২৫টা বছরে বিজ্ঞান, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যার কত না গুপ্ত রহস্য উন্মোচিত হল। তবু নষ্ট মেয়ে কাকে বলে, সে প্রশ্নের উত্তর রইল অধরা। সংক্রামক বীজাণুর মতো, রক্তবীজের ঝাড়ের মতো অবিরাম যার বিস্তার মানব-মননে, তাকে উত্তরের আঙিনায় বাঁধবে কে! তাই ‘নষ্ট’ মেয়ের ফর্দ লম্বা হয়; ধর্ষণে, শারীরিক নিগ্রহে কিংবা পাচারে। চাকরি সেরে রাত করে ঘরে ফিরে কিংবা অফিস প্রোমোশনে। অকালে স্বামীহারা হয়ে প্রতিবেশী যুবকের পাশবিক লালসায় কিংবা শখের শাড়ি শৌখিনভাবে পড়ার তাড়নায় সে নিত্য ‘নষ্ট’ হয়। অগণিত, অদৃশ্য খাপ-পঞ্চায়েতে তার অনন্ত বিচারসভা বসে। অনির্বাণ সে শব্দ রাঢ় থেকে রাজস্থান ধাওয়া করে বেড়ায়। দূষণ ছড়ায় শব্দ বেয়ে– ‘নষ্ট মেয়ে’।
প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমশ্রী দাস
জামাইবাবু এসেছিলেন দিদির মৃত্যুর খবর দিতে। পিসিমার মাদুরে শুয়ে পঞ্চদশী কমল চেষ্টা করছিল অকালমৃত দিদির মুখটা মনে করার। এসবের মাঝে বেলা পড়ল। অপরাহ্ণের আলো নিভে যাওয়ার আগে তীব্রতম হল। আর সে আলোয় কমলের কপাল পুড়ল। এক খিলি পানের বায়না মেটাতে সে ঢুকেছিল জামাইবাবুর ঘরে। এরপর তড়িৎ ক্ষিপ্রতায় যা ঘটল; নিরক্ষর ও মাতৃহারা হলেও, কে বা কারা যেন সময়মতো তাকে ঠিক শিখিয়ে দিয়েছিল, সেসব ঘটলে মেয়েরা ‘নষ্ট’ হয়। যদিও সবাই তাকে ‘নষ্ট’ মেয়ে জানল আরও মাস দশকে পর। কলকাতা পালানোর পথে কোঠায় পাচার হলে। শুধু কমল মানত, এ-কোনও নতুন খবর নয়। নষ্ট সে সেইদিনই হয়েছিল। আজ ‘বদবু’ ছড়িয়েছে। তাই কাকপক্ষী টের পেয়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নষ্ট মেয়ে’ গল্পের প্রোটাগনিস্ট কমল নিজেই নিজেকে ‘নষ্ট’ ভেবে নিয়েছিল, সমাজ তাকে ‘নষ্ট’ দাগিয়ে দেওয়ার আগেই। এ-হল ‘হার্ড বিহেভিয়ার’ বা ‘ওপ্রেসড গ্রুপ বিহেভিয়ার মডেল’-এর ক্লাসিক উদাহরণ। যার ফলস্বরূপ, সংসারের সকল কুকার্যের কারণ হিসেবে মেয়েদের নিজেকে দোষী ভাবতে শিখিয়েছে সমাজ। ১৯৯৮ সালের এ-গল্পের পর কত চন্দ্রালোক অমাবস্যা কাটল। ২৫টা বছরে বিজ্ঞান, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যার কত না গুপ্ত রহস্য উন্মোচিত হল। তবু নষ্ট মেয়ে কাকে বলে, সে প্রশ্নের উত্তর রইল অধরা। সংক্রামক বীজাণুর মতো, রক্তবীজের ঝাড়ের মতো অবিরাম যার বিস্তার মানব-মননে, তাকে উত্তরের আঙিনায় বাঁধবে কে! তাই ‘নষ্ট’ মেয়ের ফর্দ লম্বা হয়; ধর্ষণে, শারীরিক নিগ্রহে কিংবা পাচারে। চাকরি সেরে রাত করে ঘরে ফিরে কিংবা অফিস প্রোমোশনে। অকালে স্বামীহারা হয়ে প্রতিবেশী যুবকের পাশবিক লালসায় কিংবা শখের শাড়ি শৌখিনভাবে পড়ার তাড়নায় সে নিত্য ‘নষ্ট’ হয়। অগণিত, অদৃশ্য খাপ-পঞ্চায়েতে তার অনন্ত বিচারসভা বসে। অনির্বাণ সে শব্দ রাঢ় থেকে রাজস্থান ধাওয়া করে বেড়ায়। দূষণ ছড়ায় শব্দ বেয়ে– ‘নষ্ট মেয়ে’।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
খবর বলছে, আজমীরের জেলা শিশু কল্যাণ দপ্তরের মধ্যস্থতায় এই বিষয়টি জেলা শিক্ষা আধিকারিকের তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়েছে। যাতে অন্তত পরের বছর মেয়েটি পরীক্ষায় বসতে পারে। খুব সম্ভবত এটুকুতেই এই কেসটির নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। যত্ন করে মেয়েটিকে বোঝানো হবে যে সে কত ভাগ্যবান। বলা হবে, দেখো তুমি ধর্ষিত, তবু সবাই তোমার জন্য লড়েছে। সবাই মিলে লড়াই করে মাত্র এক বছরের মধ্যেই তোমায় আবার পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দেখো মেয়ে দেখো, তোমার জীবন কী চমৎকার!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সে ভীষণ দূষণে বিদ্যালয়ের মতো পবিত্র স্থানের পরিবেশ নষ্ট হয়। তাই বিদ্যালয়ের মর্যাদা রক্ষার্থে রাজস্থানের আজমীরের যে মেয়ে গেল বছরের ১৮ অক্টোবর গণধর্ষিত হয়েছে, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে গোটা বছর স্কুলে ঢুকতে দেয় না। তারপর অনুপস্থিতির কারণ দর্শিয়ে স্কুল থেকে তার নামটিও দেয় কেটে। এমনকী, দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষাতেও তাকে বসতে দেওয়া হয় না। কারণ কর্তৃপক্ষ মনে করে, ‘সে এলে বিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। বাকি ছাত্রীদের ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে।’
খবর বলছে, আজমীরের জেলা শিশু কল্যাণ দপ্তরের মধ্যস্থতায় এই বিষয়টি জেলা শিক্ষা আধিকারিকের তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়েছে। যাতে অন্তত পরের বছর মেয়েটি পরীক্ষায় বসতে পারে। খুব সম্ভবত এটুকুতেই এই কেসটির নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। যত্ন করে মেয়েটিকে বোঝানো হবে যে সে কত ভাগ্যবান। বলা হবে, দেখো তুমি ধর্ষিত, তবু সবাই তোমার জন্য লড়েছে। সবাই মিলে লড়াই করে মাত্র এক বছরের মধ্যেই তোমায় আবার পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দেখো মেয়ে দেখো, তোমার জীবন কী চমৎকার! ভারতের মতো দেশে, যেখানে অগণিত ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ না হওয়ার পরেও ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১৬ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিত হন, তারপর নগ্নাবস্থায় খুন হয়ে পড়ে থাকেন খেতের আড়ালে, কারখানার বর্জ্যে কিংবা ঝোপের পাশে, আর সে ঘটনা সবথেকে বেশি ঘটে তোমারই রাজ্য রাজস্থানে, সেখানে দাঁড়িয়ে যে বিচার তুমি পেয়েছ, সে তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
এত আশীর্বাদধন্য আর একাদশ শ্রেণিতে ৭৯ শতাংশ নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও মেয়েটির জীবন কিন্তু কোনও দিন আর গড়াবে না স্বতঃস্ফূর্ত খাতে। কাল উচ্চশিক্ষায়, পরশু চাকরি ক্ষেত্রে, সর্বত্র তার এই নষ্ট হওয়া এক বছরের হিসেব চাওয়া হবে। আর যতবার সে প্রশ্ন আসবে, ততবার আরও একবার ধর্ষিত হবে সে, তাকে ‘নষ্ট’ ভাববে সমাজ।
কেউ প্রশ্নও তুলবে না যে ন্যায় দূরে থাক, কোনও সমাধানই কি মেয়েটিকে দেওয়া হল আদৌ? কেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরূদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? কেন ‘শো-কজ’ করা হবে না সেইসব শিক্ষক-শিক্ষিকাদের, যারা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি? কেন জিজ্ঞেস করা হবে না যে, জ্ঞানের আলোয় হিসেবে যে প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কান্ডারি গড়ার কাজে ব্রত, তারা যদি তাদের-ই বিদ্যালয়ের ছাত্রীকে গণধর্ষিত হওয়ার অপরাধে নষ্ট ভেবে নেয়, তাহলে কী মূল্য আছে সেই বিদ্যালয়-প্রাপ্ত জ্ঞানের? যে সনাতন ধর্ম নিয়ে আমাদের এত উত্তেজনা, উন্মাদনা, তার অন্যতম ধর্মগ্রন্থ বেদের শ্লোক আউড়ে কেন কেউ বলবে না;
‘যত্র যত্রাপি পৃথিব্যাং বর্ত্ততে বিদ্বান্ ভগবৎ সেবকোত্তমঃ
জ্ঞানান্বেষণায় গন্তব্যং তত্তৎ স্থানং তীর্থভূতং পবিত্রম্।’
(জ্ঞানের অন্বেষণে পৃথিবীর সকল প্রান্তে গমন করো। জ্ঞানবান ব্যক্তিই আসলে ঈশ্বরের সেবা করেন। তাই জ্ঞানবান ব্যক্তির সঙ্গলাভও পবিত্র।)
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সন্তানকে খাওয়ানোর মতো সঙ্গতি এখনও বহু অভিভাবকের নেই
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এসব কথা কেউ মুখ ফুটে বলবে না। বলবে না যে, যদি বেদ সত্য হয়, তাহলে মেয়েটির জ্ঞানতৃষ্ণাও পবিত্র। তাই এ-মেয়ের প্রাপ্য ছিল উল্টো। সে হতে পারত এদেশের সকল মেয়ের লড়াইয়ের নাম। কারণ নিউ ইয়র্কের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর প্রতিবেদন বলছে, এ-দেশে প্রতি বছর ৭২০০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ধর্ষিত হয়। আর তারপর রিপোর্ট লেখাতে গিয়ে আরও একবার নিগৃহীত হয় পুলিশ-প্রশাসনের হাতে। তার মাঝেও রাজস্থানের মতো পিছিয়ে থাকা রাজ্যে জন্মানো এই যে মেয়েটি, নিগৃহীত হয়েও ভবিষ্যৎ লক্ষ্যে অবিচল, স্কুল থেকে নাম কেটে দিলেও যে পরীক্ষা দিতে হাজির হয়, শত শরীরী নিগ্রহ আর সামাজিক ভর্ৎসনাও যে মেয়ের আত্মশক্তি গুঁড়িয়ে দিতে পারে না, স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান– কিছুই যে মেয়েকে ‘নষ্ট’ বলে দমাতে পারে না, সে মেয়ের মধ্যে কমলা বাসিনের মতো নির্ভয়া বাস করে। সদর্পে বলে যায়; ‘যে শরীরে আমি আমার ইজ্জত বেঁধে রাখিনি, সে শরীরের ধর্ষণে আমি নষ্ট হই কী করে?
সে মেয়ে ভারতের আশীর্বাদ। এদেশে মেয়েদের কল্যাণে তৈরি যত আইন, প্রকল্প, বিকল্প ব্যবস্থা, যেমন কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ আইন, পকসো আইন, গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধ আইন, সংশোধিত ফৌজদারি আইন ইত্যাদি যা কিছু কল্যাণকর, নারী উন্নয়নে তৈরি, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সেসবের সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রচারের মুখ হতে পারত এই মেয়ে।
কারণ বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, স্রোতের উল্টোদিকে, সে নিজেই যে আস্ত একটা লড়াই।