ত্রিভুজাকৃতি নতুন সংসদ ভবনের পরতে পরতে হিন্দুত্ব ও সনাতনী ধর্মের প্রতীক। লুটিয়েন্স দিল্লির সব কাঠামোর স্থাপত্যে ব্রিটিশ ঐতিহ্য ধ্বংস করে মযূর, পদ্ম ইত্যাদি ভারতীয় প্রতীক নিয়ে আসা হচ্ছে। নতুন সংসদ ভবনের যে ৬টি গেট, সেখানে স্থান পেয়েছে গরুড়, গজ, অশ্ব, মকর, শার্দুল এবং হংস। পুরনো সংসদ ভবনে ছিল সেন্ট্রাল হল। যেটি একটি ঐতিহাসিক স্থান ছিল। যেখানে একসময় নিয়মিত বসত গণপরিষদ। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আঁতুড় ছিল পুরনো ভবনের ওই সেন্ট্রাল হল।
লোকসভা ভোটের আগে আরও একটি ইমারতকে ঘিরে দেশের রাজনীতির ঘূর্ণিপাক শুরু হল। প্রায় শতবর্ষ পুরনো বৃত্তাকার সংসদ ভবনের বদলে ত্রিভুজাকৃতি যে নতুন সংসদ ভবন পাওয়া গেল, তা নিজেই আপাতত রাজনীতির বিষয়বস্তু। এডওয়ার্ড লুটিয়েন্সের নকশা করা বৃত্তাকার সংসদ ভবনটি ছিল এতদিন ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতীক। এই বৃত্তাকার ভবনটি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে জওহরলাল নেহরুর ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’র সাক্ষী। তখন ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সংশয়ের মেঘে ঢাকা ছিল। এশিয়ার প্রতিবেশী কোনও দেশেই গণতন্ত্র স্থায়ী হয়নি। ‘ওয়েস্টমিনস্টার’ মডেলের সংসদীয় গণতন্ত্র আদৌ ভারতের সমাজজীবনের সঙ্গে খাপ খাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল বিস্তর। কিন্তু, ওই শক্ত ইমারতটির মতোই স্বাধীনতার পর যত বছর অতিবাহিত হয়েছে তত মজবুত হয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত।
দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের এই মন্দিরটিকে হঠাৎ বাতিল করার কী প্রয়োজন পড়ল? কোভিড অতিমারীর মধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকার ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবে যখন ত্রিভুজাকৃতি সংসদ ভবন তৈরির কাজ শুরু হল, তখন দেশজু়ড়ে আপত্তি কম হয়নি। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, একথা ঠিক। ২০২৬ সালে বর্ধিত জনসংখ্যার ভিত্তিতে লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাসের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তাতে সংসদের কলেবর দ্বিগুণ হওয়ার কথা। বৃত্তাকার সংসদ ভবনের নিম্নকক্ষে, তথা লোকসভায় ৫৪৫ জনের বেশি বসার সুযোগ নেই। রাজ্যসভায় আসন মাত্র ২৫০। ২০২৬-এর পর যদি লোকসভার সদস্য সংখ্যা ৮০০-য় পৌঁছয়, তাহলে এতজন সাংসদ বসবেন কোথায়? এই প্রশ্ন সংগত। কিন্তু, তার যে উত্তর ছিল না তা নয়। ১৯২১ সালে এডওয়ার্ড লুটিয়েন্সের করা নকশায় কিছুটা বদল এনে বৃত্তাকার সংসদ ভবনকেই ভেঙেচুরে ৮০০ জনের বসার উপযোগী করা যেত। আধুনিক প্রযুক্তি এনে ৯৬ বছরের পুরনো বাড়িটিকেও ‘স্মার্ট’ করার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা ছিল না বলে অভিমত দেন স্থাপত্যবিদরা। উন্নত করা যেতে পারত বৃত্তাকার ভবনটির বাতানুকুল ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থেকে শৌচাগারও।
কিন্তু পরিবেশকর্মী, নাগরিক সমাজ এবং সর্বোপরি বিরোধীদের সব যুক্তি খণ্ডন করে কোভিডের সেই ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেই ত্রিভুজাকৃতি ভবনের শিলান্যাস করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কারণ, নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ সংসদীয় গণতন্ত্রের বিপ্রতীপে ‘হিন্দু’ জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রের একটি প্রতীক নির্মাণ সম্ভবত সংঘ পরিবারের বৃহত্তর পরিকল্পনারই অঙ্গ। গত ৯ বছরে মোদির শাসনে দেশের অসংখ্য সৌধ ও ইমারতের নতুন নামকরণ অথবা পুনর্গঠন হয়েছে। ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ প্রকল্পে পুনর্গঠিত হচ্ছে লুটিয়েন্স দিল্লির একাংশ। মোদিরা এই পরিবর্তনকে চিহ্নিত করছেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবশেষগুলিকে নিশ্চিহ্ন করার কাজ হিসাবে। দুর্ভাগ্যের যে, ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের মন্দিরটিও ব্যতিক্রম হল না। বিদায় বেলায় অবশ্য বৃত্তাকার ভবনটি ‘সংবিধান সদন’ নামটি পেয়েছে। মোদি ঘোষণা করেছেন, এই বাড়ির গরিমাও কমবে না।
ত্রিভুজাকৃতি নতুন সংসদ ভবনের পরতে পরতে হিন্দুত্ব ও সনাতনী ধর্মের প্রতীক। লুটিয়েন্স দিল্লির সব কাঠামোর স্থাপত্যে ব্রিটিশ ঐতিহ্য ধ্বংস করে মযূর, পদ্ম ইত্যাদি ভারতীয় প্রতীক নিয়ে আসা হচ্ছে। নতুন সংসদ ভবনের যে ৬টি গেট, সেখানে স্থান পেয়েছে গরুড়, গজ, অশ্ব, মকর, শার্দুল এবং হংস। পুরনো সংসদ ভবনে ছিল সেন্ট্রাল হল। যেটি একটি ঐতিহাসিক স্থান ছিল। যেখানে একসময় নিয়মিত বসত গণপরিষদ। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আঁতুড় ছিল পুরনো ভবনের ওই সেন্ট্রাল হল। নতুন ভবনে সেন্ট্রাল হলের জায়গায় এসেছে সংবিধান কক্ষ। যেখানে একাকার হয়ে গিয়েছে পুরাণ ও ইতিহাস। রামায়ণ ও মহাভারতকে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে ইতিহাস হিসেবে। ভারতের গণতন্ত্রের ঐতিহ্যকে খোঁজার চেষ্টা হয়েছে ওই দুই মহাকাব্যের মধ্যে। ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের ধর্মনিরপেক্ষ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে ‘হিন্দু’ জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রে রূপান্তরের এটি একটি ধাপ কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে প্রথম দিনেই।
গণেশ চতুর্থীতে প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নতুন এই সংসদ ভবনের উদ্বোধনকে একটা জাঁকজমকপূর্ণ ঘটনা হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কোনও ফাঁক রাখেননি মোদি। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিনটি ঐতিহাসিক করতে ‘মহিলা সংরক্ষণ বিল’ আনা হয়েছে। বিলটি নিয়ে আসার সময় মোদি মন্তব্য করেছেন, এটিকে আইন করার মতো পবিত্র কাজটি করতে হয়তো ঈশ্বর তাঁকেই বেছে নিয়েছেন। অর্থাৎ, যখন নতুন সংসদ ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন থেকে শুরু করে উদ্বোধনী অধিবেশনের অনুষ্ঠানে দেশের প্রথম দলিত মহিলা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে দূরে রাখা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে তখন ঈশ্বরের বরপুত্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন মোদি। যিনি মণিপুর নিয়ে সংসদে মুখ খুলতে ৭৯ দিন সময় নেন, সেই তিনিই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদে তিনবার ভাষণ দেন।
আসলে এই ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ ঘটনাগুলি অনেক মুহূর্তের জন্ম দেয়। যে মুহূর্তগুলো একটা জাতির জীবনে ভাস্বর হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তগুলোকে কাজে লাগিয়ে মোদির মতো রাজনীতিকরা নিজেদের দেবতুল্য করে নেওয়ার সুযোগ পান। জনগণের ভাবাবেগ বিরুদ্ধে চলে যাবে– এই ভয়ে বিরোধীরাও এই ধরনের ঘটনাকে অস্বীকার করতে পারে না। সংসদের নতুন ভবনের উদ্বোধনেও দেখা গেল বিরোধী দলগুলি প্রত্যেকে হাজির। মধ্যমণি মোদির পাশে জায়গা না পেয়েও রাহুল গান্ধীর মতো বিরোধী নেতারা হাজির। গ্রুপ ফোটো তোলার সময় রাহুলকে দেখা যাচ্ছে পিছনে এককোণে দাঁড়িয়ে থাকতে।
বলা হচ্ছে, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মোদিকে ‘বিশ্বগুরু’ করে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। এবার নতুন সংসদ ভবন চালু ও প্রথম অধিবেশনে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাসের মধ্য দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে মোদির ‘রাষ্ট্রগুরু’ ভাবমূর্তির। ভোটের আগে এই ধরনের সমস্ত জাঁকজমকই বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনীতির বেহাল দশার মতো মূল সমস্যাগুলি থেকে নজর ঘোরানোর কৌশল। নেতার ভাবমূর্তিকে ঘিরে যে চড়া আলোর বলয় গড়ে ওঠে, তাতে বহু মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সুদৃশ্য সংসদ ভবন গড়ে তোলা জরুরি নাকি ওই টাকা জনস্বাস্থ্যে খরচ করা উচিত, এই প্রশ্নগুলিও তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। সরকারের এই কীর্তিটাকেই উদ্বাহু হয়ে তাঁরা স্বাগত জানাতে থাকেন।