১৯ মে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, পাল্টে নাও ভাইসব ২ হাজারের নোট ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এই পর্যন্ত তো সব ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু যাকে নিয়ে এত আদেখলেপনা, সেই তোর যাওয়ার আগে কি একটা বিদায় সংবর্ধনাও প্রাপ্য ছিল না! অনেকে অবশ্য বলছে, এই কয়েক বছরের জন্য আসারই বা দরকার কী ছিল, আর যাওয়ারই! ২০১৬ সালের নভেম্বরে ২ হাজার টাকার কড়কড়ে নোট এসেছিল। কয়েক বছর পর ২০১৮-১৯ থেকেই তা বন্ধ হয়ে যায় ছাপানো। বাজার থেকে ব্যাঙ্কে যাওয়ার পর সেখানেই ঠাঁই হয়। আর ফিরে আসছিল না।
এমন নীরবে যে চলে যাবি, সেটা ভাবতেই খারাপ লাগছে। এমনটা তো কথা ছিল না। আরও কিছুদিন থেকে গেলেই পারতিস। মানছি, যাওয়ার তারিখ পিছিয়ে দিয়েছিস সব বুঝতে পেরেই। কিন্তু সে তো মাত্র দিন কয়েক বই নয়। এটুকুতে কি আর মন ভরে! জানি, বলবি উপায় নেই। বড়কর্তাদের চাপ রয়েছে। ফিরতে হবেই। কিন্তু আর যে আসবি না, সেটা তো বুঝতেই পারছি। আসলে আসার সময় এমন হাঁকডাক ছিল, আর যাওয়ার সময় এত চুপচাপ!
এই তো সেদিন, মনে আছে তোর, এটিএমের সামনে দাঁড়িয়ে বুকে একরাশ ঢিপ ঢিপ শব্দ। ব্যাঙ্কের ডেবিট কার্ডটা ঢুকিয়ে কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা। ঝরর করে হাত-পা ছাড়িয়ে নেওয়ার একটা আওয়াজ। তারপরই সরু ফাঁক গলে চলে এলি একেবারে হাতের মুঠোয়। ওহ, সে কী ফিলিংস মাইরি! আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। বেশ একটা গাঢ় গোলাপি আভা গোটা শরীরজুড়ে। তার মধ্যে মুচকি হাসছেন বাপু। বাঁকিয়ে ধরলে অশোকস্তম্ভ দেখা যায়। ঘাড় কাত করলে সাদার মধ্যে ম্যাজিকের মতো ফুটে ওঠে সংখ্যা। চকচকে সবুজ ফিতে তার একধারে। তখন কি আর জানতাম কয়েক বছর পার হতে না হতেই…।
যাক সে কথা। সবই বড়কর্তাদের বড় ব্যাপার। তুই যে আসবি সে তো আর আগে থেকে জানা ছিল না। রাত ন’টার সময় প্রথম সেবার শুনেছিলাম নোটবন্দি শব্দটা। সেটা হল বলেই না তুই এলি। কেউ যায় বলেই তো নতুন আসে। স্থবিরতা পেরিয়ে প্রাণচঞ্চলতা তো প্রকৃতির নিয়মই। ফের তোর চলে যাওয়ার সময় হল। ঠিক আছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি। সবজেটে পাঁচশো টাকার নোট স্মৃতির পাতায় শুধু নয়, অনেকের কাছে শুধু নস্টালজিয়া হিসাবেই থেকে গিয়েছে। আর তোর তো কথাই নেই। ভারে, গুরুত্বে, মানে একেবারে নোটের রাজা। লেনদেন সহজ হয়েছে যেমন, তেমনই হাতে নিয়ে বাজার ঘুরে তোকে ভাঙিয়ে নিতে তো কালঘাম এই সেদিনও ছুটেছে মধ্যবিত্তের।
হঠাৎই মনে পড়ল, ছোটবেলায় রচনা লেখার বইয়ে একটা রচনা বহুবারই দেখেছি। পরীক্ষায় খুব একটা আসত না বটে, তাই দর ছিল না। বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ– একটি ঝড়ের রাতে অভিজ্ঞতার তুলনায় একটু সেকেলে ধরনের রচনা। ‘নোটের আত্মকথা’। উপসংহারে প্যাথোজ মার্কা নোটের দার্শনিক উপলব্ধির সে সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একটা জুতসই লাইনও এই মনে পড়ল, ‘যেতে নাহি দিব…তবু হায় যেতে দিতে হয়…’।
১৯ মে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, পাল্টে নাও ভাইসব ২ হাজারের নোট ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এই পর্যন্ত তো সব ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু যাকে নিয়ে এত আদেখলেপনা, সেই তোর যাওয়ার আগে কি একটা বিদায় সংবর্ধনাও প্রাপ্য ছিল না! অনেকে অবশ্য বলছে, এই কয়েক বছরের জন্য আসারই বা দরকার কী ছিল, আর যাওয়ারই! ২০১৬ সালের নভেম্বরে ২ হাজার টাকার কড়কড়ে নোট এসেছিল। কয়েক বছর পর ২০১৮-১৯ থেকেই তা বন্ধ হয়ে যায় ছাপানো। বাজার থেকে ব্যাঙ্কে যাওয়ার পর সেখানেই ঠাঁই হয়। আর ফিরে আসছিল না।
তবে তোর আগেও তো নোট পরিবারের অনেকেই চলে গিয়েছে। সেই কবেকার কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহ তখনও কাটেনি। কালোবাজারি আটকাতে ১৯৪৬ সালে ইংরেজ সরকার আরবিআই-এর সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করেছিল ৫০০ টাকার নোটটা নেওয়ার। সেই বছর ১২ জানুয়ারি শুধু ৫০০ টাকার নোট নয়, একইসঙ্গে ১ হাজার ও ১০ হাজার টাকার নোটও বাজার থেকে তুলে নিয়েছিল সরকার। ১৯৫৪ সালে অবশ্য ফের এই নোট ফেরানো হয়। ফের ১ হাজার, ৫ হাজার এবং ১০ হাজারের নোটবন্দি ঘটে ১৯৭৮ সালে। কারণ অবশ্য প্রায় একই, কালোবাজারি। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আরবিআই জানাল, ২০০৫ সালের আগে যে সমস্ত নোট বাজারে রয়েছে, তা ২০১৪ সালের ৩১ মার্চের পর তুলে নেওয়া হবে। আসলে ২০০৫ সালের আগে যে সমস্ত নোট বাজারে ছিল, তার নিরাপত্তা সংক্রান্ত তেমন কোনও শক্তপোক্ত বাঁধন ছিল না। জাল হত যথেষ্ট পরিমাণে। তাই দেশের সর্বোচ্চ ব্যাঙ্ক এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানায়।
সেই ট্র্যাডিশন চলবে। আবার কোনও দিন হয়তো চেনা-পরিচিত হাতের নাগালে থাকা নোট ফিরে যাবে। কিন্তু এই যাওয়া-আসার মাঝে পড়ে বারবার মনে হচ্ছে, আর কোনও নোট রয়ে গেল না তো? আসলে সবার অজান্তে লুকিয়ে রাখা পুরনো নোটের স্মৃতিও তো কম নয়।