প্রথম বর্ষের ছেলেটি মরে গিয়ে অনেক প্রশ্নের নতুন করে জন্ম দিয়ে গেল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের র্যাগিং পরম্পরা নিয়ে কথা যে আগে ওঠেনি, তা নয়। কিন্তু এখন প্রশ্নটা একেবারে দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে। অপরাধীর শাস্তির পাশাপাশি কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়, তা নিয়ে সবাইকে ভাবতেই হবে। আর, শুধু ভাবা নয়। করতেও হবে। কিন্তু কিশোর ছাত্রটির মৃত্যু র্যাগিং সমস্যার বাইরে আরও কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যা টিভি চ্যানেলের সান্ধ্য কুস্তির উচ্চকিত বিতণ্ডায় চাপা পড়ে গিয়েছে। অথচ ধরুন যদি এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অন্যরকম কিছু প্রশ্নও আমাদের ভাবিয়ে তুলত?
কোন বাধ্যবাধকতা থেকে নদিয়া থেকে কলকাতায় সদ্য-আগত একটি কিশোরকে তার অভিভাবক এক অপরিচিতের অতিথি হিসেবে ছাত্রাবাসে রেখে যেতে বাধ্য হন? হোস্টেলে নবাগতদের জন্য যথেষ্ট আসন নেই কেন? এ অবস্থায় বেসরকারি মেসের ব্যবস্থা করতে গেলে মাসিক খরচ কত পড়ে? পকেটে টাকা থাকলেও সব ধর্মের, সব জাতের ছেলেমেয়েরা যাদবপুরে মেস ভাড়া পায় কি? বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিং-বিরোধী কমিটির বাজেট বরাদ্দ কত? যথেষ্ট সুপার, রক্ষী, রাত্রিকালীন কুইক-রেসপন্স স্কোয়াডের বেতনের জন্য সরকার টাকা দেয় কি? সকল দূরাগত ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিরাপদ ছাত্রাবাস দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব ও বরাদ্দ থাকবে না কেন?
কিন্তু সত্যিই কি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ আছে? উত্তর হল, না। বর্তমানে বার্ষিক ৩০ কোটি টাকার ঘাটতিতে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। এটা একদিনে হয়নি। ২০১৭ সালে প্ল্যানিং কমিশনের জায়গায় নীতি আয়োগ আসার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বার্ষিক চার কোটি টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। ইউজিসি মেজর রিসার্চ গ্রান্ট দেওয়া বন্ধ করে দেয়। রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান (রুসা) থেকে ১০০ কোটির অনুদান ঘোষণা করেও পাঠানো হয় মাত্র ৪১ কোটি। বিগত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দের অংশ ১৫ শতাংশ কমেছে। রাজ্য সরকারের অংশ যদিও বা ২০ শতাংশ বেড়েছে, তবুও রাজ্য সরকারের মোট বরাদ্দের পরিমাণে বিগত তিন বছরে ১০ কোটি কাটছাট রয়েছে। মোদ্দা হিসাবে, প্রতি বছর যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে কমপক্ষে ৫৫ থেকে ৬০ কোটি টাকার প্রয়োজন, সেখানে সরকারি বরাদ্দ মাত্র ২৫ কোটি। ফলাফল? অশিক্ষক কর্মচারিদের একাংশের ঠিকাকরণ, গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি খাতে বরাদ্দের বিপুল হ্রাস, গ্রন্থাগারের ভাঁড়ে মা ভবানী, ব্যয় সংকোচনের কমিটি গঠন, এমনকী আর্থিক সাহায্যের জন্য প্রাক্তনীদের কাছে ভূতপূর্ব উপাচার্যের খোলা চিঠি লেখা! পরিকাঠামোর এহেন বেহাল দশার মাঝে র্যাগিং-বিরোধী কমিটির ব্যয়বরাদ্দ ও নবাগতদের নিরাপত্তার হাল কেমন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। জরুরি কথাগুলো আড়াল করে স্রেফ আড়াই কোটির প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ড এখনই আসছে না কেন, তা নিয়ে সান্ধ্য হাড্ডাহাড্ডি জমালেই কি সমস্যা মিটে যাবে?
বাজেটের গল্পের অবশ্য এখানেই শেষ নয়। গত ছ’বছর জুড়ে যখন ধাপে ধাপে সরকারি বরাদ্দ বন্ধ করা হয়েছে, তার পাশাপাশিই কেন্দ্রীয় সরকারের নানা র্যাঙ্কিং-এ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবিধ শিরোপা-সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের উৎকর্ষের মাপকাঠিতে দেশের যে ৬২টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ‘স্বশাসিত’ বলে ঘোষণা করা হয়, তার মধ্যে যাদবপুরও ছিল। ২০১৬ সাল থেকে যে এনআইআরএফ র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তাতে যাদবপুর সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে এখন চার নম্বরে। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? যত উৎকর্ষ, তত উঁচু র্যাঙ্ক। যত উঁচু র্যাঙ্ক, তত ‘স্বশাসন’। যত ‘স্বশাসন’, তত বরাদ্দ কাটছাঁট। তাহলে উৎকর্ষযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ঠিক কীভাবে কাজকর্ম চালাবে? কেন, ঋণ নিয়ে! উপায় বাতলে দিয়েছেন মহামান্য সরকার। চালু করেছেন নতুন এক মহাজনী কারবার, যার নাম ‘হায়ার এডুকেশন ফাইনান্সিং এজেন্সি’ (সংক্ষেপে ‘হেফা’)। হেফা-র মাধ্যমে বেসরকারি পুঁজির ঋণ নিয়ে চলবে ‘স্বশাসিত’ বিশ্ববিদ্যালয়। ঋণের বোঝা হালকা করতে তারা চালু করবে দামি দামি সেলফ-ফাইনান্সড কোর্স। বেশি বেতন দিয়ে আনবে বিদেশি মাস্টার। বেশি ফি দিয়ে পড়বে বিদেশি ছাত্র। কোম্পানির সঙ্গে পিপিপি মডেলে গাঁটছড়া বেঁধে নানা কায়দায় পুঁজি বিনিয়োগ হবে। বিদেশি পুঁজির লগ্নি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঋণ চোকাতে বর্ধিত ফি দিয়ে মহার্ঘ্য উচ্চশিক্ষার ক্রেতা হবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। এমনই জমজমাট হবে অমৃতকালের বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎকর্ষ-যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে বের করে তাদের টাকাপয়সা বন্ধ করে টুঁটি টিপে ভাতে মারার এমন সোজাসাপটা পদ্ধতিকে কুর্নিশ না করে উপায় নেই। এভাবেই অমৃতকালে ধীরে ধীরে যতেক শিক্ষাঙ্গন উৎকর্ষ-মুক্ত হবে। সেইসঙ্গে উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গন থেকে উচ্ছেদ হবে দেশের গরিবগুরবো প্রান্তিক ছেলেমেয়ের দল। কীভাবে? যাদবপুরে চার বছরের ডিগ্রি কোর্সের টিউশন ফি এখনও দশ হাজার। এখনও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে মাসে দু’হাজার টাকায় থাকা ও খাওয়া সম্ভব। তুলনায় আইআইটি খড়গপুরের ছাত্রাবাসে থেকে চার বছরের ডিগ্রির খরচ দশ লাখ। বাংলার বিভিন্ন বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ওই খরচা পাঁচ থেকে দশ লাখ। যাদবপুরে এখনও যে বাংলার সমস্ত প্রান্তের শ্রমজীবী পরিবারের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়, তা স্রেফ এযাবৎকালের সরকারি অনুদানভিত্তিক কাঠামোর জন্য। এখন যে কাঠামোকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, এমতাবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের জন্য সরকার কী চায়? বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের মাত্র চার শতাংশ আসে টিউশন ফি থেকে। সরকার চায় সে সংখ্যাটা বেড়ে হোক ৩০ শতাংশ! সর্প হয়ে দংশে ওঝা হয়ে ঝাড়ফুঁকের এমন নিদর্শন বড় একটা পাওয়া যায় না।
তাহলে আসন্ন অমৃতকাল সমাগমে ঠিক কোন জায়গায় এসে দাঁড়াবে নদিয়ার প্রান্তিক গ্রামের অন্য কোনও এক প্রথম বর্ষের কিশোর? প্রান্ত থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের মুখের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা সশব্দে বন্ধ করে দেওয়ার একমাত্র উপায় বর্ধিত ফি কাঠামো, এমনটা যদি ভেবে থাকেন তো ভুল ভাবছেন। আরও উপায় আছে। সে পথের নকশা আঁকা আছে ‘নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০’-র পাতায় পাতায়। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রথমে রুগ্ণ করে তারপর বেসরকারি হাতে বিক্রি করে দেওয়ার নীতি নিয়েছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু হচ্ছে বেসরকারিকরণের প্রস্তুতি। হাজার হাজার প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্কুল সংযুক্তি’। পরীক্ষার চাপ কমানোর নাম করে সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে স্কুলছুট বা কলেজছুট বাড়ানোর (হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন!) নাম দেওয়া হয়েছে ‘এক্সিট রুট’। প্রতিটা ধাপে পরীক্ষা ও পাঠ্যসূচির কেন্দ্রিকরণকে পোক্ত করা হচ্ছে। আর তফশিলি জাতি, উপজাতি ও ওবিসি সংরক্ষণের মাধ্যমে যেটুকু সামাজিক ন্যায়ের ব্যবস্থা ছিল? তা যে ঢালাও বেসরকারিকরণের তোড়ে খড়কুটোবৎ ভেসে যাবে, তা বলাই বাহুল্য। বাঁশঝাড়টিই কেটে ফেললে যেমন বাঁশি বাজার প্রশ্ন নেই, তেমন সরকারি শিক্ষাক্ষেত্র না থাকলে আর সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নই থাকে না।
র্যাগিং একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যার শিকড়ে আছে পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি। সেই র্যাগিং সংস্কৃতি এক কিশোরের জীবনের স্বপ্নকে মর্মান্তিক ভাবে শেষ করে দিয়েছে। তা নিয়ে লড়াইয়ের পাশাপাশি যে কাঠামোগত সংকট কোটি কোটি স্বপ্নদীপের স্বপ্নের দরজাকে বন্ধ করে দিচ্ছে, তা নিয়েও কি ভাবব না? আজ না ভাবলে কিন্তু বড় দেরি হয়ে যাবে। আরেকটু পা চালিয়ে তাই দেখাই যাক না।