২০১৪ সালের কাছাকাছি সময় থেকে সংবাদ ব্যাপারটাই একটা মৌলিক বদলের মধ্য দিয়ে গেছে। এই সময়ের কিছু আগে থেকেই বিশেষ করে ‘জাতীয়’ সংবাদমাধ্যমে প্রবেশ করল এমন সব কর্পোরেট, যারা আগে সংবাদমাধ্যমের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। কর্পোরেট পরিভাষায় বললে, তারা সংবাদমাধ্যমের জগতে ‘ডিসরাপ্টর’। তারা পুরনো খেলার নিয়মকে প্রায় পুরোটাই বদলে দিয়েছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষ এখন দেশের অধিকাংশ ‘জাতীয়’ টিভি চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করছে শুধু না, টিভির সামনে বসে নিরাবেগ গলায় সংবাদ-পাঠের স্মৃতি এখন অতীত। নতুন জমানায় সাংবাদিকদের পিছনে ফেলে সামনের সারিতে চলে আসল সংবাদপাঠকরা।
দিল্লিতে ‘নিউজক্লিক’-এর সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থের গ্রেপ্তারির খবর শুনে মনে পড়ে যাচ্ছিল কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের কথা। এই তো ক’মাস আগেই দেখা হয়েছিল। জেল থেকে বেরনোর পরে এই প্রথমবার কেরলের বাইরে কোথাও নিজের কথা বলতে এসেছিলেন তিনি। মনে পড়ে যাচ্ছিল, সিদ্দিকের স্ত্রী-র সঙ্গে কথোপকথনের স্মৃতি। সিদ্দিকের মুখ থেকে শুনছিলাম ‘সাংবাদিক’ থেকে ‘সংবাদ’ হয়ে ওঠার আকস্মিকতা আর ভীতি। আবার, তার মধ্যেই উঁকি মারছিল হার না মানতে চাওয়া জেদ। প্রবীর বা সিদ্দিক একা নন। আমার ধারণা, এই ঘটনা চলতে থাকবে। আরও অনেক প্রবীর ও সিদ্দিককে সাংবাদিক হওয়ার অপরাধে জেলের মধ্যে ঢুকতে হবে।
‘মিডিয়া উইদাউট বর্ডার’ বলে একটি বিখ্যাত বৈশ্বিক মিডিয়া ওয়াচ সংস্থা অনেক দিন ধরেই ভারতের সংবাদপত্রর স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের সতর্ক করে চলেছে। ওরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ভিত্তিতে যে তালিকা বানায়, সেখানে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ১৬১ নম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রত্যেক বছরেই মোদির জমানায় ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্রমহ্রাসমান। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যদি কোনও রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপক হয়, তবে ভারতের গণতন্ত্র যে এখন একটি খাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তা মনে হয় বলাই যায়।
যেহেতু আমাদের যৌথ স্মৃতি এখন প্রত্যেক দিনের নব নব সংবাদে সততই স্মৃতিবিভ্রমকাতর। তাই একবার চট করে মনে করে নিই, ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ভারতের সংবাদমাধ্যম?
২০১৪ সালের কাছাকাছি সময় থেকে সংবাদ ব্যাপারটাই একটা মৌলিক বদলের মধ্য দিয়ে গেছে, সেই নিয়ে সন্দেহ নেই। এই সময়ের কিছু আগে থেকেই বিশেষ করে ‘জাতীয়’ সংবাদমাধ্যমে প্রবেশ করল এমন সব কর্পোরেট, যারা আগে সংবাদমাধ্যমের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। কর্পোরেট পরিভাষায় বললে, তারা সংবাদমাধ্যমের জগতে ‘ডিসরাপ্টর’। তারা পুরনো খেলার নিয়মকে প্রায় পুরোটাই বদলে দিয়েছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষ এখন দেশের অধিকাংশ ‘জাতীয়’ টিভি চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করছে শুধু না, টিভির সামনে বসে নিরাবেগ গলায় সংবাদ-পাঠের স্মৃতি এখন অতীত। নতুন জমানায় সাংবাদিকদের পিছনে ফেলে সামনের সারিতে চলে আসল সংবাদপাঠকরা। আগে যে সংবাদ-পাঠকদের ভূমিকা ছিল নেহাতই খবর পরিবেশকের, তারা হয়ে উঠল সেই নির্দিষ্ট চ্যানেলের মুখ। যারা আমাদের চিনিয়ে দেয় কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক। সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতার যে একটা নীতি সবাই মোটের ওপর মেনে চলত, সেটা যেন বাজে কাগজের ঝুড়িতে স্থান পেল। যে কোনও ক্ষেত্রে ব্যাপক বদল পুরনো ধরনে কাজ করতে অভ্যস্ত মানুষদেরও সরিয়ে দেয়। তাই এই পর্বে এক সময়কার বিখ্যাত সাংবাদিকরাও টিভি সাংবাদিকতার জগৎ থেকে সরে গেলেন বা সরে যেতে বাধ্য হলেন। কাজ খুঁজে নিলেন ছোট পোর্টালে বা খুললেন নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল। এই বৈপ্লবিক বদলের সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম এই নতুন বিবেকী মানুষেরা কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রশ্ন করতে একেবারেই বিমুখ। তারা প্রশ্ন করে বিরোধীদের। প্রশ্ন করে সমাজকর্মীদের। এবং, সেখানেও পক্ষ নেয়। ‘দেশপ্রেম’-এর। যে ‘দেশপ্রেম’ অনেক ক্ষেত্রেই নিখাদ সরকারকে প্রেম। আদর্শ প্রেমিকদের মতোই সরকারকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, তবে তাকে ওরাও প্রশ্ন করে।
কিন্তু, প্রশ্ন হল যে সরকার বিরোধী খবরের তো একটা বড় চাহিদাও আছে। সেটাকেও এই নতুন মিডিয়া অস্বীকার করে কেন? হয়তো এর উত্তর খানিক খুঁজে পাওয়া যাবে এক নতুন রকমের মধ্যবিত্তের উত্থানের সঙ্গে। মোদির শক্তিশালী হিন্দুত্ব ও অন্যদের অপর করে দেওয়া রাজনীতির সঙ্গে যারা একাত্মবোধ করে।
মাথায় রাখতে হবে, এই সময়েই আবার সামাজিক মাধ্যম উঠে এল প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের প্রতিযোগী হয়ে। এই আমলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং সংঘ পরিবার এই ব্যাপারটা যত আগে ধরতে পেরেছে, তা অন্য কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিই পারেনি, এটা মেনে নেওয়াই ভালো। মনে পড়ে যায়, আমাদের একটি তথ্যচিত্রের কাজে যখন আমরা অনেক কষ্টে পৌঁছেছিলাম বিজেপি-র আইটি সেলের এক কর্মীর কাছে আর প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা কথোপকথনের সময় অনেক কথার ফাঁকে একটি কথা ছিল– ২০১৯ -এর নির্বাচন আসলে হতে চলেছে হোয়াট্সঅ্যাপ নির্বাচন। যে কথা আবার তাদের কোনও এক অভ্যন্তরীণ সভায় জানিয়েছিলেন স্বয়ং অমিত শাহ।
কিন্তু, কেবলমাত্র অধিকাংশ মিডিয়ার দ্বারা সম্মতি নির্মাণের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা দলটি তৃপ্ত হয়নি। ক্রমাগত আক্রমণ নামিয়ে এনেছে সেই সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে, যাঁদের এরা বাগে আনতে পারেনি। ‘ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ’ বলে একটি সংস্থার সার্ভে অনুসারে, কেবলমাত্র ২০২০ সালেই ২০০ বার ভারতে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ নেমে এসেছে। আমাদের স্মৃতি ফিকে হওয়ার আগে মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ‘এন-ডি-টি-ভি’ আদানি কিনে নেওয়ার আগে বারবার তাদের অফিসে আয়কর না দেওয়ার অভিযোগে রেড হয়েছে। রেড আগেও হয়েছে ‘নিউজক্লিক’, ‘নিউসলন্ড্রি’, ‘ওয়ার’-সহ একাধিক ছোট পোর্টালের অফিসে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতোই নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে ক্রমাগত ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু দেশীয় নয়। ‘বিবিসি’-র মতো সংবাদমাধ্যমকেও রেয়াত করা হয়নি।
শুধু আক্রমণ আর ‘দুর্নীতি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়। ম্যাককার্থি যুগকে মনে করিয়ে দিয়ে প্রায় ১০০০ জন সাংবাদিকের ওপর ‘পেগ্যাসাস’ নামক তদন্তকারী সফটওয়ার ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। তবে সবার থেকে বেশি আক্রমণ নেমে এসেছে কাশ্মীরের সাংবাদিকদের ওপর। একাধিক সংবাদপত্রের সম্পাদক, সাংবাদিকদের শুধু জেলবন্দিই করা হয়নি, ইন্টারনেট লকডাউন করে প্রায় উপত্যকাকেই একটা জেলে পরিণত করা হয়েছে, যেখানে কোনও রকম সাংবাদিকতাই করাই একসময় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এই লেখাটি লেখার সময় ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার’-এর ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম এই মূহূর্তে শুধু প্রবীর নয়, সব মিলিয়ে আট জন সাংবাদিক জেলবন্দি। মজার কথা, যাঁদের বিরুদ্ধে সংবাদের জন্য কেস করা হচ্ছে, তাঁদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই কোনও নির্দিষ্ট খবরকে দায়ী করা হয়নি। নিউজক্লিক কোনও প্রবন্ধে চিনের পক্ষ নিয়েছে– এ কথা কি কেউ জানে? সিদ্দিক কাপ্পানকে কিছু লেখার আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে!
স্বভাবতই ২১ মাসব্যাপী এমারজেন্সির সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনা চলছে। কেউ কেউ বলছে, এ যেন অঘোষিত এমারজেন্সি। অবশ্যই যেভাবে ইন্দিরা গান্ধী প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়াকেই তুলে দিয়েছিলেন, খুব স্পষ্ট করে সেন্সরশিপ নামিয়ে এনেছিলেন, সেটা এখনও হয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রে মিলও আছে। বেশ বহু দিন ধরে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে কেউ-ই ছিল না। আবার, ১৯৭৬ সালে পাশ হওয়া ‘প্রিভেনশন অফ পাবলিকেশন অফ অবজেকশনেবল ম্যাটার’কে নতুন করে ধুলো ঝেড়ে নিয়মিত ব্যবহার করা হচ্ছে।
কিন্তু, কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘ পরিবারের মূলগত তফাত আছে। কংগ্রেসের ঘোষিত নীতির সঙ্গে এমারজেন্সি চাপিয়ে দেওয়ার মিল ছিল না। কাজ আর কথার মধ্যে এই দ্বন্দ্বের ফলে এমারজেন্সি কংগ্রেসকে দীর্ঘমেয়াদিভাবে দুর্বল করেছিল। অন্যদিকে মোদির দলের নীতিমালার সঙ্গে মুক্ত সংবাদমাধ্যমের ধারণার বিশেষ মিল নেই। ফ্যাসিবাদকে বোঝার ক্ষেত্রে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত আর্থার রোসেনবার্গের ‘ফ্যাসিজম অ্যাজ এ মাস মুভমেন্ট’ প্রবন্ধটির জুড়ি মেলা ভার। বিভেদমূলক রাজনীতিকে মোদি যে প্রায় এক গণ-আলোড়নের চেহারা দিতে পেরেছেন, এই সত্য মেনে নেওয়াই ভালো। এবং, সেই আলোড়নের ওপর ভর দিয়েই সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনা সহজ হয়ে উঠেছে যেন।
অন্যদিকে এ কথাও সত্য মোদি হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ঘোষিতভাবে ‘এমারজেন্সি’ জারি করবেন না। সংঘ পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিনের গবেষক ক্রিস্টোফার জেফ্রলে মোদির নিজস্ব রাজনীতিকে বুঝতে গিয়ে ‘এথনিক ন্যাশনালিজম’ বা ‘জাতিবাদী জাতীয়তাবাদ’-এর ধারনাকে ব্যবহার করেছেন। যা আবার প্রথম ব্যবহার করেন ইজরায়েলের সমাজতাত্ত্বিক স্যাম্মি স্মুহা। ইজরায়েলের উদাহরণ দিয়ে স্যাম্মি দেখিয়েছেন যে, আপাত গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেই এক ধরনের বিভেদমূলক নীতিমালাকে স্থান দেওয়া যায়। আর, এখানেই সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের মূল সূত্র লুকিয়ে আছে বলে মনে হয়।
তবে শাসক অনেক সময় ভাবে এক আর মানুষ ভাবে আরেক। হয়তো এই বজ্র আঁটুনিই কোনও এক ফসকা গেরোর জন্ম দেবে!