তিনি নাগলক্ষ্মী। দুরন্ত দাবাড়ু রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দর মা। প্রজ্ঞানন্দ যেখানেই দাবা খেলতে যান না কেন, স্থিতপ্রজ্ঞ ছায়ার মতো উপস্থিত থাকেন নাগলক্ষ্মী। বাকু-তে এই দাবা বিশ্বকাপের টানটান সাডেন ডেথের ট্রাই ব্রেকে যেভাবে জয় পেলেন প্রজ্ঞানন্দ, অদূরে বসে থাকা একলা চেয়ারে নাগলক্ষ্মীর শাড়ির আঁচল টেনে নিল তাঁর চোখের জল।
ছিপছিপে। অনাড়ম্বর। শ্যামবর্ণ।
এক ঝলকে চেনাই যায় না– এই সেই বিস্ময়-বালকের মা। হাসলে স্পষ্ট হয় একটা ভাঙা দাঁত। মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়েরা যেমন হয়, ছিমছাম ও করিৎকর্মা, জীবনের হরেক খুচরো চিন্তা নিজের কপালে নাচায়, বাইরে থেকে তিনিও তেমন।
তিনি নাগলক্ষ্মী। দুরন্ত দাবাড়ু রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দর মা। প্রজ্ঞানন্দ যেখানেই দাবা খেলতে যান না কেন, স্থিতপ্রজ্ঞ ছায়ার মতো উপস্থিত থাকেন নাগলক্ষ্মী। বাকু-তে এই দাবা বিশ্বকাপের টানটান সাডেন ডেথের টাই ব্রেকে যেভাবে জয় পেলেন প্রজ্ঞানন্দ, অদূরে বসে থাকা একলা চেয়ারে নাগলক্ষ্মীর শাড়ির আঁচল টেনে নিল তাঁর চোখের জল। প্রেসের সামনে কথা বলছেন যখন প্রজ্ঞা, সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, তখন নাগলক্ষ্মীর মুখে ছড়িয়ে পড়েছে প্রার্থনাসফল হাসি। কেনই বা কেঁদে ফেলবেন না তিনি, কেনই বা আনন্দের রোদ এসে পড়বে না তাঁর মুখে? ২০০২ সালে বিশ্বনাথ আনন্দের পর, এই প্রথম কোনও ভারতীয় দাবা বিশ্বকাপের ফাইনালে! ২১ বছরের অভিশাপমুক্তি ঘটেছে এক বছর ১৮-র স্পর্ধায়। বিশ্বনাথ আনন্দ পর্যন্ত বলেছেন, নাগলক্ষ্মীকে দেখে তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে ওঁর মায়ের কথা। যিনি তাঁর জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সশরীর হাজির ছিলেন।
সই বিলোচ্ছেন প্রজ্ঞা। নাগলক্ষ্মী তন্ময় হয়ে দেখছেন। দেখছেন তাঁরই পুত্রকে। ‘স্টার’ সে। কত লোক তাঁর ফ্যান। এই ঝকমকে আলোর থেকে দূরে যতটা আড়ালে থাকা যায়, তিনিও ততটা আড়াল বেছে দেখছেন। এলইডি ডিজে লাইটের পাশে তিনি হাতে আগলানো বাতাসে কাঁপতে থাকা মাটির প্রদীপ। ছেলের এই জয়, এই সই বিলি, তিনি দেখছেন দরজায় হেলান দিয়ে, যেন নিজেরই ঘরের কোনও কোণ। এই দাঁড়ানোর মধ্যে কোনও অস্বস্তি নেই, ‘ডেকোরাম’ পালনের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। মধ্যবিত্ত মন হয়তো বলে উঠতে পারত, ‘মা, সোজা হয়ে দাঁড়াও। লোকে কী বলবে!’ কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটেনি। নাগলক্ষ্মী তো স্বপ্ন দেখছেন, একটু হেলান দিয়ে দেখলে ক্ষতি কী? প্রজ্ঞা যে স্বপ্ন দেখেছেন, তা তো মায়ের গায়ে হেলান দিয়েই। প্রাক্তন এক নম্বর দাবা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারাভ খামোকাই তো আর টুইট করেননি: “ইট’স আ স্পেশাল কাইন্ড অফ সাপোর্ট”।
স্পেশালই বটে। কিন্তু এটাই একমাত্র ‘স্পেশাল’ নয়।
যে মা ভারতের পিচরাস্তা-কাঁচামাটি পথ হাঁটে নিরন্তর, খালি পা, কোলে শিশু, তিনিও স্পেশাল। যে মা বিধবা, গৃহিণী ও কম-খরুচে, সন্তানের বাকপটুতায় খানিক নড়বড়ে, তিনিও স্পেশাল। যে মা দৌড়ে বেড়ান, স্বরোজগেরে, তেমন একটা সময়-টময় নেই, তিনিও স্পেশাল। যে মা বিবাহ-বিচ্ছিন্ন, সন্তান দায় নেই, অবরেসবরে দেখা দেন, তিনিও স্পেশাল। যে মা পক্ষাঘাতগ্রস্ত, চিনতে পারেন না কাউকে, তিনিও স্পেশাল। যে ‘মায়ের আশীর্বাদ’ নিয়ে ছুটে যায় কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানবাহন, সেই মা-ও স্পেশাল। যে মা পড়তি বয়সে সন্তানের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছেন ও যে মা গবেষণার জন্য বিদেশ-বিভুঁইয়ে, তাঁরাও স্পেশাল। যে মা রন্ধনপটীয়সী ও যে মা নয়, তাঁরাও স্পেশাল।
স্পেশাল, যাঁরা মা হতে চান না একেবারেই, তাঁরাও।
পুনশ্চ: রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ যত বিখ্যাত হবেন, যত জয়ের খেতাব জিতবেন, তাঁর নামের সঙ্গে বাবার নাম ‘রমেশবাবু’ জুড়ে থাকবে বটে, কিন্তু বিশ্ব তাঁকে নাগলক্ষ্মী প্রজ্ঞানন্দ বলেও চিনে নেবে। যদিও আমি প্রায় নিশ্চিত, নাগলক্ষ্মী এই অতি-পরিচিতিতে খানিক আপত্তিই করবেন।
জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।