আপনার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কটা একেবারে ইস্পেশাল। আপনি একাকিত্বেও আছেন, আবার পাড়াময় আড্ডার সময় আকাশের সার্চলাইট হয়েও আছেন।
চন্দ্রযান এখন পালক হয়ে উঠতে চায়। ঠিক আস্ত যানটা নয়। তার ল্যান্ডার বিক্রম। সে ধীরে ধীরে পালক হয়ে নেমে আসছে চাঁদের বুকে। মোলায়েম করে তাকে ছুঁয়ে দেবে বলে। এহেন অবস্থায় ইচ্ছে করে, চাঁদকে একটা চিঠি লিখি। রিকোয়েস্ট করি, বিক্রমকে একটু দেখবেন ম্যাডাম। আর যেন তীরে তরী না ডোবে!
এই দেখুন, আপনাকে ফস করে ‘ম্যাডাম’ ডেকে ফেললাম। আসলে একদিকে ‘বৈষ্ণব পদাবলী’র পাতা ফড়ফড় করে উড়ে শুনিয়ে দিচ্ছে বৃন্দাবন দাস, ‘চাতক ফুকারে যেন ঘন চাহে বরিষণ,/ তেন হেরি ও চাঁদ বদন।’ রাধার উদ্দেশে কেষ্ট ঠাকুরের এহেন আকুতির পাশেই উত্তমকুমার গাইছেন, ‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে।’ তাহলে আমার আর দোষ কী বলুন? যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা গল্পে চাঁদকে ধোপদুরস্ত পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত সুদর্শন তরুণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’-এ অঙ্কের স্যর করালীবাবুর দোলপূর্ণিমার চাঁদকে দেখে শূন্য সংখ্যাটির কথাই মনে পড়েছিল। আবার বাংলা কবিতায় চাঁদকে ‘দেবতার স্নানাগার’ও ভাবা হয়েছে। তবু আপনাকে দেখে চিরকাল বাঙালি পুরুষের সবার আগে প্রেমিকার মুখই মনে পড়েছে। এ বঙ্গদেশের বহু তোরঙ্গে রাখা হলুদ হয়ে যাওয়া প্রেমপত্র তার সাক্ষ্য দেবে। ‘লিখিও উহা ফেরত চাহ কিনা’।
তবে ভেবে দেখলে আপনার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কটা একেবারে ইস্পেশাল। সেখানে কেবল প্রেমে গদগদ আকুতিই নেই। ছোট্টবেলায় আমরা আপনাকে কপালে টি দিয়ে যেতে বলি। আবার যৌবনে আপনিই প্রেমিকার ঈষৎ ‘টুকি’ হয়ে হেঁটে চলেন খুড়োর কলের মতো। মান্না দে যতই রিকোয়েস্ট করুন, আপনি আজ পর্যন্ত জোছনাকে সামলে রাখলেন কই? গলে যাওয়া দুধ-আইসক্রিমের মতো সেই নরম আলোয় বুকের মাটি ভিজে যায়নি, এমন প্রেমিক আছে না কি? অঙ্কের খাতার পিছনের পাতায় প্রেমিকার মুখ এঁকেই কাটিয়ে দেয় কত ব্যর্থ হৃদয়। তার আর সফট ল্যান্ডিং হয় না। আছড়ে পড়া ল্যান্ডার, থুড়ি মন নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লে তার আঁকা মেয়েটির মুখে কি গ্রিলের ছায়ামাখা মধ্যরাতের জ্যোৎস্না এসে পড়ে না? আর কেউ না জানুক, অত দূরে বসে আপনি ঠিকই নজরে রাখেন সব। শুধু কি ব্যর্থ প্রেম? ঘাড় ঝুঁকিয়ে ফোনে মত্ত প্রজন্ম অনলাইন প্রেমালাপের ফাঁকে দৈবাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনাকে দেখে ফেললে কেন ফিক করে হেসে দেয়? চিরকেলে চাঁদ তাদের সেই প্রেমের পাশে বসে নিত্যনতুন হয়ে ওঠে।
তাই মনে হয়, আপনি না থাকলে বাঙালির প্রেমের কী যে হত? বাঙালি কবিদেরই বা কী হত? তাঁদের বারবার খোঁচা শুনতে হয়েছে, সারাক্ষণ খালি চাঁদ-ফুল-পাখি নিয়ে না লিখে একবার গনগনে আঁচে কিছু চাপানো দেখি। বলার সময় কি মনেও পড়ে না, অনন্ত কুয়োর জলে সেই কবে থেকে চাঁদকে ভাসিয়ে রেখেছেন শক্তি চাটুজ্যে। সেই চাঁদ কি প্রেমিকার মুখ? আবার চাঁদ এক সদাগরেরও নাম। শম্ভু মিত্রের নাটক থেকে যিনি আশ্বাস দেন, ‘দিনে রেতে বুকে ভরসা রেখো, আমাদের জয় হবেই হবে।’ নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর গল্পে জ্যোৎস্নাকে ‘চাঁদের অসুস্থ পাণ্ডুর আলো’ পর্যন্ত বলেছেন। কাজেই বাঙালির চাঁদ দেখলে কেবল প্রেম পায়, একথা ধোপে টেকে না। লোডশেডিংয়ের দিব্যি, মোমের আলোয় ‘মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে’ গল্প করার সময় একেবারে দূরাগত হয়ে যায়নি কিন্তু। সেই আলাপ মোটেই কেবল ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ’ দেখার নয়, পাড়া বেড়ানো হইহই পিএনপিসিরও। সুতরাং শৈশবে মামা, কৈশোরে অনেকেরই অঙ্কের খাতার নম্বর হয়ে ফুটে ওঠার পাশাপাশি প্রেমের সাক্ষী (কখনও প্রেমিকার মুখও) হয়ে ওঠা– আপনি বাঙালির বড় কাছের! আপনি একাকিত্বেও আছেন, আবার পাড়াময় আড্ডার সময় আকাশের সার্চলাইট হয়েও আছেন। এমন বন্ধু আর কে আছে?
সেই ভরসাতেই ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূর থেকে একান্ত রিকোয়েস্ট, আলতো ছোঁয়া বাঙালি প্রেমিকের বড় প্রিয়। বিক্রমকেও তাই সে এবার জিতে যেতে দেখতে চায়। একবার রিফিউজ যা করার করেছেন। এবার আর হাত সরিয়ে নেবেন না ম্যাডাম, প্লিজ।