কয়েক বছর আগে একটি ভিডিও খুব ভাইরাল হয়েছিল। উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা ‘আমব্রেলা’ বানান ভুল বলেছিল, তা নিয়ে একাধিক ট্রোল-ভিডিও তৈরি হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপিয়ে বলা যেতেই পারে, এই প্রজন্ম বই পড়ে না। কিন্তু যারা এখন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া, তাদের এই অবস্থার কারণ হিসাবে রাষ্ট্র, শিক্ষাব্যবস্থা সর্বোপরি আমরা নিজেদের দায় এড়িয়ে যেতে পারি কি! আশার আলো দেখতে পাই, যখন দেখি, অনেক মানুষ, সমষ্টি, কিছু স্কুল-কলেজ প্রান্তিক করে দেওয়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
সম্প্রতি মধ্য কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ একটি বস্তি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। শুধু অধ্যক্ষ এবং অধ্যাপকরাই নন। কলেজের শিক্ষার্থীরাও শামিল হয়েছেন এই কর্মযজ্ঞে। আমরা যখন এর-তার ঘাড়ে দায় চাপিয়ে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পাশ করলেও তাদের চেষ্টাকে ছোট করে আনন্দ পাচ্ছি, মিম-ট্রোল নিয়ে মেতে আছি, তখন এরকম একটা খবর একটু অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করে বইকি!
আমি ২০১৭ সালে একটি বাস-স্কুলে চাকরি করতাম। সেই চাকরি সূত্রে আমি কলকাতা শহরের বিভিন্ন বস্তি অঞ্চলে পড়াতে যেতাম। সেই কাজ করতে গিয়েই লক্ষ করি, নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নিজেদের নামটুকু ঠিক করে লিখতে পারছে না। এদের মধ্যে অনেকেই সরকারি স্কুলে নিয়মিত যায়। এরপর আরেকটি সংস্থায় নাচ-গান-থিয়েটার শিক্ষক হিসাবে চাকরি করতে গিয়ে শহর, শহরের প্রান্তিক অঞ্চল, মফস্সল, জেলার বিভিন্ন গ্রামে কাজ করতে গিয়েও কিন্তু প্রায় একই চিত্র দেখতে পাই। একেবারে চলতি বাংলায় লেখা নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়তেই পারছে না কেউ। অথচ, তারা নিয়মিত স্কুলে যায়। একটা সময় এমন এল, আমি নিজের ভেতরেও একটা পরিবর্তন দেখতে পেলাম। মানে, কেউ একটা গোটা নির্ভুল বাংলা বাক্য লিখতে পারলেই, তাকে ভাল শিক্ষার্থী বলে ভাবতে শুরু করলাম।
এরপর এল অতিমারীর ধাক্কা। আসলে অতিমারীতে যে শিক্ষাব্যবস্থার হাল এমন হয়েছে, তা আমি বিশ্বাস করি না। এর বহু আগে থেকেই শিক্ষাব্যবস্থা বিকল হতে শুরু করেছে, টের পেয়েছি। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপিয়ে বলা যেতেই পারে, এই প্রজন্ম বই পড়ে না। ফোন ঘাঁটে। কিন্তু এই প্রজন্ম, অর্থাৎ যারা এখন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া, তাদের এই অবস্থার কারণ হিসাবে রাষ্ট্র, শিক্ষাব্যবস্থা সর্বোপরি আমরা নিজেদের দায় এড়িয়ে যেতে পারি কি! গত বছর বা তার আগের বছর একটি ভিডিও খুব ভাইরাল হয়েছিল। ভিডিওতে উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা ‘আমব্রেলা’ বানান ভুল বলেছিল এবং তা নিয়ে একাধিক ট্রোল-ভিডিও তৈরি হয়। আমরা সেই পরীক্ষার্থীদের নিয়ে মশকরা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু তাদের পড়াশোনার এই অবস্থা হল কেন, তা নিয়ে আমরা বিচলিত হইনি। আসলে, বিচলিত হলেই অনেক পরিশ্রম করতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে! তার চেয়ে ট্রোল করা সহজ।
এই ঘুণ ধরে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় অতিমারী কবরে শেষ পেরেকের ভূমিকা নিয়েছিল। এরপর অন্তত এই চিত্র পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক অবস্থানে না থাকলে আপনার সন্তান শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এই দেখুন না, আমরা কত সহজে মেনে নিয়েছি সরকারি স্কুলে পড়ালে আমাদের সন্তান কিছু শিখতে পারবে না। তাই আমরা মরিয়া হয়ে নিজের সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।
এ বছরই আমার এক ছাত্রকে তাঁর অভিভাবক অনেক কষ্ট করে আধা সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। ভর্তির গোটা পদ্ধতির সময়টাতেই আমি ছিলাম তাদের সঙ্গে। ছাত্র নার্সারিতে ভর্তি হয়েছে। সে বাংলায় স্বরবর্ণ, ইংরেজির বড় হাত ও ছোট হাতের অ্যালফাবেট, অঙ্কে ১ থেকে ৫০ লিখতে পারে। কিছু বাংলা-ইংরেজি ছড়াও জানে। তবু দেখলাম সে ভর্তির পরীক্ষায় পাশ করেনি। ভাবলাম, বাচ্চা মানুষ। হয়তো ইচ্ছে করেনি, কিছুই লেখেনি বা বলেনি। কিন্তু খাতা যখন দেখাল, বুঝলাম সে ‘লিখিত নির্দেশ’ বুঝতে পারেনি। কারণ, প্রশ্নপত্র দিয়ে তাদের মুখে কিছুই বুঝিয়ে বলা হয়নি। আরেকবার মনে করিয়ে দিই, সে নার্সারিতে ভর্তি হতে গেছে। বাইরে বেরিয়ে যা বুঝলাম, কোনও বাচ্চাই পাশ করেনি। ওদের বড় আন্টি আমাকে বললেন, ‘ও তো কিছুই জানে না।’ মনে হচ্ছিল বলেই দিই– ‘সব জানলে আর স্কুলে পাঠাব কেন!’ বললাম না। তাঁরা বললেন, একটি মুচলেখা দিতে হবে, ‘আমার বাচ্চাকে আমি বাড়িতে ভালো করে তৈরি করব। পরীক্ষায় নম্বর খারাপ হলে সে দায় স্কুলের নয়।’ লিখে দিলাম কিন্তু বুঝলাম না, দায় তাহলে কার! বাইরে এসে দেখলাম, অভিভাবকরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছেন, কড়া গৃহশিক্ষক খুঁজছেন। কারণ, একজন প্রথম প্রজন্মর শিক্ষার্থীকে তার অভিভাবক পড়াতে পারবেন না। অর্থাৎ, অভিভাবক নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করাবেন! তারপর স্কুল দায় এড়িয়ে যাবে বলে আবার মাইনে দিয়ে একজন গৃহশিক্ষক ডাকবেন। আর ঋণের বোঝা বাড়তে শুরু করবে বাচ্চাটির। তাকে শিক্ষক-অভিভাবকরা মিলে বুঝিয়ে দেবে ‘তোমার মাথামোটা’, ‘তুমি মন দাও না’ তাই তোমার জন্য বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
তবে, এত হতাশার মধ্যে আশার আলো দেখতে পাই, যখন দেখি, অনেক মানুষ, সমষ্টি, কিছু স্কুল-কলেজ নিজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে প্রান্তিক করে দেওয়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
আমিও আর কোনও উপায় না দেখেই ২০২১ সালে কালীঘাট-হাজরা সংলগ্ন এলাকায় কিছু শিক্ষার্থীকে পড়াশোনায় সাহায্য করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রথমে এর-ওর যৌথ ছাদ, বারান্দায় কাজ শুরু হয়। তারপর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করলে আরেকটু সংগঠিতভাবে কাজ শুরু করি। শুরুটা আমি করলেও যে সমষ্টির জন্য কাজ করছি, সেখানকার কিছু বন্ধু-মানুষ এবং আমার পরিচিত, স্বল্প পরিচিত বন্ধু-মানুষ জোট বেঁধে লড়াই শুরু করি।
সমস্ত বয়সের শিক্ষার্থীর জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থার পাশাপাশি বয়ঃসন্ধির মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষণ এবং সকলের জন্য শিল্পচর্চার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য ছাড়া এ কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া বড্ড কঠিন। কিন্তু যাঁরা মনে করেন, সরকার, রাষ্ট্র, শিক্ষার্থীর দায়ের পাশাপাশি আমাদের নিজেদের দায় রয়েছে তেমন বহু মানুষ, দল এগিয়ে আসছেন, জুড়ে যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব নিচ্ছে নিজেদের এবং নিজেদের চেয়ে ছোট শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার। আমি জানি, আমার এবং আমার বন্ধুদের মতো, আমাদের শিক্ষার্থীদের মতো হাজার হাজার মানুষ রোজ লড়াই করছেন শিক্ষার স্বার্থে। আমরা জানি আমাদের প্রতিপক্ষ শক্তিশালী। কিন্তু তাদের স্বার্থ পুঁজি। আমাদের লড়াই বেঁচে থাকার। তাই আমরা আমাদের সর্বশক্তি ঢেলে দেবই।