্রই সমান আদর পাবে– সেটাই বাঞ্ছিত, সেটাই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত, ক্লাসরুমে যে কোনওরকম শারীরিক শাস্তিই সর্বতোভাবে বর্জনীয়। গায়ে হাত তুলে আর যাই হোক, শিক্ষাদান হয় না। একথা উল্লেখ করতে হল এই জন্য যে, উক্ত শিক্ষিকা পরে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন– ছেলেটি হোমওয়ার্ক করেনি বলে তিনি শাস্তি দিয়েছেন তাকে। ছেলেটি হিন্দু না মুসলিম– সেই হিসেব নাকি তাঁর মাথায় ছিল না। এবার, হোমওয়ার্ক না হলেও আদৌ এভাবে মারধোর করা যায় না ছাত্রকে। আর তার চেয়েও বড় কথা, ধর্মীয় সমীকরণ যখন ওই শিক্ষিকার মাথায় ছিলই না, তিনি কেন বলছিলেন, সব ‘মহামেডান বাচ্চে’-দের উনি বিদেয় করতে চান?
তৃতীয় যে দিকটি সবচেয়ে বিপজ্জনক, সেটা হল, একটি ছেলেকে নিগ্রহ করার জন্য তিনি বাকি ছাত্রদের নিযুক্ত করেছেন। সেই অন্য ছাত্ররা যে খুব আনন্দের সঙ্গে কাজটা করেছে, এমন কিন্তু নয়। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তাদের চোখমুখে দ্বিধা, সংশয়, হাত-পা আড়ষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে, সহপাঠীর লাঞ্ছনায় তাদের সায় নেই। কিন্তু সেই নীরব আপত্তি উপেক্ষা করেই দিদিমণি জোর করে ডেকে পাঠাচ্ছেন ক্লাসের পলাশদের, এবং সফিকুলটির গালে চড় মারতে বাধ্য করছেন। চড়ের আওয়াজ যথেষ্ট জোরালো না হলে আবার চেঁচিয়ে বলছেন– ‘জোরসে মারো না’। এইভাবে তিনি ছোট শিশুদের মধ্যে গেঁথে দিচ্ছেন বিভেদের বীজ, যে বীজ একদিন মহীরুহ হবে, নিশ্চিতভাবেই। আজ তিনি নাহয় লড়িয়ে দিচ্ছেন ক্লাসের এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশকে, কিন্তু কাল সে লড়াই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাবে, এক ভারতের সঙ্গে অন্য ভারতের লড়াই হয়ে মাথা তুলবে।
আর আমরা? আমরা কী করব? পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরপ্রদেশ ঢের দূর, অতএব ‘ওসব ওখানে হয়’ ভেবে স্বস্তিতে থাকব? ‘দোস্তজী’র গ্রামবাংলা যে-সময়কালের, সেখানে যেমন সাম্প্রদায়িকতার টানাপোড়েন ছিল, তাকে ছাপিয়ে যাওয়া মনুষ্যত্বের জয়গানও ছিল। কিন্তু তারপর তো কত জল গড়িয়ে গেছে গঙ্গা-যমুনায়, আমাদের শিরা-ধমনীতেও বয়েছে নানা রকমের চোরাস্রোত, বিচ্ছেদ-প্রবণতা। তাকে কি স্বীকার করব না আমরা? আত্মীয়-বন্ধু মহলে যখন চাপাস্বরে কেউ বলে উঠবেন, ‘ওরা ওরকমই হয়’, আমরা প্রতিবাদ করব তো? আজকের পাঁচতারা কর্পোরেট স্কুলগুলোয় মহাসমারোহে যাগযজ্ঞ হয়, হিন্দু দেবদেবীর স্থায়ী মূর্তি বসে বিদ্যালয়-প্রাঙ্গণে– তাকে প্রশ্ন করব কি? এক-দেড় দশক আগেও তো সরকারি বা সরকারি সাহায্যপুষ্ট স্কুলগুলিতে দেবদেবীরা এমন সুপারস্টার ছিলেন না, বরং ক্লাসে মণীষীদের জীবন নিয়ে আলোচনা হত, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণ করা হত, প্রেয়ার লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে হেডমাস্টারমশাই বা বড়দিদিমণি বোঝাতেন হিরোশিমা দিবসের ভয়াবহতার কথা। কোন মন্ত্রবলে সেই অঙ্ক বদলে গেল আজ? ক্লাসরুমে বিদ্যাসাগরের জন্মদিন উদযাপন না করলেও চলে, কিন্তু স্কুলে গণেশ চতুর্থী পালন অবশ্যকর্তব্য– এমন বাধ্যবাধকতা কবে থেকে ঘিরে ধরল আমাদের– একবার ভেবে দেখব না?
যদি না ভাবি, না দেখি, আজকের সফিকুল আর আজকের পলাশদের মধ্যে থেকে ভেদরেখাটি শৈশবেই যদি মুছে না দিই, তাহলে কিন্তু আমাদেরও মজফফরনগর হয়ে উঠতে সময় লাগবে না।