ক্যামেরা ফোকাস করল একটা উপহার-বাক্সে। তারপর একমুখ হাসি। এগিয়ে গেলেন শাহিন আফ্রিদি। এগিয়ে এলেন যশপ্রীত বুমরাহ। ব্যাকগ্রাউন্ডে কলম্বোর আর. প্রেমদাস স্টেডিয়াম। সঙ্গে আকাশভাঙা বৃষ্টি! ছল নেই কোনও সে জলধারায়। যে বৃষ্টিতে ভারত-পাকিস্তান—এশিয়া কাপের টপ ফোরের মহারণ ভেস্তে যাওয়ার আক্ষেপ মিশেছিল এতক্ষণ! তা হঠাৎই বদলে যাচ্ছে আশ্চর্য খুশিতে। ভালবাসায়। আশীর্বাদে।
‘ভাই বহোত বহোত মুবারাক্ হো!’
শটটা এখানেই ফ্রিজ হওয়ার কথা ছিল। সহসা বদলে যাওয়া পৃথিবীতে, এর চাইতে বেশি এগোনো যায় না। অথচ সেসব হেলায় টপকে, এই ক্যামেরা ফোকাস করল একটা উপহার-বাক্সে। তারপর একমুখ হাসি। এগিয়ে গেলেন শাহিন আফ্রিদি। এগিয়ে এলেন যশপ্রীত বুমরাহ। এ-মুহূর্তে, ভারত এবং পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ দুই ফাস্ট বোলার। ব্যাকগ্রাউন্ডে কলম্বোর আর. প্রেমদাস স্টেডিয়াম। সঙ্গে আকাশভাঙা বৃষ্টি! যেন অপাপবিদ্ধ। ছল নেই কোনও সে জলধারায়। যে বৃষ্টিতে ভারত-পাকিস্তান—এশিয়া কাপের টপ ফোরের মহারণ ভেস্তে যাওয়ার আক্ষেপ মিশেছিল এতক্ষণ! তা হঠাৎই বদলে যাচ্ছে আশ্চর্য খুশিতে। ভালবাসায়। আশীর্বাদে। শাহিন আফ্রিদি উপহার-বাক্সটি যশপ্রীত বুমরাহ-র হাতে দিলেন। আর বললেন, আল্লাহ্ যেন তাঁর সদ্যোজাত সন্তানকে সর্বদা সুখে রাখে। কাট্!
দৃশ্যটির দৈর্ঘ্য বড়জোর ৪৫ সেকেন্ড। দৃশ্যের অন্তরে দেশভাগের ঘা। হিন্দু আর মুসলিম। ঘৃণা-সর্বস্ব রাজনীতি। হিংসা-সর্বস্ব নাগরিক। ‘মওকা মওকা’। দীর্ঘ ৭৭ বছরে, একটা কারগিল কিংবা একটা পাঠানকোট ছাড়া ওয়াঘা সীমান্তের ওপার থেকে আর তেমন কিছু এসে পৌঁছয়নি। এইবারে এল। রাষ্ট্রকে ব্যোমকে দিয়েই এল, একটা উপহার-বাক্স। আমরা বুঝতে শিখলাম, ব্যক্তি আর রাষ্ট্রের মধ্যে বিপুল ফারাক। আসলে ব্যক্তিই তো রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে একুশ শতকে! নাগরিকের ওপর যা ইচ্ছে চাপিয়ে দিচ্ছে। এক ধর্ম, এক ভাষা, এক জাতি। তারপরও যে আস্ত একটা দেশের ধারণা বেঁচে থাকতে পারে, যেখানে গোমাংস ভক্ষণে হত্যা অথবা হিন্দুরাষ্ট্র, পাকিস্তানি শেল-মর্টার কিংবা লস্কর-ই-তইবা বিলকুল অস্তিত্বহীন—সেই দেশের কথা বেমালুম ভুলেছি। ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, আমাদের সম্মিলিত চেতনা নির্মাণের কাজে রাষ্ট্র তৎপর।
ঠিক সেই কারণেই, শাহিন আফ্রিদির উপহারকে মনে হচ্ছে– অলৌকিক। ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং-এর মতো। মোদ্দা কথা, হজম করতে অসুবিধে হচ্ছে। অথচ এই আদান-প্রদানের ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারত। সিন্ধুনদীর মতো অবলীলায়। মনে পড়ে, পাড়ার বিজয়া সম্মিলনীতে গিটার হাতে গাইতে উঠেছিল আমারই এক বন্ধু। শুরুয়াতেই ধরেছিল একটা সুফি-রক। মোহিত হয়ে শুনছিলাম, পিয়া রে, তোরে বিনা লাগে নাহি মোরা জিয়া রে। গুগ্ল বলেছিল, এ গান পাকিস্তানী ব্যান্ড ‘জুনুন’-এর। তারপর রাজনৈতিক চিত্রপট বদলে গেল। পড়শিকে আড়চোখে দেখতে হবে। সন্দেহ করে যেতে। প্রতি মুহূর্তে। শাহিন আফ্রিদির উপহার-বাক্সে বোম আছে কি না– এ প্রশ্ন করতেও সময় লাগল না বেশি।
কিন্তু আমার ২৩ বছরের জীবনে এটুকু টের পেয়েছি, ক্রিকেট কখনও ঘেন্নার পাঠ দেয় না। ক্রিকেটের আখ্যান সংগ্রামের। প্রত্যাবর্তনের। আনসার্টেনিটির। উৎসবের। এবং ভারতীয় উপমহাদেশে যখন ক্রিকেটের আধিপত্যই সবচেয়ে বেশি, সেখানে একটা উপহার-বাক্স ভরে থাকবে আলোয়। ব্যক্তি শাহিন আফ্রিদি সেটাই তো দিয়েছেন। পাকিস্তানের একজন ক্রিকেট-আইকন হিসেবে, হয়তো চেয়েছেন এই আলো বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ুক পাকিস্তানের আনাচ-কানাচ। এখানেই রাষ্ট্রের থেকে একেবারে আলাদা পথে হাঁটতে থাকে ব্যক্তি। সেটাই আসলে দেশ। যশপ্রীত বুমরাহ-র লাজুক মুখ। দেখলাম, বারবার ধন্যবাদ জানাচ্ছেন তিনি।
কিছু বছর আগের কথা। দিল্লির একটি স্কুলে, জোয়া নামের ন-বছরের একটি শিশুকে তার সহপাঠী জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আর ইউ পাকিস্তানি? আর ইউ টেররিস্ট?’ উপহার-বাক্সে বোম আছে– এই প্রশ্ন একটা পুনরাবৃত্তি। ফিরে আসবে ভবিষ্যতেও। তবু, শাহিন আফ্রিদি যে উপহার-বাক্স পাঠালেন বুমরাহ-র উত্তর-প্রজন্মের প্রতি, ভারতের একজন নাগরিকের প্রতি, তা সম্প্রীতির চ্যাপ্টা গোলাপ। আমার ভাবতে ভাল লাগে। ফলস্বরূপ, ভারতের প্রতিটি মানুষের ভেতরে অদ্ভুত দায়িত্ববোধ জন্ম নেয়। নীরজ চোপড়া পদক জেতার পরে, তাঁর মা যেমন বললেন, আরশাদ নাদিমের পদক জয়ে তিনিও বেজায় খুশি– এই খুশি সেই দৃঢ় দায়িত্ববোধ। হয়তো দাবানলের আকার নেবে না। কিন্তু উপহার-বাক্সে রঙিন ফুল আর চকোলেট থাকবেই। আমি নিশ্চিত।
ন্যাকা-সম্প্রীতি বা ভণ্ড-সেকুলারিজম যদি সেলোটেপ দিয়ে চিপকে থাকি এই লেখায়! যদি ভুল করেও মনে করি, শাহিন আফ্রিদির উপহারে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আমূল বদলে যাবে, বদলে যাবে দুই দেশের নাগরিক-সম্পর্ক, সহজ হবে সংস্কৃতির দেয়া-নেয়ার পথ– তা মিথ্যে প্রমাণিত হবে। তবু, সেই ভুল যেন আমাদের একমাত্র প্রাপ্য হয়। উপহারের নেপথ্যের সেই সদ্যোজাত খুব হইচই করুক। তার চেতন ও অবচেতন-জুড়ে ওই উপহার-বাক্সে উপহারই থাকুক। ঘৃণার বারুদ নয়। মশাই, আপনি কোন পক্ষে?