বাঁকুড়ার এক বিড়ি কারখানায় সংবাদ পড়ছেন সংবাদপাঠক। তিনি এ ব্যাপারে ডিগ্রিধারী নন। কিন্তু গত ৪৩ বছর ধরে, এই কাজই করছেন। চিৎকৃত পাঠ নয়, অমার্জিত উচ্ছ্বাস-উল্লাস নয়, নিস্তরঙ্গ খবর পরিবেশন। কিউবায় চুরুট কারখানায় গত ১৬০ বছর ধরে চলছে খবর পড়ে শোনানোর এই রেওয়াজ। এই বিপরীত স্বর আসলে বড় প্রতিরোধেরই এক-দু’টুকরো।
প্রচ্ছদের ছবি: কিউবার চুরুট ফ্যাক্টরিতে সংবাদপাঠ
কল্পনা করুন, শান্ত দুপুরে এক বিড়ি কারখানায় কাজ চলছে। নিমগ্ন হয়ে বিড়ি বেঁধে চলেছেন ৬০-৭০ জন শ্রমিক। এতজন একসঙ্গে থাকলে যা যেটুকু কথাবার্তা হয় আর কী, ওইটুকুই গুঞ্জন কারখানা জুড়ে। আর এই আবহে একজন বৃদ্ধ নিবিষ্টচিত্তে পড়ে চলেছেন আজকের তাজা খবর– মুখের সামনে রাখা মাইক্রোফোন, হাতে ধরা খবরের কাগজ; বিড়ি-শ্রমিকদের দেশ-দুনিয়ার সংবাদ সম্পর্কে অবগত করছেন ৬০-এ পা রাখা পশুপতি নাগ।
বাঁকুড়ার কোঅপারেটিভ বিড়ি কারখানায় বিগত ৭০ বছরের চিত্র এ-ই। পশুপতি নাগ অবশ্য দায়িত্ব পান ১৯৮২ সালে। তার আগে কারখানারই এক বৃদ্ধ শ্রমিকের ওপর ছিল সংবাদপাঠের ভার। তিনি বিগত হলে বেশ কয়েক বছর বিরতির পর পশুপতি নাগকে নিযুক্ত করা হয়, তারপর এই ৪৩ বছর তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সংবাদ শোনানোর কাজটি করে আসছেন। কারখানায় শ্রমিকদের মুখ পাল্টে যায়, দেশ থেকে রাজ্যে পাল্টে যায় সরকার, বদলে যায় দুনিয়া; তবু, বাঁকুড়া কোঅপারেটিভ বিড়ি কারখানায় সংবাদ পরিবেশকের বদল ঘটেনি। পারিশ্রমিক কী পান এই ভদ্রলোক? প্রতিটি শ্রমিকের থেকে সাতটি বিড়ি, সেই বিড়ি আবার নিয়ে নেয় কারখানা কর্তৃপক্ষই। বদলে মাসান্তে জোটে ১০০ টাকা। আজকের বাজারে ১০০ টাকায় কি চায়ের জলও গরম হয়, কেন করেন এই কাজ? উত্তরে পশুপতি নাগ স্মিত হেসে বলেন, রোজ দুপুর একটায় একটি ঘণ্টা খবর পড়া তাঁর নিয়মিত অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে, সত্তারই অংশ হয়ে গিয়েছে বলা চলে; যতদিন শরীর সঙ্গ দেবে, উনি নিঃসংশয়ে এই কাজখানি চালিয়ে যেতে চান।
এই মন্তব্যের সামনে, প্রায় সাড়ে চার দশক ব্যাপী এই অভ্যেসের সামনে একটু থমকে দাঁড়াতে হয়। আমার বয়স এখন ২৪, আর ক’টা মাস পর গিয়ে দাঁড়াব ২৫-এ। আমরা জীবনের প্রথম একটা দশক দূরদর্শনের সংবাদপাঠ শুনে বড় হয়েছি। সেই ছিমছাম, মনোগ্রাহী উপস্থাপনার সঙ্গে আজকের বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের– তা সে বাংলাই হোক বা সর্বভারতীয়– সংবাদপাঠের মিল সামান্যই; বলা ভালো, সামঞ্জস্য নেই-ই। সংবাদপাঠের নামে এক ধরনের উচ্চকিত, চিৎকৃত রাজনৈতিক তর্জাকেই যেভাবে স্ট্যান্ডার্ডাইজ করা হচ্ছে, তাতে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ মুখ লুকোনোর জায়গা পাবে না সে নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। আগে বলা হত, সংবাদ হবে পক্ষপাতহীন, নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ। এই প্রতিটি শর্তই যে সযত্নে লঙ্ঘিত হয়েছে শেষ কয়েক বছরে, তা নিয়ে মনে হয় না সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন বলে। এখন রাজনৈতিক দলের ধামাধরা বিভিন্ন নিউজ অ্যাঙ্কর নিউজ চ্যানেলগুলিকে একেকটি পার্টি মুখপত্রে পর্যবসিত করেছেন। সান্ধ্যকালীন টক শো-গুলি শুনলে মনে হয় ছাতারেপাখির ঝগড়া বেধেছে। শোনা, শ্রবণ– এই গুণটি যে ভালো বাগ্মী হতে গেলে আবশ্যক, নিজের মতটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে অপরের বয়ানটি খুব মন দিয়ে জানা প্রয়োজন, এই সহজ সারসত্যিটুকু আর কেউ মনে রাখেননি। ফলত, টক শো-তে কেউই আর উদারমনা হয়ে আসেন না, নিজের মতটি চিৎকার করে, টেবিল চাপড়ে প্রতিষ্ঠা করে অফ এয়ার গলা জড়াজড়ি করে ছবি তুলে বাড়ি চলে যান। বড় কোনও ঘটনা ঘটলে স্টুডিও ভরে যায় তার অশ্লীল গ্রাফিক্সে। বন্যা হলে রিপোর্টার সাঁতার কাটেন, প্লেন দুর্ঘটনায় সন্তানহারা মা-কে ইমেজের লোভে তাড়া করে ক্যামেরা; ঠিক যেভাবে রক্তের লোভে শিকারকে তাড়া করে খুনি। ‘মিডিয়া এথিক্স’– সাংবাদিকতার এই ফার্স্ট ইয়ারের বিষয়টি আপাতত শিকেয় তোলা আছে। অদূর ভবিষ্যতে তাক থেকে নামবে, এমন দুরাশা নেই।
এর বিপরীতে এই সুস্থির সংস্কৃতির ছবি ভেসে আসে। এখানে টিআরপি বাড়ানোর দায় নেই; নেই চাকরি বাঁচানোর তাগিদ। রাজনৈতিক দলের তল্পি বয়ে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বাড়ানোর স্পৃহা নেই। শুধু, দেশ-বিদেশের খবর জানা ও জানানোর অকৃত্রিম সদিচ্ছা আছে। যৌথতা আছে। কোথাও কমিউনিস্ট পার্টির জয়ের খবর এঁরা জেনেছেন একসঙ্গে, ভারত জিতলে এঁদেরও একসঙ্গে সেই খবর শোনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। শচীন তেণ্ডুলকরের সেঞ্চুরিই হোক বা শাহরুখ খান নামে এক আসমুদ্রহিমাচল মজিয়ে রাখা জাদুকরের আবির্ভাব– দ্বিপ্রহরের ওই একটি ঘণ্টায় এই ৫০-৬০ জন শ্রমিক একসঙ্গে জেনেছেন এইসব খবর। এই ক্রমশ একা হওয়ার যুগে, ইয়ারবাডে খবর শোনার যুগে এই যৌথতাও কি বড় কম কথা!
কিউবায় প্রায় ১৬০ বছর ধরে চুরুট কারখানায় খবর পড়ে শোনানোর রেওয়াজ আছে। সংবাদপাঠকে প্রায় গল্প বলার স্তরে নিয়ে চলে গিয়েছেন সেখানকার কথকরা, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চুরুটগুলি বানানোর সময় সেখানকার সিগার-শ্রমিকরা শোনেন তাবৎ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সংবাদ। যাঁরা সংবাদ পড়ে শোনাতেন, তাঁদের বলা হত ‘লেক্টর’। কিউবার এই লেক্টর পদের লোকজন আবিশ্ব দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথক হিসেবে বন্দিত হন। বাঁকুড়ার রবীন্দ্র সরণির কোঅপারেটিভ বিড়ি কারখানা যেন এই সংস্কৃতির যোগসূত্রে একটুকরো কিউবা।
আমাদের এই পরিপার্শ্বে দু’রকমের সত্যি আছে। একটা তাৎক্ষণিক, বাজার-ধরা। তাকে বাজারের দায়েই প্রয়োজনাতিরিক্ত রগরগে হয়ে উঠতে হয়। আরেকটা সত্য আরও বেশি বস্তুনিষ্ঠ, ধীর, দীর্ঘমেয়াদি। এই দ্বিতীয় সত্যের পাশে দাঁড়ান পশুপতি নাগের মতো মানুষ। মানুষের গড় আয়ুর তিন-চতুর্থাংশ কাটিয়ে ফেলা ‘যুবক’, আজও তাঁর এই কাজটির প্রতি একইরকম অনুগত, দায়বদ্ধ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সংবাদপাঠের মধ্যে যে মার্জিত ভাব, স্থৈর্য্য টেলিভিশন, ডিজিটাল মিডিয়া থেকে ক্রমবিলীয়মান, সেই অবলুপ্ত গুণগুলিকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন এক-দুই-তিন নয়, দীর্ঘ ৪৩ বছর। সারা রাজ্য, দেশ, পৃথিবী জুড়ে যখন আস্ফালনের জয়জয়কার, তখন তিনি বাঁকুড়ার এক সামান্য বিড়ি কারখানায় দৈনিক একঘণ্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন তাঁর ভাষাতেই।
আসলে, প্রতিরোধের স্বর বোধহয় এরকমই হয়। শুরুতে তার বিস্তার থাকে সামান্যই, অথচ, ওইটুকু ব্যাপ্তিতেই তার যা বলার বলা হয়ে যায়। গোটা গলদেশ সিজারের অধীনে থাকলেও অ্যাসটেরিক্সের গ্রাম দাঁড়িয়ে ছিল মাথা উঁচু করে। গোটা জঙ্গল ধ্বংস হয়ে গেলেও একটি চড়াইপাখি পুড়ে যাওয়া কাঠকুটো দিয়েই ছোট্ট একটি বাসা তৈরি করে ফেলে।
ঠিক তেমনই, পৃথিবীব্যাপী নৈতিক অবক্ষয়, সংবাদপাঠের নামে প্রহসনের যুগেও একটি ছোট্ট কারখানায় মাইক্রোফোনের সামনে দৃঢ় কণ্ঠে সংবাদ পড়ে যাবেন এক ভদ্রলোক, পড়বেন যতদিন তাঁর শরীর সঙ্গ দেয়।
……………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………….