ফাহাদ শাহকে আমরা সম্ভবত চিনি না। তিনি এমন কোনও দুর্ধর্ষ ক্রীড়াবিদ নন, সুদর্শন অভিনেতা নন, এমনকী তিনি সোশাল মিডিয়া সেলিব্রিটিও নন– তাহলে তাঁর নাম মনে রেখেই বা কী আর হবে! এই প্রসঙ্গে তাঁর কথা অবশ্য একটু বলা দরকার। ফাহাদ শাহ ‘দ্য কাশ্মীর ওয়াল্লা’ নামে এক স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন, তাঁকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘দেশদ্রোহী’ বিষয়বস্তু লেখার অভিযোগ তুলে সরকার গ্রেপ্তার করে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের ষড়যন্ত্র’ এবং ‘দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধানোর পরিকল্পনা’-র মতো গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়।
‘হায়দার’-এর সেই বিখ্যাত দৃশ্যটার কথা একটু বলি। চৌরাস্তায় কতকগুলো লোক জড়ো হয়েছে, আর তাদের সামনে হায়দার– একটি দড়ির ফাঁস আলগা করে গলায় বাঁধা, সেই দড়িরই একপ্রান্তকে চোঙ বানিয়ে হায়দার বক্তব্য রাখছে। ন্যাড়া মাথা, অস্থির দৃষ্টি; কিন্তু কথাবার্তা বিন্দুমাত্র অসংলগ্ন নয়। ওইটুকু জমায়েত বাদে শুনশান উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হায়দারের কণ্ঠ: হাম হ্যায়, কি হাম নহি? শেক্সপিয়র লিখে গিয়েছিলেন, টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন, তা প্রায় চার শতক পরে বিশাল ভরদ্বাজের কলমে হয়ে উঠল এই অমোঘ সংলাপ।
ওই একটি দৃশ্যেই ধরা পড়েছিল কাশ্মীরের অসহায়তা, তাকে নিয়ে কীভাবে নিরন্তর জাগলিং চালিয়ে যাচ্ছে দুই প্রতিবেশী যুযুধান রাষ্ট্র– সেই ‘খেলা’-র ধারাভাষ্য।
আরও পড়ুন: ‘ইন্ডিয়া’ কথাটা ইংরেজরা তৈরি করেনি
ফাহাদ শাহকে আমরা সম্ভবত চিনি না। তিনি এমন কোনও দুর্ধর্ষ ক্রীড়াবিদ নন, সুদর্শন অভিনেতা নন, এমনকী তিনি সোশাল মিডিয়া সেলিব্রিটিও নন– তাহলে তাঁর নাম মনে রেখেই বা কী আর হবে! এই প্রসঙ্গে তাঁর কথা অবশ্য একটু বলা দরকার। ফাহাদ শাহ ‘দ্য কাশ্মীর ওয়াল্লা’ নামে এক স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন, তাঁকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘দেশদ্রোহী’ বিষয়বস্তু লেখার অভিযোগ তুলে সরকার গ্রেপ্তার করে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের ষড়যন্ত্র’ এবং ‘দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধানোর পরিকল্পনা’-র মতো গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়। গত সপ্তাহে অবশেষে তাঁর জামিনের নির্দেশ এসেছে; কারণ প্রকৃতপ্রস্তাবে তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলির কোনওটিই ধোপে টেকেনি। সাংবাদিক মহলে এবং অন্যান্য চিন্তকের মধ্যেও নিরন্তর আলোচনা চলছে, ফাহাদ শাহের মতো নিপুণ সাংবাদিকের সঙ্গে যদি রাষ্ট্র এহেন আচরণ করে, তাহলে এদেশে বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কী হাল, তা সহজেই অনুমেয়। যাক গে, এসব নতুন কথা কিছু নয়।
তাৎপর্যের ঘটনাটা হল, ফাহাদ শাহের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো জম্মু এবং কাশ্মীর হাই কোর্ট খণ্ডন করার পরের দিন জম্মু ও কাশ্মীরের নয়া ডিজিপি আর আর স্বৈন একটা মন্তব্য করেছেন: যাঁরা বাকস্বাধীনতার নামে উসকানিমূলক লেখাপত্র লিখছেন, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাঁরা এমন লেখেন, প্রত্যেকে জঙ্গি কাজকর্মে মদত দেন; এইসব আচরণ আমরা এক্কেবারে বরদাস্ত করব না।
আরও পড়ুন: ইরানের পরিচালক দারিয়ুশ মেহরজুইয়ের মৃত্যু একটি রাজনৈতিক হত্যা
মানেটা কী দাঁড়াল? ধরুন, যেহেতু দেশদ্রোহিতার মাত্রা মাপার যন্ত্র নেই, বাকস্বাধীনতার সীমানা (সোনার পাথরবাটি) নির্ধারণ করার মাপকাঠি নেই– ফলে, এই যে আমি এই লেখাটা লিখছি, কেউ এসে ক্যাঁক করে আমার টুঁটি ধরে আমাকে জেলে পুড়ে দিতেই পারেন। বলতেই পারেন, তুমি যা লিখছ, তা আমার তৈরি করা বাকস্বাধীনতার মডেলে ঠিক ফিট করছে না হে, তোমাকে কয়েক দিন কয়েদ করে রাখা যাক। সরকার-বিরোধিতা যদি কেউ করেও থাকেন, তিনি যে দেশ-বিরোধিতা করছেন না– এটা সর্বাগ্রে বোঝা দরকার। রাষ্ট্র আর দেশ এক নয়। সরকার এবং দেশ এক নয়। দেশের সঙ্গে মানুষের একটা আত্মার সম্পর্ক থাকে। একই ভাষা-সংস্কৃতির দু’জন মানুষ বিদেশে দেখা হলে একে-অপরকে চেনেন ‘আমার দেশের লোক’ বলে। জন্ম-বড় হওয়া ভারতে, অথচ দেশ বলতে অনেকের মনে পড়ে পূর্বজদের স্মৃতিবিজড়িত চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশালের কথা। যেখানে নাড়ির টান আছে, যেখানে ধ্বনিত হয় হৃদয়ের স্পন্দন, তাকে বলে দেশ। তাকে কাঁটাতার দিয়ে বাঁধা যায় না, তাকে ভূখণ্ডের আয়তন দিয়ে মাপা যায় না। রাষ্ট্র এবং সরকার অপরপক্ষে অনেক বেশি কাঠখোট্টা, এবং তাদের কিছু নির্দিষ্ট চেহারা-অবয়ব আছে। রাষ্ট্র এবং দেশ– যারা এই দুইকে জোর করে গোলাতে চান, তাদের কিছু গোপন অভিসন্ধি আছে বলে ধরে নিতে হবে। অতীতে যাঁরা সরকার এবং দেশ, রাষ্ট্র এবং দেশ গুলিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছিলেন; তাঁদের একজনের নাম বললেই অভিসন্ধির ধরনটি স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা: অ্যাডলফ হিটলার। তাঁকে তো ঠিক মানবদরদী, জনকল্যাণে বদ্ধপরিকর নেতা বলে আমরা মনে রাখিনি; বরং, যে উগ্র এবং উন্মাদ জাতীয়তাবাদের বীজ তিনি মানুষের মনে পুঁতে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, যে আদর্শ তাঁর শাসনকাল থেকে সারা পৃথিবীতে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল– তারই একটা বিবর্তিত রূপ এখন এখানে দেখতে পাচ্ছি বললে অত্যুক্তি হয় না। সুকুমার রায় আজ যদি ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ লিখতেন, তাঁর নামে সারা দেশ থেকে ক’খানা মামলা হত তার হিসেব রাখা যেত না। এদেশে ভারভারা রাও-য়ের ওপর অমানুষিক অত্যাচার হয়, গৌরী লঙ্কেশকে খুন হতে হয়। দেশ জুড়ে অজস্র রাজনৈতিক বন্দি বিনা বিচারে দিন গুজরান করেন। সোশাল মিডিয়ায় একটি বাক্য ভেবেচিন্তে না লিখলে, এমনকী, মজাচ্ছলে সরকারের বিপক্ষে কিছু লিখলে খোদ কর্তৃপক্ষ থেকেই অ্যাকাউন্ট উড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়; ফাউ হিসেবে সমর্থকদের খিস্তিখেউড় তো আছেই। আরও চিন্তার কথা হল, এই পরিবেশটা দেখে আমাদের আর আতঙ্কও হয় না, কমবেশি ১৪০ কোটি লোক বয়েলিং ফ্রগ হয়ে বেঁচে আছে।
মানুষের আত্ম তৈরি হয় তার ভাবনায়, তার কথায়, তার প্রকাশভঙ্গিতে। সেই ভাবনা-ভাষ্য-ভঙ্গিমায় যদি কেউ একটি নিষেধের গণ্ডি টেনে দেন, ভাবনা-ভাষ্য সরকার ভজালে তবেই তাকে প্রকাশের অনুমতি দেয়; তখন একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে নিরন্তর ঘুরপাক খায়: আমরা শরীরে তো আছি, কিন্তু ‘আমরা’ কি আদপে আছি, না কি নেই? যে সমস্ত উপাদান নিয়ে তৈরি হয় ‘আমি’, গড়ে ওঠে ‘আমরা’–তার ওপরে যদি এসে পড়ে সরকারি লাল ফিতে, মতানৈক্যের অধিকার যদি ক্রমাগত ‘অপরাধ’ বলে চিহ্নিত হয়, প্রশ্নাতীত আনুগত্যই যদি ‘সচেতন নাগরিক’ হওয়ার সঠিক পরিচায়ক হয়– আসলে আমরা ভেড়ার পাল হওয়া থেকে কতদূরে আছি?