রেলপথের একেবারে গোড়াতেই বোধহয় আমাদের বাস্তুতন্ত্রের সব ভারসম্য তছরুপ করার ছাড়পত্র দেওয়া আছে। ভারতবর্ষের বুক থেকে ধন শুষে নিতে যে কলের আমদানি, তা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে গুরুত্ব দেবে, এমন ভালমানুষির ধার অন্তত ঔপনিবেশিক প্রভুরা ধারেননি। মাঠ, বন, জলের বুকের উপর দিয়েই তাই ছুটে গিয়েছে সভ্যতার লোহার চাকা। এই পৃথিবীর বুকে বহু আগে আসা প্রাণও পরাস্ত হয়েছে মানুষের ক্ষমতালিপ্সার কাছে। মানুষেরই নির্মিত ধনতন্ত্রের এই আজব কুদরতি যে তাদের ধাক্কা দিয়ে প্রতিদিন মেরে ফেলবে কিংবা নির্বিচারে কেটে ছড়িয়ে ফেলবে তা তাদের কল্পনাতেও ছিল না। অথচ প্রকৃতিভাবনা ছাড়া সভ্যতার আর দ্বিতীয় কোনও সংগ্রাম দানা বাঁধার প্রশ্ন নেই আজ।
জ্বর থেকে উঠে রেলপথ দেখার সাধ দুর্গার আর মিটল না। অপু দেখেছিল, ‘মাঠের মাঝখান চিরিয়া ডাইনে বাঁয়ে বহুদূর’ যে-রাস্তা, রাঙা রাঙা খোয়ার রাশি ধারে সার দেওয়া, তা দেখিয়েই বাবা তাকে বলেছিল, ওই হল রেলের রাস্তা। দু-চোখে সেই নতুন বিস্ময় আপ্রাণ শুষে নিয়েছিল বালক অপু। শুধু দিদিকে আর সে রেলপথ দেখাতে পারেনি। অথচ যে মানুষখেকো ম্যালেরিয়া দুর্গাকে টেনে নিয়ে গেল ‘পরিচিত ও গতানুগতিক পথের বহুদূরপারে কোন পথহীন পথে’, সেই অসুখও মহামারী হয়ে উঠেছিল এই রেলপথ পত্তনের সুবাদেই। সিদ্ধার্থ ঘোষ বলছেন, ‘লোহার চাকা ভারতের বুকে কিভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক ক্ষত সৃষ্টি করেছিল তার বহু প্রামাণ্য বিবরণ ও ব্যাখ্যা আছে। ভারতের ধন-হরণের এই কলটির জন্য লাইন পাততে গিয়ে বাঁধ নির্মাণের সূত্রে অভ্যন্তরীণ জলপথব্যবস্থার বিনাশ ও মহামারীরূপে ম্যালেরিয়ার আবির্ভাব নিয়েও আলোচনা হয়েছে অনেক।’ গোটা ‘পথের পাঁচালী’ জুড়ে যেভাবে ক্ষুধার দলিল লেখা হতে থাকে, নবারুণ ভট্টাচার্য মনে করেন, তা আদতে ‘নিয়ন্ত্রিত, ঢিমে, অপরপরিবর্তনীয় দুর্ভিক্ষের’ই আখ্যান। সেই দৃষ্টি অনুসরণেই আমরা দেখব, বিভূতিভূষণ তাঁর অমোঘ নিষ্ঠুর কলমে দুর্গার জন্য যে নিয়তি রচনা করেন, তা কেবল মৃত্যু নয়, হত্যাই। তথাকথিত আধুনিক রেলপথ উপনিবেশের অপুষ্টিজর্জর মানুষকে যেভাবে হনন করে নিশঃব্দ ঘাতক হয়ে। ভারতবাসী আর রেলপথের সম্পর্কে হত্যা তাই জড়িয়ে গভীর ইঙ্গিতে। এমনকী, স্বাধীনতা পরের দেশেও সে-হত্যার রূপ বদলায়নি।
কথাটি সম্প্রতি খোলসা হয়ে পড়েছে অনুবাদের ভুলে। হাতিয়া-এরনাকুলাম এক্সপ্রেসের ‘হাতিয়া’ শব্দটি মালায়ালাম ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে ‘হত্যা’ হয়ে গিয়েছে। হিন্দিতে ‘হত্যা’র সঙ্গে কী এক এক্কাদোক্কার দরুন একেবারে যা-নয়-তাই! গোটা ট্রেনটিই তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল দারুণ খুনে। মস্ত গোলমাল বুঝেই তড়িঘড়ি ভুল স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ সবকিছু শুধরে নিয়েছেন। এখন, নেটিজেনদের ধারণা অনুবাদের এই মস্ত কীর্তি হয়তো গুগল ট্রান্সলেটরেরই। হাজার হোক, তা তো আর তেমন পলিটিক্যাল কারেক্ট নয়। ভুল করেও ঠিক বলবে না এমন মানুষ এখনও হয়ে ওঠেনি। ফলত নেহাতই একটা ভুল যেন রেলপথের আঁতের কথাটা হাটের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। রেলপথের ইতিহাস যে নানাভাবে হত্যাকে স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত করেই এগিয়ে গিয়েছে, তা যেন আমাদের জেনেও না-জানা। আর সেই ধরি মাছ না ছুঁই পানির কল্যাণে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের বনতল আর বন্যপ্রাণ। এই বিপর্যয়ও ধারাবাহিক। ঢিমে দুর্ভিক্ষের মতোই সে হননপ্রক্রিয়া জারি রয়েছে। স্মৃতি উসকে উসকে সাল-তারিখ হিসাব না করলেও ট্রেনলাইনের উপর পড়ে থাকা মৃত কোনও হাতির ছবি আমরা মনে করতেই পারি। পারি কারণ, এই ঘটনা ঘটতেই থাকে। রেল আর বনদপ্তরের মধ্যে খানিক কথা চালাচালি হয়। কার দায়, কোনটি চিহ্নিত করিডর, হাতি চলাচলের গতিবিধির আঁচ আগাম দেওয়া হয়েছিল কি হয়নি– এই নিয়ে চলে দায় ঠেলাঠেলি। দুই দপ্তরকে দোষারোপ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, তবে ঘটনা হল, ক্রমাগত ঘটতে থাকা এই মৃত্যু আমাদের তেমন উদ্বিগ্ন করে তোলে না। বরং তা ক্রমে এতখানি স্বাভাবিক হয়ে যায় যে, আমাদের খেয়াল-করা-খবরের তালিকায় আর জায়গাই পায় না। ঠিক যেমন, গাছকাটা হলে বিধানসভায় শোকসভা বসে না বলে, কোথাও কোনও বৃক্ষনিধন হলেই আমাদের হেলদোল হয় না। অথচ যে কোনও রাজ্যে রেলপথ সম্প্রসারণের ইতিহাসে চোখ রাখলেই দেখা যাবে, হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। সরকার বাহাদুর, তা সে যে রঙেরই হোক না কেন, সভ্যতার এই জান্তব ধাতব শাখাপ্রশাখাকে আটকাতে পারে না। মাঝেমধ্যে বিদেশবিভূঁইয়ে ঝলমলে সেমিনার-টেমিনার বসলে পরিবেশ নিয়ে দু’-চারখানা কথা-টথা বলা হয় বটে; তবে তাতে প্রাচীন বৃক্ষের প্রাণরক্ষা হয় না।
আসলে রেলপথের একেবারে গোড়াতেই বোধহয় আমাদের বাস্তুতন্ত্রের সব ভারসম্য তছরুপ করার ছাড়পত্র দেওয়া আছে। ভারতবর্ষের বুক থেকে ধন শুষে নিতে যে কলের আমদানি, তা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে গুরুত্ব দেবে, এমন ভালমানুষির ধার অন্তত ঔপনিবেশিক প্রভুরা ধারেননি। মাঠ, বন, জলের বুকের উপর দিয়েই তাই ছুটে গিয়েছে সভ্যতার লোহার চাকা। এই পৃথিবীর বুকে বহু আগে আসা প্রাণও পরাস্ত হয়েছে মানুষের ক্ষমতালিপ্সার কাছে। মানুষেরই নির্মিত ধনতন্ত্রের এই আজব কুদরতি যে তাদের ধাক্কা দিয়ে প্রতিদিন মেরে ফেলবে কিংবা নির্বিচারে কেটে ছড়িয়ে ফেলবে তা তাদের কল্পনাতেও ছিল না। অথচ প্রকৃতিভাবনা ছাড়া সভ্যতার আর দ্বিতীয় কোনও সংগ্রাম দানা বাঁধার প্রশ্ন নেই আজ। শোষণের যে কাঠামো নিয়ম করে প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে, তা ক্রমে বিপন্ন করেছে মানুষের অস্তিত্বকেই। তার ভিটে, ভাত কেড়ে নিয়েছে। প্রকৃতিবিযুক্ত মানুষ ক্রমে হারিয়েছে তার হৃদয়, অনুভব আর সহমর্মিতা। এই আত্মচ্যুতি, খুনি বিচ্ছিন্নতা শোষণের ইস্পাতেই ক্রমাগত শান দিয়ে চলেছে। ফলত আজ কোনও লড়াই, কোনও প্রতিরোধ, কোনও রকম বিকল্প পথের অনুসন্ধানই প্রকৃতিভাবনাকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। ঠিক এই বিন্দুতে দাঁড়িয়েই আমরা খেয়াল করতে পারি, সভ্যতার আধুনিক অভ্যেস ধরানোর নামে আমাদের সেই প্রকৃতিসম্পৃক্ত যাপনের ভাবনার বীজটিকেই হত্যা করেছে রেলপথ। চ্যাপলিনের ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ যেমন শেষমেশ বলেন, ‘We have developed speed, but we have shut ourselves in. Machinery that gives abundance has left us in want.’ –রেলপথ তেমনই হত্যা করেছে আমাদের পরিপূর্ণতাকে, নিঃশব্দে।
অথচ এই দেশের মানসিক জলহাওয়ায় বন, বন্যপ্রাণকে কখনও পৃথক করে দেখার দৃষ্টি তো ছিল না। আমাদের রূপকথা সে ইঙ্গিত দেয়। ব্রতকথা বলে, গাছের কাছে মানুষের একান্ত বারোমাস্যা শোনানোর গল্প। শকুন্তলার আঁচল টেনে ধরে তপোবনের যে হরিণশিশু, সে কি আশ্রমিক নয়! শিশিরকুমার দাশ ‘অলৌকিক সংলাপ’-এ যখন কালিদাস আর অ্যারিস্টটলকে মুখোমুখি বসিয়ে দিলেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে গেল সেই সংস্কৃতি, কালিদাস বললেন, ‘আমার একটা বিশেষ জগৎ আছে, সে জগৎটাকে প্রথমে মেনে নিতে হবে। এই জগতে ঐশ্বরিক শক্তি বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তি বাইরে থেকে এসে ঢোকে না, এরা এই জগতেরই অংশ। এই জগতে মানুষ, পশু, গাছ এবং প্রয়োজন হলে দেবতা সবাই বসবাস করে। এ আপনার পছন্দ না হতে পারে, সেটা আলাদা প্রশ্ন। কিন্তু এইটেই আমার জগৎ। এই জগতে একটা হরিণশিশু এসে এক নারীর আঁচল ধরে টানে, যেমন করে শিশু তার মাকে টানে। এখানে মানুষ গাছপালার কাছে তার সুখদুঃখের কথা বলে। শকুন্তলা তপোবন ছাড়ার আগে তাই গাছপালার কাছে ঋষিরা তার চলে যাবার কথা জানায়। এর মধ্যে অতিপ্রাকৃতিক কিছু নেই। এইটেই আমার জগৎ।’ অ্যারিস্টটল আগ্রহ বোধ করলে আর একটু ভেঙে কালিদাস বুঝিয়ে দেন, ‘আমার জগতে সবই মানুষের নিয়মে বাঁধা। এখানে সবাই মানবিক– পশু, গাছ, স্বর্গীয় সত্তা। সকলেই একই ধরনের অনুভূতির অধিকারী– প্রেম ও যন্ত্রণা, সার্থকতা ও বিফলতা। সকলেরই ভূমিকা আছে, সেই ভূমিকা এরা পালন করে আলাদা আলাদা ভাবে নয়, সম্মিলিত ভাবে।’ রেললাইনের পত্তন আর সম্প্রসারণের বাস্তবতা যেন এই সম্মিলিত সংস্কৃতির একেবারে বিপ্রতীপ। তা মানুষের ধনতন্ত্রকামী লিপ্সাকে চরিতার্থ করতে চায়, অতএব তার সম্মিলিত জীবনকে কেটে ফালাফালা করতে দ্বিধা করে না।
আর মানুষ? সেও কি শেষমেশ বেঁচে যায় হত্যার এই পরিণতি থেকে? আসুন, স্মরণ করি। ঔরঙ্গাবাদের করমাডের কাছে রেললাইনের উপরই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ১৬ জন মানুষ। তাঁর আগে চল্লিশ কিলোমিটার হেঁটেছিলেন তাঁরা। তখন লকডাউন, পরিযায়ী শ্রমিক তাঁরা, হাঁটা ছাড়া ফেরার পথ নেই। ধরেছিলেন এই রেলপথই। তারপর ঘুমের ঘোর ঘনিয়ে আসায় শুয়ে পড়েছিলেন রেললাইনের উপরেই। বন্ধ পৃথিবীতে যে তখনও মালবাহী ট্রেন চলছে তা তাঁদের জানা ছিল না। ট্রেন আসার শব্দে সঙ্গীদের ডাকেও ঘুম ভাঙেনি তাঁদের। সে ঘুম আর ভাঙেইনি। সকাল হতে দেশ দেখেছিল, পড়ে আছে ছেঁড়া জুতো, গামছা, মাজন, মাস্ক আর কয়েকটা লাশ। সভ্যতার লাশ। রেলপথের লাশ।
তাঁদের হত্যা কোনও ভুল অনুবাদ ছিল না। সত্যিকারের হত্যা-ই।