ডিপফেকস কোনও নিরালম্ব বায়ুভূত প্রযুক্তি নয়। বিশেষ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির অবশ্যম্ভাবী পরিণাম। যে সামাজিক সম্পর্কে বিলিয়ন ডলারকে ট্রিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য বানিয়ে তোলার একরোখা লক্ষ্যে হাতেগোনা কিছু মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া গোষ্ঠীকে ড্রাগ এবং জুয়ার নেশায় মজিয়ে রাখে, হাসতে হাসতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত অব্যর্থ মিসাইল ছুড়ে শিশুদের হত্যা করে কেবলমাত্র ক্ষমতার আস্ফালনে, দশকের পর দশক জল-জঙ্গল-জমিন লুট করে উপলব্ধ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে পণ্যের চেহারায় বাজারে বিক্রি করে, সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ডিপফেকসকে খারিজ করার ব্যস্ততায় তীব্র ঐতিহাসিক পরিহাসের আভাস পাওয়া যায়।
‘বাস্তবতা মানে এখন পিক্সেল, আর পিক্সেল তৈরি করে নেওয়া যায় অনন্ত হারে, আমরা যখন তখন ইচ্ছেমতো এই কাজটা করতে পারি’, ডিপফেকস এবং উত্তর-সত্যর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিষয়ে এই সহজ সত্যটি স্বীকার করে নিয়েছেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব ও স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল গ্রাজিয়ানো।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভূতপূর্ব সমস্ত শাখা-প্রশাখার একটি হল ডিপফেকস। মানুষের পরিচয়, বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, যা কিছু প্রকৃত, নিষ্কলুষ, অ্যালগরিদম আর পিক্সেলের যোগসাজশে দুমড়েমুচড়ে যেতে পারে পলক ফেলার সময়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রযুক্তিগত পরিসরে তথ্যের বিকৃতি ঘটানোর মধ্যে বিশেষ কোনও বাহাদুরি নেই। জাল ছবি, ভিডিও, প্রোফাইল, খবর, যাবতীয় প্রায় সব কিছুরই বিকৃত বিনির্মাণই ডিপফেকসের অনবদ্য স্কিল সেট। অনলাইন লেনদেনের আনাচকানাচে ডিপফেকসের বিস্তার যত বেশি, যত গভীর, সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজস্ব টাইমলাইনে স্ক্রল করার সময় সমানুপাতে ধাক্কা খাবে একে অপরের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, অনুভূতি। বাস্তবতা আর সিন্থেটিক রিয়ালিটির মধ্যে ফারাক করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠবে। সত্যের প্রতি মানুষ ক্রমশ সন্দীহান হয়ে উঠবে, কারণ মিথ্যে ছবি আর ভিডিওর অবিরাম অভিঘাতে ডিপফেকস তাদের সামনে তুলে ধরবে সত্যের অবিকল প্রতিলিপি। এমন কিছু রাজনৈতিক বাস্তবতা, ঐতিহাসিক সত্য যা এতদিন ছিল মানুষের কাছে প্রশ্নাতীত, ঘনিষ্ঠ প্রিয়জনের যে সিদ্ধান্ত, ব্যবহারের প্রতি কোনও দিনও মুহূর্তের জন্য হলেও প্রশ্ন দানা বাঁধেনি, সেই সবকিছুর প্রতি মানুষকে ঘোর সন্দেহপ্রবণ করে তুলতে ডিপফেকসের জুড়ি মেলা ভার। মানসিক দোলাচলে মানুষের চিন্তা-ভাবনার নতুন বিন্যাস তৈরি হবে। কুৎসিত কাজে লিপ্ত হয়ে থাকা আমাদের ছবি, ভিডিও আমার অজান্তেই আমার সকল বন্ধুদের টাইমলাইনে যদি শেয়ার হতে থাকে, আমার ব্যক্তিত্বের প্রতি বন্ধুদের শতভাগ আস্থা থাকা সত্ত্বেও তারা সেই ভিডিও বা ছবিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারে না। কারণ ভিডিও এবং ছবির মানুষটি অবিকল আমার মতোই হাসে, হাঁটে, কথা বলে।
আরও পড়ুন: যমরাজ পুজোর ছুটি পেতে পারেন শুধু কলকাতা পুলিশের সৌজন্যেই
বর্তমান সামাজিক সম্পর্কে মুখোমুখি কথা বলার পরিসর দিন দিন কমে আসছে, স্বভাবতই অনলাইন যোগাযোগের ক্ষেত্রগুলি আগের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত। ইন্ধন যুগিয়েছে কোভিড প্যান্ডেমিকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা। অজান্তেই অপ্রাসঙ্গিক, বিচিত্র, ছাইপাঁশ ভিডিও রিলসে মজে থেকে কীভাবে দশটা মিনিট কেটে গিয়েছে, আজকালকার প্রযুক্তি-আসক্ত মানুষ তা খেয়ালই করেন না। এই ধরনের সৃষ্টিকাজ-বিমুখ মননের বিশ্বায়নের সঙ্গে যখন চ্যাটজিপিটি, ডিপফেকস, নিউরালিংক সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে, জন্ম হয় নতুন এক সংস্কৃতির।
আদিম ঐতিহ্য মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই সমাজবদ্ধ জীব। অতএব সামাজিক মেলামেশা থেকে দূরে থেকে লাগামছাড়া প্রযুক্তি-নির্ভরতা সমাজবিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিক মানুষেরই ভিড় বাড়াবে। এই সকল মানুষদের মধ্যে বিচিত্র, ক্ষেত্রবিশেষে ভীতিজনক সব লেনদেনে গড়ে ওঠা নতুন সংস্কৃতিতে চূড়ান্ত বিযুক্তির কারণেই দেখা দেবে নিবিড় অবসাদ, আত্মহত্যা প্রবণতা। অবসাদ কাটিয়ে তুলতে তখন একটাই পথ। আরও বেশি প্রযুক্তি-নির্ভর সমাধানের দিকে ছুটে যাওয়া। এই নেশাঘন দুষ্টচক্র থেকে সহজে রেহাই যে নেই।
আরও পড়ুন: সন্ত্রাসের উত্তর শিল্পিত ছুরিতে
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটেশনাল মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক মাইকেল কজিন্সকি বলছেন, ‘Increasingly, not only medical doctors but politicians and judges and teachers will become interfaces for algorithms… We are sliding, very quickly, towards an AI-controlled and AI-dominated world.’
হলিউড থেকে বলিউড, এমিলি ব্লান্ট, স্কারলেট ইয়োহানসন, টম ক্রুজ থেকে ক্যাটরিনা কাইফ ডিপফেকে আক্রান্ত হয়ে যথেষ্টই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। হালে অভিনেতা রশ্মিকা মান্দান্নার মুখের একটি ডিপফেক ভিডিও ভাইরাল হওয়া মাত্রই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর গর্জে উঠে বলেছেন, ‘deepfakes are the latest and even more dangerous and damaging form of misinformation and need to be dealt with by (online) platforms.’
রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে থাকা বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়েও কাটাছেঁড়া করেছে ডিপফেকস।
ফলে যতদিন না পর্যন্ত ডিপফেকসকে সমূলে উৎপাটন করা হচ্ছে, সেলুলয়েড হোক বা রাজনীতি, খেলার জগৎ বা লেখার, বিখ্যাত, জনপ্রিয়, ক্ষমতাবান, ধনকুবের সকলেই কিছুটা হলেও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবেন।
বস্তুত, ডিপফেকস কোনও নিরালম্ব বায়ুভূত প্রযুক্তি নয়। বিশেষ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির অবশ্যম্ভাবী পরিণাম। যে সামাজিক সম্পর্কে বিলিয়ন ডলারকে ট্রিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য বানিয়ে তোলার একরোখা লক্ষ্যে হাতেগোনা কিছু মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া গোষ্ঠীকে ড্রাগ এবং জুয়ার নেশায় মজিয়ে রাখে, হাসতে হাসতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত অব্যর্থ মিসাইল ছুড়ে শিশুদের হত্যা করে কেবলমাত্র ক্ষমতার আস্ফালনে, দশকের পর দশক জল-জঙ্গল-জমিন লুট করে উপলব্ধ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে পণ্যের চেহারায় বাজারে বিক্রি করে, সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ডিপফেকসকে খারিজ করার ব্যস্ততায় তীব্র ঐতিহাসিক পরিহাসের আভাস পাওয়া যায়। সস্তা বিনোদনের কারিগর হিসেবে বিচ্ছিরি রকম সম্পদের মালিক বিশ্বের তাবড় যে অভিনেতারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ে সচেতন সক্রিয় ভূমিকা এতদিন নিয়ে এসেছেন, ডিপফেকের ফাঁদে পড়ে নিজেদের ব্যক্তিগত ইমেজ বাঁচাতে, তাঁদেরই আজ রাত জাগা দুশ্চিন্তা। অর্থের জন্য যা খুশি তাই করা যায়, করা উচিত, এমন ভাবনাকে সিনেমায় বিজ্ঞাপনে অবিরাম প্রচার করা মানুষদের নির্মাণ করা কার্য-কারণ সম্পর্কের গণ্ডির মধ্যে থেকে ডিপফেকসের এই রমরমায় তাই কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। ডিপফেকসের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কিন্ত মর্ষকাম-মজা নয়, বরং টাকা, আরও অনেক বেশি টাকা। অতএব বুঝে নেওয়া জরুরি যে এই প্রযুক্তি সমূহের নেপথ্যে থাকা নাটের গুরুদের বেছে নেওয়া পথে অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথ থেকে উড়ে আসা এলিয়েনের ছায়া নেই। উদ্দেশ্য ও বিধেয় তিলে তিলে ম্যানুফ্যাকচার করা আজকের অধোগামী সংস্কৃতিরই ফসল।
ডিপফেকস নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও নয়, উপড়ে ফেলতে হবে বর্তমান সামাজিক সম্পর্কটিকেই। একথা বললে যেহেতু অনেক মানুষই আঁতকে উঠবেন, বলবেন, মশা মারতে কামান দাগা কেন বাপু!, তাই ফেক, কৃত্রিম, অবিশ্বাস, ঘৃণা, আত্মকেন্দ্রিক যাপন, আত্মহত্যা, অভূতপূর্ব দুর্নীতি, মারাত্মক অতিমারী অধ্যুষিত আগামীর রিয়ালিটি শোতে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। তবে এই অভ্যাসে কষ্ট হলে নিস্তারের একটাই পথ খোলা। প্রাথমিক শর্ত হিসেবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ‘intellectual struggle’ -এর মাধ্যমে কর্পোরেট-প্রযুক্তি-রাষ্ট্র-র অন্তর্বর্তী নেক্সাসটুকু গভীরে বুঝে নেওয়া। জেনে নেওয়া ডিপফেকসের আতঙ্ক ঘুচে গেলেও আগামীতে এই নেক্সাসের অস্তিত্বের জন্যই আরও ভয়ংকর ‘অগমেন্টেড ডিপসেক্স’ জাতীয় সিনথেটিক কিছু একটার বাজারে শোরগোল তোলার সম্ভাবনা থেকেই যায়। অতএব ডিপফেকস বা চ্যাটজিপিটির দিকে আঙুল তুলে হইচই করা পণ্ডশ্রম, কোমরে দড়ি বেঁধে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থাটিকেই।