জানি এ বঙ্গে দিনে মাছি আর রাতে মশা নিয়েই ঘরকন্না। কিন্তু তা বলে বুদ্ধু-ভুতুম যুগ পার করে ক্যালকাটা থেকে কলকাতা হয়েও নিদেনপক্ষে মশার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে, এর থেকে লজ্জা আর কী হতে পারে! প্রতি বছর যখনই তেনারা এসে হাজির হন, তখনই দেখি কী তৎপরতা। এই মশা মারার ওষুধ স্প্রে চলছে। এই ধর ধর মশার লার্ভা। ফেল ফেল জমে থাকা জল। ড্রোনে করে তেল ছড়িয়ে কড়া নজরদারি। এদিকে আমরা দুয়ারে এঁটে ঘুমিয়ে পড়ছি।
সুরের কোনও কমতি নেই। সেটা কানের কাছে এলেই কিঞ্চিৎ বোঝা যায়। শুধু বোঝা যায় না কুটুস করে কামড়ে দিয়ে যমের দক্ষিণ দুয়ারে হাজির করে দিলে দায়টা কার।
পুজোর সময় অসুর আসবে। মা দুগ্গা তাকে মারবেন। রক্তারক্তি ব্যাপার! এ তো চলছেই। পার্বতী তো আর যুদ্ধে একা নন। একটা সিংহ আছে। দশ হাতে দশটা মারাত্মক অস্ত্র আছে। মাথার উপরে দেবাদিদেবও আছেন। অসুর মহিষের রূপ নিলেও তাই রক্ষা নেই। ঘ্যাঁচ করে বুকে বর্শা বিঁধিয়ে নিকেশ করে ফেলা গিয়েছে। কিন্তু অসুর মশার রূপ নিলে এসব জারিজুরি এক্কেবারে ভুস।
এদিকে পেটরোগা বাঙালির হাতই তো একমাত্র সম্বল। তাই দিয়ে তালি মেরে মেরে আর কাঁহাতক মশার বিরুদ্ধে লড়া যায়। চাঁদনি চকের বাজার থেকে মশা মারার ব্যাট কিনে এনেও অনেক প্র্যাকটিস করেছি। কিন্তু ম্যাকেনরোর মেজাজে শেষ পর্যন্ত ব্যাট ছুড়ে ফেলেছি। অবেশেষে তা ঠাঁই করে নিয়েছে আলমারির ওপরে। মশা বহাল তবিয়তে সেই দৃশ্য দেখে মিটিমিটি হেসেছে কি না, বুঝতে পারিনি। তবে হুল বাগিয়ে কুল মাথায় শরীরের বিচিত্র সব হাত না পৌঁছনো জায়গায় এসে ল্যান্ড করায় কোনও বিরাম ঘটেনি। সব থেকে বিরক্তিকর হল বারবার পরাস্ত হওয়া। নিজেকে নিজে মারধর করার মতো সুইসাইডাল প্রভাব বিস্তার করার জন্য মশাকে কাঠগড়ায় তোলা উচিত। আর সব থেকে বড় কথা, হুলের মধ্যে কখনও ম্যালেরিয়া, কখনও ডেঙ্গুর বিষ গুলে নেওয়ার জন্য তো মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্যই প্রাপ্য।
ব্যাপারটা রসিকতার পর্যায়েই থাকত, যদি না ফি বছর এতগুলো প্রাণ খোয়াতে হত। জানি এ বঙ্গে দিনে মাছি আর রাতে মশা নিয়েই ঘরকন্না। কিন্তু তা বলে বুদ্ধু-ভুতুম যুগ পার করে ক্যালকাটা থেকে কলকাতা হয়েও নিদেনপক্ষে মশার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে, এর থেকে লজ্জা আর কী হতে পারে! প্রতি বছর যখনই তেনারা এসে হাজির হন, তখনই দেখি কী তৎপরতা। এই মশা মারার ওষুধ স্প্রে চলছে। এই ধর ধর মশার লার্ভা। ফেল ফেল জমে থাকা জল। ড্রোনে করে তেল ছড়িয়ে কড়া নজরদারি। এদিকে আমরা দুয়ারে এঁটে ঘুমিয়ে পড়ছি। পুরসভার লোক এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বেল টিপে ক্লান্ত। ঘরের ভিতরে ঢোকার অনুমতি মিলছে না। বাহারি গাছের টবে জল জমছে। ঘরে ঢুকলে না জানি আরও কী করে রেখেছি, দেখে ফেলবে যে। আবার পাশে ফ্ল্যাট উঠছে। ছাদ করে জল ঢেলে রাখা। বলবে কে? খাবারের প্লাস্টিকের বাক্স ছুড়ে ফেলেছি। তাতে জমে জল। দেখবে কে? মশারি টাঙিয়ে শোয়ার মধ্যে আবার সেমি-আরবান ছাপ। এদিকে গরমের মধ্যে বাচ্চা ফুল-স্লিভ জামা, ফুল প্যান্টে ঘেমে-নেয়ে একসা! গায়ে মশা যাতে না বসে তার জন্য আবার হরেক রকম স্প্রে। ঘরের মধ্যে সর্বক্ষণ জ্বলছে রিপেল্যান্ট। অথচ বছরভর একটু নজর দিলেই এত কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। ফি বছর এতগুলো করে ডেঙ্গু আক্রান্তের মৃত্যু ঘটে না। আতঙ্কও ছড়ায় না। এখন তো জ্বর হলেই ঘরে ঘরে টেনশন। এই রে, ডেঙ্গু নয় তো!
এত কিছুর পরও অবশ্য আমরা এ ওকে ঠেলছি, ও একে! পুরসভার করা উচিত বলে চোখ ঢাকছি। পুরসভা বলছে, নাগরিকরা সচেতন হচ্ছে না। বল একবার এ প্রান্তে। পরক্ষণেই ও প্রান্তে। এর মাঝেই প্রাণবায়ু খাঁচাছাড়া। আসলে আমরা করব না, সব কিছু আমাদের হয়ে করে দিতে হবে। শুধু বিবেক জাগ্রত করে দাঁড়িয়ে থাকলে কি সমস্যা মিটবে? ডেঙ্গু হচ্ছে, সেটা বাস্তব। তাতে মৃত্যুও হচ্ছে, সেটাও বাস্তব। শুনতে সহজ বটে, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা জানতে ব্যোমকেশ ছাড়া গতি নেই। কেন? কীসের জন্য গোপনীয়তা? বরং রোগকে স্বীকার করে কড়া দাওয়াই দিয়ে মশক বংশ নির্মূল করার পথে হাঁটাটাই তো শ্রেয়। কে জানে!
এবারও আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪০ হাজারের গণ্ডি। মৃত্যুও প্রায় ৫০-এর কাছাকাছি। এ নিয়ে তর্ক রয়েছে। থাকতেও পারে। সরকারি-বেসরকারি নিয়ে দ্বন্দ্বও চলকু। তবে ডেঙ্গুর এমন প্রাণঘাতী চেহারা তো শুধু এখানেই নয়– বিশ্বজুড়েই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এ পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তা প্রতি বছর সংক্রমণের সংখ্যা ১০০-৪০০ মিলিয়ন। বিশেষ করে আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশের শহর ও শহরতলিতে এটা মারাত্মক আকার নিচ্ছে। এশিয়াতে ডেঙ্গুর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই বেশি। বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম এগিয়ে এশিয়ার মধ্যে। তবে বাদ যাচ্ছে না ইওরোপের দেশগুলোও। এসব এই জন্যই বলা যে মশার লার্ভা বিনষ্ট করা ছাড়া আর যে বাঁচার পথ নেই। এই সোজা ব্যাপারটা বুঝে গেলেই কেল্লা ফতে! কিন্তু সেখানেই তো গন্ডগোল। সারা বছর ধরে মশার পিছনে না লেগে থাকার ফল প্যাচপ্যাচে বর্ষার জল কোথাও না কোথাও জমে যাওয়ায়। অবস্থাটা যে এ বছর বেশ বাড়াবাড়ি হয়েছে, তা সরকারি স্বাস্থ্যকর্তাদের দৌড়ঝাঁপ দেখলেই বেশ বোঝা যায়। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাগরিকদের সচেতনতার বিন্দুমাত্র উন্নতি হলেই যে সভ্য দেশে অনেকগুলো প্রাণ বাঁচানো যায়, সেটা মগজে কিছুতেই বোধহয় ঢুকছে না।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved