শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে দু’কথা লিখতে গেলে তার মধ্যে আড়াই কথা বলা হয়ে যেতে চায় তাঁর ছোটদের লেখা নিয়ে। আর হবে না-ই বা কেন। খুব কম সাহিত্যিকই পেরেছেন, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে লিখতে লিখতে একরকমের আলাদা জগৎ, একটা সমান্তরাল পৃথিবী আমাদের মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে। অলীক কিছু চরিত্রকে এত বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে যে, তাদের মনে হয় নিজেরই পাড়ার মানুষ। গঞ্জের আবহাওয়াকে এমন স্পৃশ্য করে তুলতে যে শহরের বিকেল আর মন টানে না। এ তিনি পেরেছেন।
স্কুলের পরীক্ষার ঠিক আগে আগে ছোটদের পুজোসংখ্যা বেরিয়ে যেত তখন। বাবা বইপাড়া থেকে একটু বেশি ছাড়ে পেতেন বলে আমাকেও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হত। যেদিন সময় পাবেন, আমি সেদিন পুজোসংখ্যা পাব। এমনিতে, ধৈর্য জিনিসটা আমার ছোটবেলা থেকেই বেশি। বরং ইদানীং একটু কম হয়েছে মনে হয়। সে যা হোক, পুজোসংখ্যা হাতে পেতে পেতে পরীক্ষা আরও কাছে এসে পড়ত। তাই তখন সেই পুজোসংখ্যার সঙ্গে আমার একখানা কৈশোর প্রেম চলত বলা যায়। কাছে পাবে, ছুঁতে পাবে না, এইরকম একটা ব্যাপার।
এই ধরনের প্রেমে একটা বাধ্যতামূলক অভিসার থাকে, আমারও ছিল। সারাদিন আর সন্ধে তো ভূগোল, জীববিজ্ঞান আর ইংরেজির বই খুলে বসে আছি। রাতে বাবা আর মা ঘুমিয়ে পড়লে আমি টিপটিপ পায়ে যেতাম সেই দেরাজের কাছে, যার মধ্যে ব্রাউন পেপারের খামে যত্ন করে পুরে রাখা আছে চকচকে, আনকোরা, নিটোল একখানা পুজোসংখ্যা। আমারই অপেক্ষায়। সূচিপত্র উল্টে দেখতাম, কে কী লিখছেন। প্রথম বা দ্বিতীয় উপন্যাসটি অবধারিত ভাবে যাঁর লেখা, তিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। যদিও আমি তখনই জানি যে, তাঁর উপন্যাসটি আমি পড়ব সকলের শেষে, পুজোর মধ্যিখানে। তারিয়ে তারিয়ে না-পড়লে আরাম হবে না।
ছোটবেলার কথাই মনে এল আবার, যখন আজ দক্ষিণ ভারত তার সাহিত্য সম্মান তুলে দিচ্ছে আমার, আমাদের প্রিয় কথাকার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাতে। এ যেমন আমাদের কাছে খুবই আনন্দের, তেমন আবার প্রত্যাশিতও বটে। তিনি পাবেন না তো কে পাবেন লেখার জন্য সম্মান? বরং এই সবকিছু গুলিয়ে দেওয়ার সাংস্কৃতিক রাজনীতির দুঃসময়ে কোনও একটি পুরস্কার যে ঠিকঠাক ঠিকানায় যাচ্ছে, এ-জিনিস দেখেও সুখ হয়।
আরও পড়ুন: বাঙালি পাঠক সাবালকত্ব হারাবে যদি তার সন্দীপন অপঠিত থাকে
সে যা হোক, যা বলছিলাম। সমস্যা হল এই যে, অন্তত আমাদের প্রজন্মকে ধরলে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে দু’কথা লিখতে গেলে তার মধ্যে আড়াই কথা বলা হয়ে যেতে চায় তাঁর ছোটদের লেখা নিয়ে। আর হবে না-ই বা কেন। খুব কম সাহিত্যিকই পেরেছেন, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে লিখতে লিখতে একরকমের আলাদা জগৎ, একটা সমান্তরাল পৃথিবী আমাদের মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে। অলীক কিছু চরিত্রকে এত বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে যে, তাদের মনে হয় নিজেরই পাড়ার মানুষ। গঞ্জের আবহাওয়াকে এমন স্পৃশ্য করে তুলতে যে শহরের বিকেল আর মন টানে না। এ তিনি পেরেছেন। এবং ধারাবাহিক ভাবেই পেরেছেন। আর পেরেছেন বলেই আমাদের বা তার পরের প্রজন্ম কিছু অবাস্তবকে আঁকড়ে ধরে, কিছু রূপকথাকে বন্ধু করে, কিছু আজগুবিকে আপন করে বেড়ে উঠতে পেরেছে।
এখন, এই প্রায় পঞ্চাশে এসে আমি পাঠক হিসেবে মনে-মনে শীর্ষেন্দু’র সব ছোটদের উপন্যাস থেকে চরিত্র তুলে এনে একখানা মাল্টিভার্স তৈরি করার চেষ্টা করি। সে এক ভারি মজার ভাবনা। খেলাই একরকম। পাগলা সাহেবের সঙ্গে যেখানে দেখা হয়ে যায় বুরুনের, বা ভজ বাজারু হঠাৎ খুঁজে পান সদাশিব আর নবীনকে। আমরা যে আজও মাথার মধ্যে আবছায়া রহস্যময় প্রীতিসম্পন্ন এক গঞ্জের রং আর গন্ধ পুষে রাখি, তার কৃতিত্ব তো দিতেই হবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে।
আরও পড়ুন: সমরেশ বসুর শিল্পীসত্তার প্রয়োগ ঘটেছিল অস্ত্র কারখানায়
অনেকে হয়তো বলবেন, তাঁর ‘বড়দের’ উপন্যাস নিয়ে কিছু বলা হল না কেন। প্রথমত, সে-পরিসর অন্যত্র হয় যদি কখনও, লিখব নিশ্চয়ই। যদি যোগ্যতাও হয়। কিন্তু এটুকু বলি যে, অদ্ভুতুড়ে লেখায় তাঁর যা অবদান, তা ছোটবেলায় আনন্দ দিত কেবল। আজ আশ্রয় দেয়। তাকে কি কেবল ‘ছোটদের’ বলে দূরে ঠেলে রাখতে পারি? তাই শীর্ষেন্দু’র অগণিত পাঠকদের একজন হিসেবে এ আমারও পুরস্কার। আমি তা মাথা পেতে নিলাম।