যৌনতা একে অপরকে আনন্দ দেওয়ার শারীর-মানবিক পদ্ধতি। কিন্তু এর মধ্যে শক্তি ও ক্ষমতার ধারণা আসছে কোথা থেকে? আসছে কারণ, পুরুষতন্ত্রই পুরুষকে প্রথম শেখায় অন্যকে পরাভূত করার ক্ষমতা। পুরুষ যদি তার সমাজ, সংসার, দেশ এবং যৌনসঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারে, তাহলে সে কীসের পুরুষ? পুরুষের পরিচয় অতএব তার ক্ষমতার আস্ফালনের ওপর নির্ভরশীল। আজ প্রথম পর্ব।
দু’-এক মাস আগের কথা। সমাজমাধ্যমে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। ভারতীয় অভিনেতা রণবীর সিং এবং আমেরিকার পর্ন-অভিনেতা জনি সিন্স একসঙ্গে একটি ভারতীয় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছিলেন। ভাইরাল সেই বিজ্ঞাপনের প্রতিপাদ্য ছিল, পুরুষের যৌনক্ষমতাবর্ধনকারী বটিকা। যাঁদের জনি সিন্সের সিনেমা দেখার অভ্যাস আছে, তাঁরা হেসে উঠেছিলেন এই ভেবে যে, জনি সিন্সকে আলোচ্য বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে দুর্বল যৌনশক্তির পুরুষ হিসেবে। বিজ্ঞাপনে জনি সিন্সের স্ত্রী তাকে ছেড়ে যাচ্ছে, কারণ সে আর স্বামীর দ্বারা ‘স্যাটিসফায়েড’ হতে পারছে না। অন্যদিকে রণবীর সিং বিজ্ঞাপনে জনি সিন্সের দাদার ভূমিকায়। সে ভ্রাতৃবধূকে ঘর ছাড়তে মানা করছে এবং ভাইকে ওই যৌনশক্তিবর্ধনকারী বটিকা সেবন করার সুপরামর্শ দিচ্ছে।
যৌনশক্তিবর্ধনকারী বটিকার প্রয়োজন সমাজে আছে বলেই, বটিকা আছে এবং তার বিজ্ঞাপন আছে। এটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই, যে-বয়সে স্বাভাবিকভাবে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমতে শুরু করে, কেবল সেই বয়সের পুরুষরাই এই বটিকা সেবন করে থাকে। বরং, উল্টো। সমীক্ষা বলছে, অনেক যুবক এ-ধরনের ওষুধ কেনে। পুরুষের যৌনশক্তি কোন বয়সে কমে এবং কেন– সেসবের উত্তর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে থাকতে পারে, কিন্তু পুরুষের অস্তিত্বে কেন যৌনশক্তি এত বিরাট হয়ে উঠছে, সেই প্রশ্নে আমরা সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পুরুষ বলতে একটাই শ্রেণি গড়ে তুলতে চায় সমাজ যার যৌবন আছে আর আছে উত্থিত লিঙ্গ। এবং এই শ্রেণি থেকে বাদ যাতে না পড়ে যেতে হয় সে-কারণেই মুঠো মুঠো যৌনশক্তিবর্ধক বটিকা কিনে খায় বিভিন্ন বয়সের পুরুষ। সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতার বিষ-নজর থেকে মুক্তি পেতে নারীবাদের চর্চা যেমন জরুরি তেমনই ভুলে গেলে চলবে না যে সামাজিক পুরুষও মারাত্মকভাবে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ডাক্তাররা বলেন– বয়স, অতিরিক্ত চিন্তা, খাদ্যাভ্যাস এবং আরও অনেক কারণে একটা বয়সের পর স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের যৌনতার অভ্যেস কমে যেতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ‘যৌন ক্ষমতা’ শব্দটি। কেন ‘যৌন’ শব্দের সঙ্গে ‘ক্ষমতা’ বা ‘শক্তি’ জুড়ে পুরুষের যৌনতা বোঝানোর দরকার পড়ে? যৌনতা একে অপরকে আনন্দ দেওয়ার শারীর-মানবিক পদ্ধতি। কিন্তু এর মধ্যে শক্তি ও ক্ষমতার ধারণা আসছে কোথা থেকে? আসছে কারণ, পুরুষতন্ত্রই পুরুষকে প্রথম শেখায় অন্যকে পরাভূত করার ক্ষমতা। পুরুষ যদি তার সমাজ, সংসার, দেশ এবং যৌনসঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারে, তাহলে সে কীসের পুরুষ? পুরুষের পরিচয় অতএব তার ক্ষমতার আস্ফালনের ওপর নির্ভরশীল। তার যৌনতার প্রাথমিক অস্তিত্ব সেজন্য় তার উত্থিত লিঙ্গের সঙ্গে সমার্থক। মুশকিল হল, পৌরুষ জিনিসটা যখন কেবল লিঙ্গনির্ভর হয়ে ওঠে, তখন বহু মানুষ অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ে। আমরা যদি পুরুষ বলতে সুঠাম, সিক্স প্যাকযুক্ত শরীর বুঝি, এবং যৌন ক্ষমতাকেই সাব্যস্ত করি তার পরাকাষ্ঠা হিসেবে, তাহলে যে পুরুষ শারীরিকভাবে লিঙ্গোত্থানে অপারগ, যে পুরুষ সিক্স প্যাককে গ্রাহ্যই করে না, যে রূপান্তরকামী-পুরুষের লিঙ্গ নেই আর মাসিক হয়– এদের সকলকেই তবে পৌরুষের বন্ধনী থেকে দূরে সরাতে হয়! অন্যদিকে সমকামী পুরুষকে এই উত্থিত লিঙ্গের রাজনীতি থেকে অদ্ভুতভাবে ব্রাত্য রাখা হয়। ধরেই নেওয়া হয়, সমকামী-পুরুষের কাছে উত্থিত লিঙ্গ অপ্রয়োজনীয়। কারণ, যে লিঙ্গ দিয়ে ক্ষমতা জাহির হবে না, বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই, সে তথাকথিত পুরুষের দল থেকে বাদ পড়বে। উত্থিত লিঙ্গের হকদার হবে কেবলমাত্র বিসমকামী পুরুষেরা। বটিকার প্রয়োজন পড়বে তাদেরই। এটা নতুন কিছুও নয় অবশ্য। আজ যেমন যৌনশক্তিবর্ধক বটিকার খোলাখুলি বিজ্ঞাপনে সমাজমাধ্যম ছেয়ে গেছে, তেমনই এই শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে ‘পৌরুষ’ জোরদার করার পোস্টারও পড়ে। সেইসব ডাক্তার শীঘ্রপতন, ধ্বজভঙ্গ, গুপ্তরোগ, ছোট দৈর্ঘ্যের লিঙ্গ– সব সারিয়ে দিতে পারে!
অতএব, পুরুষ বলতে একটাই শ্রেণি গড়ে তুলতে চায় সমাজ যার যৌবন আছে আর আছে উত্থিত লিঙ্গ। এবং এই শ্রেণি থেকে বাদ যাতে না পড়ে যেতে হয় সে-কারণেই মুঠো মুঠো যৌনশক্তিবর্ধক বটিকা কিনে খায় বিভিন্ন বয়সের পুরুষ। সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতার বিষ-নজর থেকে মুক্তি পেতে নারীবাদের চর্চা যেমন জরুরি তেমনই ভুলে গেলে চলবে না যে সামাজিক পুরুষও মারাত্মকভাবে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আরও ক্ষমতাশালী, আরও পরাক্রমী হয়ে ওঠার নেশা পুরুষকে পাগল করে দিতে পারে। কখনও আবার পুরুষেরও যেন শরীরটাই সব হয়ে ওঠে। তার মন আছে কী না সেটা বড় কথা হয় না। কিন্তু পুরুষকে শুধু পরাক্রমী সাজিয়ে রাখার যে পুরনো ষড়যন্ত্র পিতৃতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলে পুরুষেরই উচিত তার বিরোধিতা করা। যৌনশক্তিবর্ধক বটিকা লাগুক তাদের, যারা এর শারীরিক প্রয়োজন বোধ করবে। যৌনশক্তিবর্ধক বটিকা যেন পৌরুষের সংস্কৃতি না হয়ে ওঠে, তা খেয়াল করে রাখতে হবে পুরুষকেই। শুধু লিঙ্গ হলে হবে কী করে, পুরুষের তো মানুষ হয়ে ওঠারও দরকার।
(চলবে)
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved