বাকি ভারতবর্ষের একটা ধারণা আছে যে, বাঙালি বোধহয় রাম-উপাসনায় খানিক বিমুখ। সে-ধারণা সম্ভবত অজ্ঞানতাপ্রসূত। কেন-না রামকে গ্রহণের বাঙালির এই নিজস্ব রসায়নটি তাঁরা সম্ভবত খেয়ালই করেন না। যে অকালবোধন কৃত্তিবাসের হাত ধরেই এল তাই-ই তো বাঙালির সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটি হয়ে দাঁড়াল। তাহলে রাম আর বাঙালির থেকে দূরে সরে রইলেন কোথায়! প্রচ্ছদের ছবি: যামিনী রায়।
প্রাণ পেলেন রামলালা। অযোধ্যার মন্দিরে মহা আয়োজন। মহা সমারোহে হল প্রাণপ্রতিষ্ঠা। সেই উপলক্ষে দেশ জুড়ে সার্বিক উদ্দীপনার ভিতর বসে কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে, এই বাংলায়, বাংলার প্রাণের উৎসব কিন্তু রামচন্দ্রকে কেন্দ্র করেই। বলা যায়, রামের সূত্র ধরেই বাঙালি তার আপন পরিচয়ের অনন্যতা অর্জন করেছে, সাধের দুর্গাপুজোকে গণউৎসবে রূপান্তরিত করে। এমন নয় যে, দুর্গাপুজো কেবলমাত্র বাঙালির প্রথা। তবে এ-কথা অনস্বীকার্য যে, দুর্গাপুজোকে বাঙালির কাছে শুধু উৎসব নয়। বরং বাঙালি চরিত্র ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তা একটি পৃথক সংস্কৃতির রূপ নিয়েছে। যা বাঙালির একান্ত আপন, নিজস্ব। আর সেই সংস্কৃতির নেপথ্যে থেকে গিয়েছেন রামচন্দ্র এবং তাঁর অকালবোধন।
এখানে অবশ্য একটি কূট প্রশ্নের উত্থাপন হতেই পারে। বলা যায়, অকালবোধন তো মূল বাল্মীকি রামায়ণে ছিল না। না থাক, কৃত্তিবাসে তো ছিল। ঠিক এখানেই রাখা আছে বাঙালির রাম-অর্চনের নিজস্বতা। বাঙালি রামকে দূরের বিগ্রহ করে সরিয়ে রাখেনি কস্মিনকালেও। বাল্মীকি তো তাঁকে আদর্শ মানুষ হিসাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। রামচন্দ্র নরচন্দ্রমা। বুদ্ধদেব বসু তাই বাল্মীকির রাম সম্পর্কে বলেন, ‘বাল্মীকিতে এ-কথাটা জোর দিয়েই বলা হয়েছে যে রাম অবতার হলেও, মানুষ, নিতান্তই মানুষ। মনুষ্যত্বের মহত্তম আদর্শের প্রতিভূ তিনি, বিশেষ কোনও একটি দেশের বা যুগের নয়, সর্বদেশের, সর্বকালের। দেহধারী মানুষ হয়ে, স্থানে ও কালে সীমিত হয়ে, যতটা মুক্ত, শুদ্ধ, সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব, রামচন্দ্র তা-ই।’ মহাকাব্যের এই মন ও মেজাজটিকেই গ্রহণ করেছিলেন বাঙালি কবি। বাঙালির মেধা আর মননের মধু যখন তাই রামচরিতে এসে মিশল তখন আমরা পেয়ে গেলাম রামের সার্থকতম রূপান্তর। মনে রাখতে হবে, বুদ্ধদেব কিন্তু কৃত্তিবাসকে বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদকের অভিধায় সীমিত রাখছেন না; বলছেন তিনি, ‘রামায়ণের বাঙালি রূপকার’। ফলত বাঙালি তাঁর রামকে পেল একেবারে নিজস্ব রূপে। বাঙালির রামচর্চায় মিশে থাকল বাঙালির স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি যার জন্য কৃত্তিবাসী রামায়ণের ‘প্রাকৃতিক ও মানসিক আবহাওয়া একান্তই বাংলার’ বলতে দ্বিধা করেন না বুদ্ধদেব।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘থ্রি অফ আস’ সিনেমা সম্পর্কিত লেখা: ভুলে যাওয়া দেশের পাসপোর্ট
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এ-কথা আর নতুন করে বলার নয় যে, কৃত্তিবাসের হাতে রাম অর্জন করেছিলেন বাঙালির বিশিষ্টতা। সে রাম কাঁদেন এবং কাঁদানও। তাঁর চলন-বলন, কথনও বাঙালিসুলভ। যে আদর্শ মানুষের প্রতিমা মহাকবি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, স্থান-কাল-সময় ভেদে তার আদর্শ রূপ কী হতে পারে, তারই যেন একটা নিরীক্ষা পাওয়া গেল কৃত্তিবাসের হাতে। অতএব বাঙালির জন্য যে রামের জন্ম হল, সেই রাম যে বাঙালির সামাজিক সংস্কৃতিতে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠবে, তা সহজেই অনুমেয়। বাকি ভারতবর্ষের একটা ধারণা আছে যে, বাঙালি বোধহয় রাম-উপাসনায় খানিক বিমুখ। সে-ধারণা সম্ভবত অজ্ঞানতাপ্রসূত। কেন-না রামকে গ্রহণের বাঙালির এই নিজস্ব রসায়নটি তাঁরা সম্ভবত খেয়ালই করেন না। যে অকালবোধন কৃত্তিবাসের হাত ধরেই এল তাই-ই তো বাঙালির সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটি হয়ে দাঁড়াল। তাহলে রাম আর বাঙালির থেকে দূরে সরে রইলেন কোথায়!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
মনে রাখতে হবে, বুদ্ধদেব কিন্তু কৃত্তিবাসকে বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদকের অভিধায় সীমিত রাখছেন না; বলছেন তিনি, ‘রামায়ণের বাঙালি রূপকার’। ফলত বাঙালি তাঁর রামকে পেল একেবারে নিজস্ব রূপে। বাঙালির রামচর্চায় মিশে থাকল বাঙালির স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি যার জন্য কৃত্তিবাসী রামায়ণের ‘প্রাকৃতিক ও মানসিক আবহাওয়া একান্তই বাংলার’ বলতে দ্বিধা করেন না বুদ্ধদেব।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
তবে, এই সংস্কৃতি অনুধাবনের ক্ষেত্রে বাঙালির রামচর্চার ধারাবাহিকতাটি খেয়াল রাখতে হবে। এমনকী, নবজাগরণ পর্বটিও সেখানে বড় ভূমিকা নিয়েছে। মধুসূদন দত্ত রামায়ণের টেক্সটিকে তুলে নিয়েই তাকে প্রতিস্থাপন করছে ভাবনার একেবারে অন্য অক্ষে। নতুন একটা চিন্তার স্রোত তাঁর হাত ধরে খুলে যাচ্ছে। যেখানে রামায়ণের উদ্দেশে প্রশ্ন ধাবিত হচ্ছে। উপেক্ষিতের বয়ান, পরাজিতের বয়ান সেখানে মুখ্য উপজীব্য হয়ে উঠছে। লক্ষণীয় যে, এই অবকাশ কিন্তু মহাকাব্যের অন্দরেই রাখা ছিল। বালী বধ যখন সম্পন্ন হল, তখন কিন্তু বালীর প্রশ্নের মুখ থেকে, তিরস্কারের মুখ থেকে ছাড় পাননি নরচন্দ্রমা। যিনি হতপ্রায়, তাঁরও মুখে কথা জোগায় মহাকাব্য। ফলত সেই ঔপনিবেশিক বাংলায় মধুসূদন যে চিন্তার দুয়ার খুলে দিলেন, তাতে যেন আরও খানিক প্রসারিতই হল মহাকাব্যের পরিধি।
আবার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রামায়ণকে পড়েছেন নানা প্রেক্ষিতে, বিশ্লেষণ করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তিনি রামচরিত্রকে বিচার করেছেন এক বৃহত্তর ঐতিহাসিকতার সূত্রে। কেন যে রামের মতো একটি চরিত্র, রামায়ণের মতো একটি টেক্সট যুগে যুগে মানুষের মনে সজীব হয়ে থেকেছে, তা তিনি খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন বহুবিধ প্রেক্ষিতে। ফলত বাঙালির রাম-অনুধাবনে খুলে গিয়েছিল আরও নতুন দিগন্ত। আবার কৃত্তিবাসের দরুন বাল্মীকির রাম থেকে বাঙালির যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তা যেন দূর করে দিলেন রাজশেখর বসু, তাঁর রামায়ণের সারানুবাদে। বাল্মীকির রাম তাঁর সকল শৌর্য, আক্ষেপ, অনুরাগ, প্রশ্ন, অভ্যাস নিয়েই হাজির হলেন বাংলায়। ধারাবাহিকতার এই তালিকা আরও দীর্ঘ। তবে সাঁটে যা বলার, তা এই যে, বাঙালি রাম চরিত্রকে নিজের মনন ও মেধা দিয়ে বিচার করেছে, বিশ্লেষণ করেছে, ভেঙেছে এবং গড়েওছে। ফলত বাঙালির রাম আসলে স্রোতস্বনী সরযূ, তা কোনও মজে যাওয়া নদী নয়। এই নিরবচ্ছিন্নতা ধারণ না করতে পারলে বাঙালির রামকে বোঝা সম্ভব নয়। সে না কেবল বাল্মীকির অনুবাদে আটকে, না কৃত্তিবাসে। বরং বলা যায়, বাঙালির রাম এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক আবাদের সোনার ফসল। অতএব বাংলা ও বাঙালি যে রামের চর্চা করে, তা বহুমাত্রিক। ঠিক বাঙালির সংস্কৃতিচর্চার অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই তার বহুমুখ, বহু বৈচিত্রে ভাস্বর। বাঙালির রাম সেখানেই অনন্য।
দেশের যে-কোনও প্রান্তের মন্দিরেই রামের মূর্তি স্থাপিত হত পারে। মন্দিরের সেই মূর্তি যেমন সত্য, তেমনই বাঙালি তাঁর অন্তরের সত্যকে দিয়ে যে রামের মূর্তি নির্মাণ করেছে যুগে যুগে, তার দীপ্তিও কিন্তু কমকিছু নয়।