বাঙালি ছাত্রদের চিরকালই বোধহয় রক্তের প্রতি এক মায়া আছে। সে অবিভক্ত ভারতবর্ষ হোক বা বাংলাদেশ হোক– দেশের জন্য, ভাষার জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বাঙালি ছাত্র তার বুকের রক্ত উপুড় করে দিতে বেশিক্ষণ ভাবেনি। বরং সে হাসতে হাসতে তার বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিবাদের নিশান এঁকেছে বাংলার বুকে।
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
‘স্যর! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যর…’ এই পোস্ট ফেসবুকে লিখেছিল আবু সাঈদ। তার পরদিন সে মারা যায় পুলিশের রাবার বুলেটের আঘাতে। আবু সাঈদকে আমরা চিনতাম না। চিনলাম শহিদ হিসেবে। মারা যাওয়ার আগের দিন সে আরও লিখেছিল যে, ‘অন্তত একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের, গর্বের।’
বাংলার ছাত্র রক্ত দিতে ভয় পায়নি কোনও দিনও, আবু সাঈদ একা নন, এর আগেও বহুবার বাংলার মাটিতে বাংলার ছাত্ররা বুকের রক্তের প্রমাণ দিয়েছে বারে বারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুজ্জোহা ১৯৬৯-এর ১৭ ফেব্রুয়ারির সভায় বলেছিলেন, ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, এরপর কোনও গুলি হলে তা ছাত্রদের না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’ পরদিন সকালে ছাত্রদের মিছিলে পাকিস্তানি পুলিশ গুলি চালালে তা সত্যিই শামসুজ্জোহার বুকে এসে বেঁধে।
৫৫ বছর পর আবার একই ধরনের ঘটনার সাক্ষী থাকলাম বাঙালিরা। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বাদশ ব্যাচের ছাত্র আবু সাঈদ তাঁর ফেসবুক পোস্ট লেখার পরের দিন বুক চিতিয়ে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়লেন পুলিশের গুলির সামনে। পালানোর চেষ্টা তো দূরের কথা, বরং তাঁর হাত দুটোকে ডানার মতো মেলে দিলেন দু’পাশে।
এখন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল! ছাত্ররা শুধু তাদের নয়, দেশের অনিয়মের বিরুদ্ধে গলা তুলে বুক চিতিয়ে নেমে এসেছে রাস্তায়। আবু সাঈদের সূত্র ধরে মনে করার চেষ্টা করছিলাম যে, কীভাবে বাঙালি ছাত্ররা অন্যায়ের প্রতিবাদে গলা তুলে রাস্তায় নামতে দ্বিধা করেনি কখনওই। রক্ত দেওয়া তাদের কাছে গর্বের। আমাদের ছাত্রদের ইতিহাস দুঃসাহসের ইতিহাস, আমাদের ছাত্রদের ইতিহাস রক্তের ইতিহাস।
১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একটি দৃশ্যর কথা বলি। প্রেসিডেন্সি কলেজের সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করছিলেন প্রফেসর এডওয়ার্ড ফার্লে অটন, উল্টোদিক থেকে উঠে এলেন ১৯ বছর বয়সের এক ছাত্র। ছাত্রটির নাম সুভাষচন্দ্র বসু। প্রফেসর অটন কিছু বোঝার আগে ছাত্রটি, অটন সাহেবকে ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের জন্য ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন। অটন কিছুদিন ধরেই ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন কুকথা বলছিলেন তাঁর ক্লাসে। অটন একথায় রেগে গেলেন। তাঁরই বিপদ হল, ছাত্রটি তাঁর পায়ের চটি খুলে প্রফেসর অটনকে পেটাতে শুরু করেছিলেন। এবং তারপর আরও কয়েকজন ছাত্র মিলে প্রফেসর অটনকে ধাক্কা মেরে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিল।
অনেক পরে সুভাষ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কারের পরে ট্রেনের বার্থে শুয়ে কটক ফিরতে ফিরতে তিনি রিভিউ করছিলেন বিগত কিছু মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে। অনেকেরই মতে, হয়তো এই ঘটনাই সুভাষকে উৎসাহ দিয়েছিল একজন প্রকৃত বাঙালি নেতা হিসেবে নিজেকে খুঁজে পেতে।
১৯২৭ সালে সাইমন কমিশন ভারতে এসে ভারতীয় সংবিধানের পুনর্গঠনের কাজ শুরু করলে দেখা গেল তা ভীষণভাবে ভারতের স্বাধীনতা বিরোধী সাদা মানুষের আইন, অনেকে একে ‘হোয়াইট কমিশন’ বলতেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভ দেখানো শুরু করে, ব্রিটিশ সরকার তা কঠিন হাতে দমন করা শুরু করল। এরই প্রতিবাদে ১৯২৮ সালে কলকাতায় গঠিত হয় ‘নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি’। সভা গঠনকারী সদস্যরা হলেন তৎকালীন বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট বা অধুনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রমোদ ঘোষাল, বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রমুখ এবং কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র শচীন্দ্রনাথ মিত্র, রেবতী বর্মন প্রমুখ। সেই শুরু ছাত্রদের সংগঠিতভাবে সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া।
তারপর আমরা একে একে দেখলে দেখতে পাব, কীভাবে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে এসেছেন রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এক ছাত্রী বীণা দাস বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ করে ৫টি গুলি করেন। এই অনুষ্ঠানে বীণারও ডিগ্রি নেওয়ার কথা ছিল, তা আর হয়ে ওঠে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস খুললে দেখা যাবে, বাঙালি ছাত্রদের আত্মবলিদানের ঘটনা ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। ছাত্রী প্রীতিলতা থেকে প্রফুল্ল চাকী কিংবা বিনয়-বাদল-দীনেশ– বাঙালি ছাত্রদের রক্তে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা হয়েছে অনেকটাই।
মনে করা যাক, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির কথা। সকাল ন-টা নাগাদ ১৪৪ ধারাভঙ্গ করে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করে। মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে ঢাকার ছাত্রদের সেই মিছিল আরও বড় হতে শুরু করলে পাকিস্তানি পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলি চালায়। মারা যান সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার শহিউর-সহ আরও অনেকে। শুরু হয় বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন।
পাকিস্তানি এক নায়ক আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসার আইন পাশ হয়। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে দেশব্যপী হরতাল কর্মসূচি শুরু হয়। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ গর্জে ওঠে এর বিরুদ্ধে। ওই দিন আবার পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় কিছু ছাত্রের।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে পা বাড়ায় সেই থেকেই। একথা মনে রাখা দরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভাগীদার বাংলার ছাত্ররাও বটে।
১৯৭১ সালে তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কতল-এ-আম করতে নেমে সবার আগে আক্রমণ করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি। কারণ তারা জানত বাঙালির শক্তি লুকিয়ে আছে ছাত্রদের বুকে। পাকিস্তানি গুলি সেই ছাত্ররা বুক পেতে নিয়েছে, আর তাদের রক্তে লেখা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
আর তখন এপার বাংলায় কী চলছে? সেও এক ছাত্র আন্দোলনেই ইতিহাস। মৃণাল সেনের সিনেমা– ‘কলকাতা ৭১’-এ তিনি তুলে ধরেছিলেন সে সময়ের কিছু ছবি। সিনেমাটি দেখলেই বোঝা যায়, সে সময়ের ছাত্রসমাজ কীভাবে নিজেদের রক্ত দিতে এগিয়ে এসেছে সমাজবদলের স্বপ্নে।
জহর সরকার এক জায়গায় লিখেছেন, তাঁর প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশের কথা। ১৯৬৯ সালে তিনি যখন কলেজে ঢোকেন তখন প্রেসিডেন্সির দেওয়ালে কমরেড মাওয়ের ছবি আর প্রেসিডেন্সির বারান্দা থেকে ভেসে আসছে শোষণ মুক্ত সমাজের স্লোগান। ধীরে ধীরে ১৯৭০ সালে পুলিশের ছাত্রদের ওপর অত্যাচার এবং গুপ্তহত্যা। তৎকালীন পুলিশ অফিসার রুনু গুহ নিয়োগীর নির্দেশে একের পর এক ছাত্র নেতাকে পুলিশ গুলি করে মারছে। চারিদিকে হাওয়ায় ছাত্রদের রক্তের গন্ধ আর নকশাল স্লোগান। তারপর ১৯৭০ সালের ১৯ নভেম্বর বারাসাতে পুলিশ পরিকল্পনা করে খুন করে কানাই ভট্টাচার্য, যতীন দাস, সমীর মিত্র, গণেশ ঘটক প্রমুখ ছাত্রকে। আর তার এক বছর পরেই সেই কুখ্যাত কাশীপুর বরানগরের ১৩ আগস্টের গণহত্যা। প্রায় শতাধিক ছাত্রকে গুলি করে মেরে ফেলা হয় গঙ্গার ঘাটের কাছে নিয়ে গিয়ে। তারপর দেহগুলো গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
বাঙালি ছাত্রদের চিরকালই বোধহয় রক্তের প্রতি এক মায়া আছে। দেশের জন্য, ভাষার জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বাঙালি ছাত্র তার বুকের রক্ত উপুড় করে দিতে বেশিক্ষণ ভাবেনি। বরং সে হাসতে হাসতে তার বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিবাদের নিশান এঁকেছে বাংলার বুকে। বাঙালির দুই মহান নেতার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাষণেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৯৪৪ সালের ৪ জুলাই সুভাষ বসু তাঁর ভাষণে বললেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ আর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ‘রক্ত যখন একবার দিয়েছি, প্রয়োজনে আবার দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করেই ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।’