‘সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান’, এইভাবে রূপকলা কেন্দ্র কখনও দেখেনি সৌম্যেন্দু রায়কে
Published by: Robbar Digital
Posted on: October 2, 2023 10:17 am
Updated: October 3, 2023 3:17 pm
একদিন এডিটিংয়ের কোর্সের ইন্টারভিউয়ের অবসরে বললেন, দেখুন, ওই যে ছেলেটি এইমাত্র চলে গেল, মনে হয় খুব লাজুক, ভালো করে কথা বলতে পারেনি, আমার মনে হয়, ওকে আর একবার ডাকা উচিত। এখনই নম্বর দেবেন না। তাকে আবার ডাকা হল। আরও কথাবার্তা। সে, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া চলচ্চিত্রকার। সৌম্যেন্দুদা না থাকলে আমরা প্রদীপ্তকে পেতাম না।
অনিতা অগ্নিহোত্রী
‘রায়দা আর নেই।’ একদা সহকর্মী, ক্যামেরা বিভাগের প্রাক্তন প্রশিক্ষক বিরজা প্রসন্ন করের নম্বর থেকে পাওয়া টেক্সট মেসেজের মানে বুঝতে দেরি হয়নি। ‘রায়দা’, ‘রায় স্যর’ বলতে রূপকলা কেন্দ্রর শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরা একজনকেই বোঝে। একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়, তবু সৌম্যেন্দু রায়ের চলে যাওয়ার খবরে আমি এক গভীর শোকের অভিঘাত অনুভব করলাম। মনে হল যেন মনের ভিতর থেকে কিছু একটা ছিঁড়ে পড়ে হারিয়ে গেল স্মৃতির শিশির মাখানো আলোর ভিতর। যে মানুষটির স্বাস্থ্য আর শারীরিক সুস্থতা ছিল ৮৫ বছর বয়সেও ঈর্ষণীয়, তাঁকে বিছানায় লীন অবস্থায় দেখতে যাওয়ার সাহস ছিল না আমার। তাঁর প্রতিভা আর কাজ নিয়ে বলার মতো মানুষ অনেকে আছেন। আমি বলতে পারি মানুষ সৌম্যেন্দু রায়ের জীবনের সেই সময়টার কথা, যেটা অনেক পিছনে রয়ে গেছে।
২০০১ সাল। বৈদেশিক বাণিজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় নির্দেশকের কাজের পালা শেষ করে নিজের কাজে ফিরে যাব, আটকে গেলাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কথায়। সে কথাও আবার সরকারের মুখ থেকে সোজাসুজি নয়। গৌতম ঘোষ আর তাঁর ইতালীয় চলচ্চিত্রকার লেখক-বন্ধু সেরজো স্ক্যাপানিনির ডাক। সংযোগ সূত্র আর এক লেখক ও চলচ্চিত্র উৎসাহী সন্দেশী বন্ধু উজ্জ্বল চক্রবর্তী। এঁদের আগ্রহ আর ইচ্ছেতে আমি জড়িয়ে গেলাম এক আশ্চর্য কাজে, যা আমার চেনা-জানা কোনও আইএএস অফিসার করেননি। এক সামাজিক সংযোগ চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন। শুনলাম ইতালি ও ভারত সরকারের মধ্যে চুক্তি হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কারিগরি সহায়তা ও যন্ত্রপাতি দেবে ইতালি। সত্যজিৎ রায় তাঁর শেষ জীবনে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন একটি আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাণ কেন্দ্র তৈরি করতে, যার ভিত্তি হবে সমাজসংযোগ। তরুণরা সমাজের বাস্তব থেকে, মানুষের সাহায্য নিয়ে খুঁজে নেবে চলচ্চিত্র নির্মাণের উপকরণ। কিন্তু তাদের থাকবে কারিগরির আধুনিকতম জ্ঞান। সত্যজিতের প্রয়াণের পর ভারত সরকার ও ইতালি সরকার এই প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করেন। মাটিতে পা রাখতে আরও কয়েক বছর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, দুই দেশের চুক্তির পরও নির্মাণের কাজ বিশেষ এগোয়নি। এদিকে যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছেছে। রূপকলা কেন্দ্রর কাজের পরিসর কী হবে, তা তৈরি করার দায়িত্ব এসে পড়েছিল আমারই ওপর। পিছনে গৌতমদার অভিভাবকত্ব। আমার পাওয়ার কথা ছিল একটি তৈরি ভবন ও কাজের পরিবেশ। তার বদলে অস্থায়ী অফিসে বসে নিজেদের ঘরবাড়ি তৈরি করে নেওয়ার অলৌকিক অভিজ্ঞতা হল। ‘রূপায়ণ ফিল্ম ল্যাব’ ছিল পাশেই। তার কিছুটা জায়গা আমাদের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছিল। সেখানকার জানলা থেকে দেখতাম মাঠের ওপর পাইল ফাউন্ডেশন করে নতুন বাড়ির কাজ চলছে। সৌম্যেন্দু রায় সেই সময় থেকে আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। নতুন পাঠ্যক্রম তৈরির কাজে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন বহু বিশিষ্ট মানুষ। শমীক বন্দোপাধ্যায়, সন্দীপ রায়ের সঙ্গে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিক্ষকরা। সেই সময় আমি তাঁর বাড়িতে চলে গিয়ে সৌম্যেন্দু রায়কে অনুরোধ করেছিলাম, রূপকলা কেন্দ্রের ক্যামেরা বিভাগের উপদেষ্টা হয়ে আসতে। আমাদের প্রশিক্ষণ ভিডিও মাধ্যমে। আর সৌম্যেন্দু রায় ফিল্ম মাধ্যমের ক্যামেরার জাদুকর। কিন্তু তাঁর হাতে-কলমে শেখানোর পদ্ধতি যে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে আর একটি নতুন সংস্থা তাঁর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের কিছুটা হলেও পাবে, তা নিয়ে গৌতম ঘোষ এবং চলচ্চিত্র-অজ্ঞ আমিও নিশ্চিত ছিলাম। বলাই বাহুল্য, সে সময় রূপকলা কেন্দ্রর পরিচালনায় চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞের চেয়ে একজন প্রশাসকের প্রয়োজন বেশি ছিল। কারণ আর কয়েক মাসের মধ্যে স্টুডিও-সহ বাড়ি তৈরি করে প্রথম ডিপ্লোমা কোর্স আরম্ভ না করে দিলে ভারত সরকার ও ইতালি সরকারের কাছে মুখ থাকবে না।
সৌম্যেন্দু রায় সব শুনে বলেছিলেন, দেখুন, আপনি নিজে এসেছেন। আমি যাব। শেখাব। তবে যদি আমার ভালো না লাগে, চলে আসব। আপনি বারণ করতে পারবেন না। সৌম্যেন্দু রায়, যতদূর জানি, ২০০৫ এ আমি রূপকলা কেন্দ্র ছাড়ার পর আরও দশ বছর ছিলেন। ওই অস্থায়ী অফিসে বসে তৈরি হতে থাকা নতুন বাড়ি দেখতে দেখতে আমরা প্রথম ব্যাচের পাঁচটি শাখায় সম্ভাব্য ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারভিউ নিতাম। আমি, সৌম্যেন্দুদা, উপ-নির্দেশক, বিশেষজ্ঞরা, সুমিত ব্যানার্জি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেতাম তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে। প্রত্যেকে গ্র্যাজুয়েট। ২৪-২৮ বছর বয়সি। স্বপ্নে ভরপুর। সৌম্যেন্দুদা এমনভাবে পরিশ্রম করতেন যেন আজীবন তিনি এইরকম এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ করে এসেছেন। একদিন এডিটিং-এর কোর্সের ইন্টারভিউ এর অবসরে বললেন, দেখুন ওই যে ছেলেটি এইমাত্র চলে গেল, মনে হয় খুব লাজুক, ভালো করে কথা বলতে পারেনি, আমার মনে হয়, ওকে আর একবার ডাকা উচিত। এখনই নম্বর দেবেন না। তাকে আবার ডাকা হল। আরও কথাবার্তা। সে– প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া চলচ্চিত্রকার। সৌম্যেন্দুদা না থাকলে আমরা প্রদীপ্তকে পেতাম না।
তখন আমাদের নতুন বাড়ি। রিমোট-কন্ট্রোলে চলা গ্রিড দেওয়া স্টুডিও। সব ঝকঝকে। ধুলোহীন পরিবেশ। কাজের উথালপাথাল। অতিথি শিক্ষকদের আসা। সময়ে ক্লাস আরম্ভ, শেষ। তার সঙ্গে চলেছে ছবি তৈরির কাজ। রেডিও প্রোগ্রাম। সরকারি অনুদান খুব বেশি ছিল না সেই গোড়ার দিনে। ফলে ফি কম রাখার জন্য আমাদের অনবরত পরিশ্রম করতে হত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রাম করতাম। সব অভিজ্ঞতা, সব অর্জন ছিল আমাদের কাছে মূল্যবান। সৌম্যেন্দু রায় যে কেবল বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, তাই নয়, তাঁর ব্যবহার ছিল পরিশীলিত, অতি সুন্দর, স্নেহময়। আমাদের সবার অভিভাবক হয়ে তিনি এক অলৌকিক মর্যাদার অধিকারী হলেন, কোনও ক্ষমতার অবলম্বন ছাড়াই।
ক্যামেরা বিভাগে তাঁর পছন্দের এক্সারসাইজগুলির জন্য নানা ধরনের প্রয়োজন থাকত। সব প্রশিক্ষককে নিজের রিকুইজিশন জমা দিতে হত অ্যাকাউন্টস বিভাগে। পাছে অ্যাকাউন্টস থেকে কোনও আপত্তি এলে সৌম্যেন্দুদা বিব্রত হন, তাই এগুলি আমি নিজেই করিয়ে আনতাম। ক্যামেরা বিভাগে অতিথি শিক্ষকরা তো আসতেনই, কিন্তু আমাদের ইন হাউস ফ্যাকাল্টি বিরজা আর অন্য ছাত্রছাত্রী প্রচুর স্নেহ পেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সে এক জমজমাট সময়! মৌসুমী বিলকিস, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, ফলক মীর, রিজয়েস দাস, ইন্দ্রজিৎ মিত্র, শুভদীপ, সঞ্জীব দাস, অনির্বাণ দত্ত— ক্যামেরা বিভাগের হোক না হোক, সৌম্যেন্দুদার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছাত্রছাত্রী ছিল প্রত্যেকেই । পরে সকলেই নিজ নিজে কাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এক শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতার পরিমণ্ডল ঘিরে রাখত সৌম্যেন্দুদাকে। কারণও ছিল। বহু পরিশ্রম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অর্জিত তাঁর জ্ঞান সৌম্যেন্দুদা একেবারে উজাড় করে দিতেন ছেলেমেয়েদের কাছে। ‘সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান’, এইভাবে রূপকলা কেন্দ্র কখনও দেখেনি সৌম্যেন্দু রায়কে। তিনি ছিলেন এক স্বনির্মিত শিল্পী যাঁর আলোছায়া তৈরির জাদু তৈরি হয়েছে মানুষের মনের বিভা দিয়ে।
বুঝতে পারতাম, আমার মতো সৌম্যেন্দুদাও রূপকলা কেন্দ্রকে নিয়ে নানা স্বপ্নে জড়িয়ে যাচ্ছিলেন। আমার সঙ্গে একা বসে যেমন নিজের জীবনের কথা, ফিল্মে ক্যামেরার কাজের কথা বলতেন, তেমনই দু’-একটি ইচ্ছেও প্রকাশ করতেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর ছিল নাড়ির টান। ‘পথের পাঁচালী’তে ব্যবহৃত মিচেল ক্যামেরাটি তিনি রূপকলা কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের দেখাবেন বলে। নিজে বিরজাকে সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজি করিয়ে এসেছিলেন। তারপর আমার উদ্যোগে নানা সরকারি প্রক্রিয়া ও প্রশ্নোত্তর পেরিয়ে ক্যামেরাটি শেষ পর্যন্ত যেদিন এসে পৌঁছয়, সৌম্যেন্দুদা যেন নিজের তরুণ বয়সে ফিরে গেলেন। ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্রর অ্যাপ্রেনটিস হিসেবে ‘পথের পাঁচালী’ সম্ভবত সৌম্যেন্দুদার প্রথম কাজ ছিল।
আরও একটি ইচ্ছে ছিল সৌম্যেন্দুদার। সত্যজিৎ রায়ের একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি রূপকলা কেন্দ্রে থাক। কলকাতার কোথাও সত্যজিতের পূর্ণ মূর্তি নেই, তাঁর কাছেই শুনি। গৌতম ঘোষ, আমি কেউ-ই মূর্তি বিষয়ে আগ্রহী নই। কিন্তু সৌম্যেন্দুদার ইচ্ছেকে সম্মান দিতেই হবে। প্রখ্যাত ভাস্কর নিরঞ্জন প্রধান সম্মত হলেন। কাজের আগে তারই বাড়িতে পরামর্শ গবেষণা। সৌম্য়েন্দুদার ডাকে সন্দীপ রায় এলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। যে স্টিল ছবি থেকে মূর্তি তৈরি হবে, তাও এনে দিলেন সৌম্য়েন্দুদা। সত্যজিৎ দাঁড়িয়ে দীর্ঘ নেগেটিভ দেখছেন, এমন এক ব্রোঞ্জ মূর্তি। এখন বুঝি, সৌম্য়েন্দু রায়ের এই স্বপ্নের পিছনেও অন্য এক ভাবনা ছিল। রূপকলা কেন্দ্রকে সুরক্ষিত রাখার ভাবনা।
সল্টলেকের এখনকার সেক্টর ফাইভে পাঁচ একর জমি তদানীন্তন সরকার সত্যজিৎ রায়ের বাসভবনের জন্য রেখেছিলেন। সহকারী ও পরিচিতদের অসুবিধে হবে ভেবে সত্যজিৎ কখনও সেখানে আসতে চাননি, বিশপ লেফ্রয় রোড ছেড়ে। সেখানেই এখন রূপকলা কেন্দ্র। যা শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব চলচ্চিত্র শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে, সে আজ সরকারের চিন্তার কেন্দ্রে আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কখনও যদি জমির মূল্য মাথায় রেখে প্রতিষ্ঠানের বেসরকারীকরণের উদ্যোগ হয়, সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন সত্যজিৎ রায়।
‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ১২ বছর বয়সে আমার কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ। রূপকলা কেন্দ্র তৈরি আমার গুরুদক্ষিণা দেওয়ার এক নগণ্য চেষ্টা। সৌম্যেন্দু রায়ও তাঁর গুরুকে দক্ষিণা দিতে চেয়েছিলেন। রূপকলা কেন্দ্রর কাছে নিজের সারাজীবনের সাধনার ফল গচ্ছিত রেখে। তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানের হিসেবে কতজন কত কিছু পেয়েছে। আমাকে দিয়েছিলেন পারিবারিক উত্তরাধিকারে পাওয়া দু’টি ছোট উপহার। বলেছিলাম, আপনার কাছে থাক। সে দু’টি তাঁর স্নেহের স্পর্শ, স্মৃতির মতোই অমূল্য।