Robbar

কৈশোরে অবসাদ সোশ্যাল মিডিয়ার দান, বিকল্প আনন্দের জোগান কই?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 16, 2024 5:23 pm
  • Updated:November 16, 2024 5:26 pm  

শৈশব বা কৈশোর আজ থেকে ২০ বছর আগেও যেরকম ছিল, এখন কি সেইরকম আছে? ২০০০ সালের কৈশোর আর ১৯৮০ সালের কৈশোর? আসলে সময়ের সঙ্গেই বহন করতে হয় সময়ের চিহ্ন। ১৯৮০ বা ২০০০ সালেও যে পরিবেশ ছিল খেলাধুলোর, বন্ধুত্বের, বাড়ির চারপাশে, পাড়ায় নিদেরপক্ষে দেড়খানা খেলার মাঠ, তা আজ কই? ডানা মেলার পরিসর না পেয়ে মাথা ঝুঁকে স্মার্টফোনে পড়ে থাকার জন্য শুধু তাদের দোষারোপ করা চলে না। এই দোষ আমাদের, সম্মিলিত।

প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক

অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়

ট্রেনটা সবে সোদপুর স্টেশন ছেড়েছে। হঠাৎ দুদ্দাড়িয়ে গেটের দিকে ছুটলেন এক যুবক থুড়ি উইসেন বোল্ট, খাস বাংলায় বললেন, ‘দাদা, নামতে দিন।’ আর নামা! গেটে তখন ডাহা জটলা। ফলে যা হয়– ধাক্কাধাক্কি, চিৎকার, ‘এতক্ষণ কী করছিলেন?’

কী আর বলবেন সেই যুবক! ‘স্মার্টফোনে মাথা ডুবিয়ে বসে ছিলাম?’

তার পর কী হল, সে পরের কথা। কিন্তু ভেবে বলুন, এ জিনিস কি আমার-আপনার সঙ্গেও ঘটে যেতে পারে না? ট্রেন-বাস-মেট্রো– সমস্ত গণ-পরিবহণেই এই এক ছবি–মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকা গুচ্ছ মানুষের সারি। শুধু রাস্তায় কেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে, বন্ধুবৃত্তের আড্ডায়, প্রায় প্রত্যেকের নজর হাতের মোবাইলে। মুখে সেলোটেপ, নেই হাসি-ঠাট্টা-আনন্দ। যা ঘটছে সবই বুড়ো আঙুলে। বুড়িয়ে যাওয়া কত সোজা প্রমাণ করে দিচ্ছে! বিশ্ব চরাচর যেন হাতের মুঠোয় বন্দি। যার সিংহভাগ আকর্ষণের কেন্দ্রে সোশ্যাল মিডিয়া। রিল্‌স-এর নেশা তো অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। রিল্‌স বানাতে গিয়ে কত প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে, তবু হুঁশ ফিরছে না। বঙ্কিমী ভাষ্যে যেমন ছিল, ‘এ যৌবন-জলতরঙ্গ রোধিবে কে?’ তেমনই সোশ্যাল মিডিয়ার এমন সর্বগ্রাসী আগ্রাসন রোধ করাও বোধহয় সম্ভব নয়।

CTRL Photos, Poster, Images, Photos, Wallpapers, HD Images, Pictures - Bollywood Hungama
‘সিটিআরএল’ ছবিতে অনন্যা পান্ডে

যদিও এই আগ্রাসনের বাইরেও রয়েছেন বহু মানুষ। হয় তাঁদের কাছে অ্যান্ড্রয়েড বা স্মার্টফোন নেই। নয়তো থাকলেও বিকল্প বিনোদনে বেশি অভ্যস্ত। তা সিরিয়াল হোক বা সিনেমা, বই পড়া হোক বা নির্ভেজাল আড্ডা। কিন্তু সেই সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমছে। আর পরিণত মানুষ যদিও বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আকর্ষণকে সংযত করতে পারেন, কিশোর পড়ুয়াদের পক্ষে তা কতটা সম্ভব? ফলত, অনবরত বাবা-মায়ের কাছে বকুনি খেতে হয়, ‘সারাক্ষণ মোবাইল ঘাঁটা…আর ফেসবুক।’ অভিভাবকরা তিতিবিরক্ত! ছেলে-মেয়েরা ক্রমশ অন্তর্মুখী হয়ে পড়ছে, সকলের সঙ্গে মিশতে পারে না। মাঠে যায় না, খেলাধুলো করে না। স্থূল হচ্ছে, বাড়ছে নানা শারীরিক সমস্যা। কিন্তু সমাধানের উপায় কী? এই আবহেই ‘বিরাট’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। ১৬ বছরের নীচে নাবালক-নাবালিকাদের জন্য বন্ধ হতে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার দরজা। প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানেজ সাফ বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করতেই হবে। যা অত্যন্ত ‘সদর্থক’ সিদ্ধান্ত বলে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। অবশ্য বিপরীত মতও রয়েছে।

Election 2022 results: Anthony Albanese's speech signalled the end of an era in one line
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানেজ

কেন এমন পদক্ষেপ? প্রথমেই এটা জেনে নেওয়া ভাল যে, ইন্টারনেট বা তথ্য অনুসন্ধানের পথে কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে না। শুধুই দূরে রাখা হচ্ছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে। শারীরিক সমস্যা, সামাজিকতা নিয়ে উদ্বেগ এবং ডিজিটাল আসক্তি কাটানোই মূল উদ্দেশ্য। নেপথ্যে ফেসবুকেরই এক অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা, যা ২০২১-এ প্রকাশ্যে এসেছিল। যাতে দেখা গিয়েছে, গ্রাহকের উপর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এই প্ল্যাটফর্মগুলিও। বিশেষত, কিশোরী-তরুণীদের। নিজেদের ছবিতে অবাঞ্ছিত মন্তব্য, আত্মসম্মানে আঘাত, অবাস্তব প্রত্যাশা তৈরি হওয়া, পারিপার্শ্বিক চাপকে বড় করে দেখা– যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলছে। রিপোর্ট বলছে, যে শিশুরা দিনে তিন ঘণ্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে, তাদের অ্যাংজাইটিতে ভোগা ও অবসাদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণ। ক্ষতি হয় পড়াশুনায়। কমছে ধৈর্য্য, বাড়ছে অস্থিরতা। ঘুমনোর আগে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার তো একদমই উচিত নয়। সন্তানদের নিয়ে রিল্‌স, ভিডিও বানাচ্ছেন অনেক অভিভাবক। যা আদতে তাদের মনে চাপ ফেলছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের মস্তিষ্কে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে আত্মপরিচয় এবং স্ব-মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। ঘন ঘন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার মস্তিষ্কের সেই অংশগুলিকে পরিবর্তন করতে পারে যা আবেগ এবং শেখার সাথে সম্পর্কিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন বহু বিষয় থাকে, যা প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক। নাবালকদের পক্ষে তা ‘সহজপাচ্য’ নয়। উপযুক্ত হওয়ার আগেই নিষিদ্ধ জ্ঞানবৃক্ষের ফল তাদের জীবনে বিষময় হতে পারে। পাশাপাশি, বডি শেমিং, সাইবার-বুলিং এবং অনলাইনে হেনস্তাও কমতে পারে সরকারের নয়া সিদ্ধান্তে। উল্টে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হলে বাইরে বেরিয়ে আরও বেশি সময় কাটাতে, খেলাধুলা, শখ পূরণ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে উৎসাহিত হবে কিশোর-কিশোরীরা।

Be smart, not by phone | Be smart, not by phone
ছবিটি প্রতীকী

কিন্তু শুধু একচক্ষু হরিণের মতো ভাবলেই তো হবে না। উল্টো দিকটাও চিন্তা করা দরকার। বিধিনিষেধ আরোপ বা কঠোর পদক্ষেপ করে সমস্যা মিটবে তো? নাকি নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি কৌতূহল আরও বাড়িয়ে তুলবে? যেমন আজকাল পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা মদের দোকানের সামনে হামেশাই দেখা মেলে স্কুল ইউনিফর্ম পরিহিত বহু কিশোরের। বয়ঃসন্ধির এই সময়টা খুবই বিপজ্জনক। যুগের হাওয়া তাদের বলছে, অভিভাবকদের কথা না শোনা, প্রতিপ্রশ্ন করা, যে কোনও অনুশাসন ও চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে স্বর তোলাই তাদের বড় হয়ে ওঠার চাবিকাঠি। বাবা-মায়েদের সঙ্গে সন্তানদের মনোমালিন্য, দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে এই ধরনের কঠোর বিধিনিষেধ। তৈরি হতে পারে অবিশ্বাস। আর কীভাবে ফাঁকি দিয়ে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা যায়, তা শিখতে এই প্রজন্মের পড়ুয়াদের খুব কাঠখড় পোড়াতে হবে কি? মনে তো হয় না। উল্টে এটা ভবিষ্যতে তাদের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। সহজেই প্রযুক্তির অপব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে পারে তারা।

তাহলে উপায় কী? সবচেয়ে ভাল হয় যদি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ঝুঁকি চিহ্নিত করে কিশোর পড়ুয়াদের সচেতন করা যায়। ডিজিটাল সাক্ষরতার ব্যবস্থা করে মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ চালু করা সম্ভব কি না, তার চেষ্টা করা। আমেরিকা, ফ্রান্সের মতো দেশে নাবালকদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতির প্রয়োজন হয়। সেটা বিকল্প হতে পারে। অর্থাৎ, সন্তান কী দেখবে, কতক্ষণ দেখবে, সেই অ্যাকসেস কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সমাজমাধ্যমে অনেক শিক্ষণীয় তথা ভাল বিষয়ও থাকে। সেদিকে সন্তানদের মনোযোগ টেনে আনতে হবে। অ্যাপ লক করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট যাতে দেখা না যায়, সেভাবে সার্চ অপশন সেটিং করাও গুরুত্বপূর্ণ।

শৈশব বা কৈশোর আজ থেকে ২০ বছর আগেও যেরকম ছিল, এখন কি সেইরকম আছে? ২০০০ সালের কৈশোর আর ১৯৮০ সালের কৈশোর? আসলে সময়ের সঙ্গেই বহন করতে হয় সময়ের চিহ্ন। ১৯৮০ বা ২০০০ সালেও যে পরিবেশ ছিল খেলাধুলোর, বন্ধুত্বের, বাড়ির চারপাশে, পাড়ায় নিদেনপক্ষে দেড়খানা খেলার মাঠ, তা আজ কই? ডানা মেলার পরিসর না পেয়ে মাথা ঝুঁকে স্মার্টফোনে পড়ে থাকার জন্য শুধু তাদের দোষারোপ করা চলে না। এই দোষ আমাদের, সম্মিলিত।