ফিলিস্তিনীয় নৃতত্ববিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী শারিফ কানানা তাঁর গবেষণায় ‘ইন্তিফাদার জোকস’-এর সংকলন করেন এবং তার মাধ্যমে দেখান কীভাবে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ-কমেডি প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠে। আসলে, বাস্তবে যখন অত্যাচার-নির্যাতন ভয়ংকর রূপ নেয়, তখন সেটার প্রতিফলন ‘ট্র্যাজেডি’র মাধ্যমে সম্ভব হয় না, কারণ ট্র্যাজিক হিরোর হেরে যাওয়ার মধ্যে কোথাও একটা আপোসহীনতার গর্ব থাকে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের অমানুষিক নিষ্পেষণে সেই গর্ব দেখানোর অবকাশ নেই, দেখালে সেটাই অশ্লীল।
পর্ব ৩
এই পর্ব শুরু করার আগে আমাদের একটু পরিষ্কার হতে হবে কেন প্রতিরোধের শিল্পকে দু’ভাগে ভাগ করা হল? প্রথম পর্বে আমরা সুমুদের আলোচনাতেও দেখেছি যে, সুমুদ-কেও দু’টি ভাগে বিভক্ত করা হয় এবং দ্বিতীয় ভাগ শুরু হয় আটের দশক থেকে। কী কারণে এই দ্বি-বিভক্তি টানা হল আটের দশকেই?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সমগ্র ‘তৃতীয় বিশ্ব’, থুড়ি কলোনিগুলোতে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, স্বাধীনতাকামী, পুঁজিবাদ-বিরোধী সমাজতন্ত্রের ঝড় বইতে থাকে। একই ঘটনা-পরম্পরা আরব দুনিয়াতেও ঘটে। ১৯৫২ থেকে ইজিপ্ট এবং আরব দেশগুলিতে পশ্চিমি সাম্রাজ্যের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে নিজ দেশের শাসক বাদশা-সুলতানদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বাম সংগঠনগুলি ক্রমশ শক্তিশালী হতে শুরু করে। তাদের স্বপ্নে তখন ইজিপ্ট-সহ সব আরব-দেশ মিলিয়ে এক বৃহৎ ‘আরব সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক’, যা হবে সেকুলার, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ। সোভিয়েত সমেত সমস্ত সোশ্যালিস্ট ব্লক আরবের জাতীয়তাবাদী সোশ্যালিস্ট আন্দোলনের সহায়ক হয়। এমনকী, আটের দশকের শেষের দিকে ইজরায়েলের ভেতরেই বামপন্থী লেবার পার্টি ভয়ানক জনপ্রিয় হয়ে পড়ে এবং ক্ষমতায় চলে আসে। ফলে পশ্চিমা সাম্রাজ্য এবং আরবের বাদশারা প্রমাদ গোনেন। সেই সুবাদে ইজরায়েল-সহ পশ্চিমা দেশ আরব বাদশাদের সঙ্গে জোট বাঁধে সাতের দশকেই।
সাম্রাজ্যবাদ বুঝতে পারে, এ সমস্যার সমাধান হতে পারে দু’টি উপায়ে– ১) সোভিয়েত ব্লককে ধ্বংস করতে হবে এবং তার ফলে কলোনিগুলিতে কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা (Welfare-State) বিলোপ করে আরোপ করা হবে নয়া-উদারবাদ (Neoliberalism), তাতে আগ্রাসন আর তার থেকে মুনাফা লাভ, শুধু সামরিক নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক, অর্থাৎ সর্বব্যাপী হবে। আর ২) কলোনিতে বামপন্থী হেজেমনিকে বিস্মৃত করতে লাগবে কট্টর, প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলির উত্থান। আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সমগ্র কলোনি জুড়েই ওপরের দুই সাম্রাজ্যবাদী কৌশল সফল হয় এবং বিশ্ব-রাজনীতিতে ঘটে যায় বিরাট পট-পরিবর্তন। এই কারণেই আট ও নয়ের পরবর্তী দশক, পূর্ববর্তী রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে হয়ে যায় আলাদা। তাই ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ শিল্পের ইতিহাসকেও আমাদের নতুন ভাগে ভাঙতে হল।
১) গ্রাফিত্তি
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেভাবে নিরীহ প্রাণী মরিয়া হয়ে ফোঁস করে ওঠে, ১৯৮৭ সালে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণরোষের বিস্ফোরণে ফেটে পড়ল। শুরু হল প্রথম ‘ইন্তিফাদা’, অর্থাৎ প্রতিরোধের আন্দোলন। সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রে-সজ্জিত প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে নিরস্ত্র সাধারণ জনগণ কুড়িয়ে নিল পাথর। এই সময়ে ফিলিস্তিনের দেওয়ালে-দেওয়ালে ফুটে উঠল গ্রাফিত্তি ও ম্যুরাল আর্ট। প্রথম যুগে, তুলনায় দেওয়ালচিত্রের বদলে ছিল দেওয়াল-লিখনের অধিপত্য। কারণ, চিত্র বানানো সময়সাপেক্ষ– শ্রমসাপেক্ষও। কিন্তু গ্রাফিত্তি তৈরি করতে হবে গেরিলা কায়দায়, রাতের অন্ধকারে, কম সময়ে, কম উপাদানে। কারণ টহলদার ইজরায়েলি সৈন্যের হাতে পড়লে জেল, টর্চার অথবা অকুস্থলেই গুলি খেয়ে নির্বিচারে মরতে হবে। সকালে উঠে নগরবাসী আড়চোখে পড়ে ফেলে রাতে সদ্য লেখা দেওয়াল– ‘ঔপনিবেশিক তুমি যেখানকারই হও, তোমার মৃত্যু হোক’ অথবা ‘সমস্ত রকমের নিপীড়নের থেকে আমাদের জনগণ বেশি শক্তিশালী।’ শুধুমাত্র শোষকরাই দেওয়াল লিখনের লক্ষ্য ছিল না, নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বও হত গ্রাফিত্তির বিষয়। সদ্য ভুঁইফোড় কট্টর-মৌলবাদী ‘হামাস’-এর দেওয়াল-লিখন– ‘ইসলামের মেয়েরা শরিয়া আইন মেনে পোশাক পরবে’-র প্রতিবাদে সেকুলার ও বামদলেরা বয়ান লেখে– ‘যারা মেয়েদেরকে নিশানা করবে তাদের সঙ্গে (শাসকের) কোলাবোরেটর হিসেবে ব্যবহার করা হবে’ আর ‘‘বিপ্লব করতে লাগে দশটা বুলেট। একটা শত্রুর জন্য আর বাকি ন’টা কোলাবোরেটরের জন্য”।
অনির্দিষ্টকাল কারফিউ, ফিলিস্তিনি প্রেস বাজেয়াপ্ত, খবরের কাগজ-বই নিষিদ্ধ– এই অবস্থায় দেওয়ালই হয়ে উঠত রাজনৈতিক মুখপত্র, পরবর্তী কর্মসূচির টাইম টেবিল আবার ‘আজকের তাজা খবর’। সাধারণত বিকেল গড়ানোর আগেই সেনা এসে রং দিয়ে ঢেকে দিত লেখা। রাতে তার ওপরেই লেখা হয়ে যেত নতুন গ্রাফিত্তি। নৃতত্ত্ববিদ জুলি পেতিতের বর্ণনায় জানা যাচ্ছে, একবার এক দেওয়ালে অসাধারণ এক ম্যুরাল আর্ট দেখে ক্যামেরায় ধরে রাখতে ঘরে দৌড়েছেন তিনি ক্যামেরা আনতে, ১৫ মিনিটের মধ্যে ক্যামেরা হাতে পৌঁছতেই দেখে কালো রঙে ঢেকে দেওয়া হয়ে গেছে। গ্রাফিত্তিতে লেখকের নাম সংগত কারণেই থাকত না, বদলে থাকত দলের নাম, যথা PFLP, PCP, Fattah ইত্যাদি। যে অঞ্চলে যে দল বেশি ক্ষমতাশালী। এতে দুটো জিনিস হত, প্রথমত শিল্পীকে টার্গেট করা যেত না আর দ্বিতীয়ত দেওয়ালের বয়ান হত সমষ্টির, বাক-স্বাধীনতাহীন মানুষের সোচ্চার বাচন। মূলত তিন-চারজনের কিশোর-কিশোরীর গ্রুপ রাতের অন্ধকারে কাজটি সেরে ফেলত। একজন থাকত পাহারায়, আর বাকিরা লিখে ফেলত দেওয়াল। সাধারণত গ্রাফিত্তি শিল্পীকে না পেয়ে সামরিক বাহিনীর নিদান– যার দেওয়ালে গ্রাফিতি পাওয়া যাবে তাকেই দিতে হবে ৭০০ ইজরায়েলি-শ্যাকেল (৩৫০$) ফাইন। তাই দেওয়ালে ফুটে ওঠে– ‘ট্যাক্স ও ফাইন না দেওয়া আমাদের সংগ্রামের অংশ এবং জাতীয় দায়িত্ব।’
দেওয়াল নির্মম নিপীড়নকে ঠাট্টা করতেও ছাড়ে না– ‘জেলখানা হল বিশ্রামের জন্য, নির্বাসন হল ট্যুরিজমের জন্য এবং পাথর-ছোড়া হল দৈনিক ব্যায়াম।’ দেওয়াল যেমন জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে– ‘আমাদের শহিদের শেষ ইচ্ছা হল আমরা যেন সামনে এগিয়ে যাই আর প্রতিরোধ গড়ে তুলি’, তেমনই শহিদের মার জন্যে বয়ে আনে বার্তা– ‘যদি কমরেডরা আমাকে ছাড়াই ফেরত আসে, মা তুমি কেঁদো, তোমার কান্নার প্রতি ফোঁটা স্বাধীনতার আগুনে জ্বালানি হয়ে জ্বলে উঠবে।’ রামাল্লাহর এক নারীকে যখন পেতিত জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা এই দেওয়াল-লিখন পড়ো?’, তিনি বলেন– ‘অবশ্যই। যখন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি নতুন একটা গ্রাফিতি, আমি বুঝতে পারি প্রতিরোধ এখনও থেমে যায়নি। আমায় জানান দেয়, মানুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিতে ছাড়েনি আর তারা ঠিক এখানেই, আমার লোকালয়তেই কোথাও আছে।’
পড়ুন ‘মৃত্যু উপত্যকায় শিল্পীরা’-র আগের পর্ব: দেশ নেই, পরিচয় নেই: প্রতিরোধ শিল্পের প্রথম যুগ (১৯৫০-১৯৮৭)
২০০২ সালে দ্বিতীয় ‘ইন্তিফাদা’-র প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করতে গড়ে ওঠে ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক সেপারেশন ওয়াল’। গড় ৩০ ফুট উচ্চতার মাইল বিস্তৃত এই ‘অ্যাপার্থাইট দেওয়াল’ বিশ্বের গ্রাফিত্তি আর্টিস্টের জন্য প্রতিবাদের দেওয়াল হয়ে ওঠে– আঁকা হয় অসংখ্য গ্রাফিত্তি/ম্যুরাল।
গ্রাফিত্তির বিষয়ও হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক। প্রথম ইন্তিফাদার গ্রাফিত্তি ছিল স্থানীয় দর্শকের উদ্দেশ্যে, তাই বিষয় থেকে ভাষা সব ছিল আঞ্চলিক। কিন্তু ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের গ্রাফিত্তির দর্শক আন্তর্জাতিক, কারণ সেখানে ট্যুরিস্টের আগমন হয়, তাই ভাষাও আরবির তুলনায় বেশি ইংরেজি বেশি ব্যবহৃত হয়। বিষয়ও যত না আঞ্চলিক, তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক, অথবা নিজের পশ্চিমি দেশের শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তাই প্রকাশভঙ্গিও তুলনামূলক পশ্চিমি। আন্তর্জাতিক শিল্পীদের এই দেওয়ালের প্রতি আকর্ষণ শুরু হয় ২০০৫ সালে যখন ব্যাঙ্কসি গ্রাফিত্তি আঁকে এবং একটি হোটেল-ক্যাফে বানায় ট্যুরিস্টদের জন্য, যেখান থেকে উপভোগ করা যায় বৈষম্যের দেওয়াল ও তার উপর চমকপ্রদ শিল্পকলার দৃশ্য। সেইসময় স্থানীয় ফিলিস্তিনি ব্যাঙ্কসিকে ডেকে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, ‘আমরা চাই না এই নির্যাতনের দেওয়ালকে সুন্দর দেখতে। আমরা এটাকে ঘৃণা করি। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।’
এই বছরের ৮ জুন গাজার দেইর আল-বালাহ রিফিউজি ক্যাম্পে এক অভূতপূর্ব শিল্প-প্রদর্শনী আয়োজিত হয় ‘দ্য অকুপেশন কিলস চিলড্রেন’ নামে। ২৩ লাখ অধিবাসী নিয়ে গাজা বিশ্বের সবচেয়ে জনঘনত্বে ভারী অবরুদ্ধ ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’। রিফিউজি ক্যাম্পে ঠাসা গাজায় নিরন্তর মিসাইল হামলা গত দশ বছরের দৈনন্দিন নরক-বাস্তব। সেই হামলাতেই গুঁড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘরকে শিল্প-প্রদর্শনীশালায় রূপান্তরিত করে ফেলা হয়। গাজা নিবাসী গ্রাফিতি শিল্পী হুসেইন আবু সাদিক ভাঙা দেওয়ালে বা বাড়ির দাঁড়িয়ে থাকা অবশিষ্ট ইট-পাঁজরে আঁকেন ঘর হারানো গাজার শিশুদের দৈনন্দিন বাস্তবতা। এছাড়া সেই প্রদর্শনীতে ছোটদের নিয়ে নাটক, গান আয়োজন করা হয়। মৃত শিশুদের ব্যবহৃত জিনিস এবং ইজরায়েলের নিক্ষিপ্ত রকেটের খোল দিয়ে ইনস্টলেশন সাজানো হয়। সাদিক বলেন, ‘খুন, ডেস্ট্রাকশন, উচ্ছেদ এবং ভয়ের শিকার গাজার শিশুদের আর কেউ পরোয়াই করে না’।
২) সিনেমা
সিনেমা বানাতে যে পরিমাণ পরিকাঠামোর প্রয়োজন, তা হতদরিদ্র, নির্যাতিত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই প্রথম যুগের ফিলিস্তিনের সিনেমা হল প্রতিবেশী দেশে নির্বাসিত অথবা উদ্বাস্তু চিত্রপরিচালকের বানানো সিনেমা, যার বেশিরভাগই হল তথ্যচিত্র। লেবাননে সাতের দশকে একটি সিনেমার আর্কাইভ তৈরি হয়। সেখানে একশোর কাছাকাছি সিনেমা সংগ্রহ করা হয়, তবে সবই প্রায় তথ্যচিত্র। তার মধ্যে একটি ফিচার-ফিল্ম তৈরি হয় কানাফানির ‘ম্যান ইন দ্য সান’ অবলম্বনে। কিন্তু আটের দশকে ইজরায়েল লেবাননে হামলা করায় সেই আর্কাইভ ধূলিসাৎ হয় এবং তার সংগ্রহও অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে যায়। ২০১৬-’১৭ সালে যেটা সন্দেহজনকভাবে উধাও হয়েছিল, ইজরায়েলেই সেই ফিল্মের কিছু অংশের সন্ধান মেলে, কিন্তু ইজরায়েলের অথরিটি সেগুলোকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করে দেয়।
পড়ুন ‘মৃত্যু উপত্যকায় শিল্পীরা’-র প্রথম পর্ব: যে দেশ স্বপ্নে আকাঙ্ক্ষায় বেঁচে থাকে
নয়ের দশকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং জনপ্রিয় ফিলিস্তিনি ফিল্মমেকার এবং অভিনেতা এলিয়া সুলেইমান-র আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৯৬ সালে তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘Chronicle of a Disappearance’ খেলা করে কাহিনি বোনার কাঠামো নিয়ে। সাধারণত সিনেমার গল্পে আমরা যেটা স্বাভাবিকভাবেই দেখি, অর্থাৎ ‘প্লট’, সুলেইমান সিনেমায় সেটাকেই বাদ দেন। তথাকথিত আবশ্যিক ‘প্লট’ ও ‘ক্যারেক্টার ডেভলপমেন্ট’ ছাড়াই সুলেইমান এক বিছিন্ন ঘটনাবলির কোলাজ সাজান, যেখানে ঘটনাগুলি একে অপরের থেকে বিযুক্ত, অনেকটা ফিলিস্তিনের অস্ত্বিত্বের মতোই। ২০০২ সালে তাঁর দ্বিতীয় ছবি ট্র্যাজি-কমেডি ‘Divine Intervention’ কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘জুরি প্রাইজ’ জেতে।
এখানেও বিচ্ছিন্ন ঘটনার সিরিজ বর্ণনা দেয় নাজারেথ শহরের একটা দিন। তাঁর সিনেমা অনেক ক্ষেত্রেই উদ্ভট এবং আজগুবি সিচুয়েশন উদযাপন করে। সিনেমা শুরু হয় সান্তা ক্লজের পালানোর দৃশ্য দিয়ে, একদল কিশোর সান্তাক্লজকে তাড়া করেছে। তাদের থামাতে সান্তা গিফটের বাক্স ছুড়ে দিলেও বাচ্চাগুলোর গিফটে কোনও আকর্ষণ নেই। পালাতে পালাতে পাহাড়ের মাথায় এক চার্চের ভগ্নস্তূপে পৌঁছয় আর সেখানেই বাচ্চাদের হাতে সে ধরা পড়ে। তার বুকে গেঁথে থাকে বিশাল ছুরি আর দৃশ্যে ভেসে ওঠে শহরের নাম ‘নাজারেথ’। সুলেইমানের এই আজগুবি, বিচ্ছিন্ন, স্যুররিয়াল ঘটনা দেখানোর মধ্যে হয়তো ফিলিস্তিনের বাস্তবতাই দৃশ্যমান হয়। সিরিয়াস ভঙ্গিতে আজগুবি দৃশ্যায়ন আসলে বোঝায় যে দলনের প্রক্রিয়ায় সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়, কোনও কিছুই আর অস্বাভাবিক থাকে না। তা না হলে দলনের মধ্যে বেঁচে থাকাই দায়।
নিজের সিনেমায় সুলেইমানের ‘ডেড-প্যান’ অভিনয় তাঁকে ‘ফিলিস্তিনি বাস্টার কিটন’ নামে পরিচিত করেছে। এছাড়া তাঁর সিনেমার ‘স্যুররিয়াল ডার্ক কমেডি’ অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের নির্মম অত্যাচারের ভাষ্যে কমেডি কীভাবে স্থান পায়? ফিলিস্তিনীয় নৃতত্ববিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী শারিফ কানানা তাঁর গবেষণায় ‘ইন্তিফাদার জোকস’-এর সংকলন করেন এবং তার মাধ্যমে দেখান কীভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-কমেডি প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠে। আসলে, বাস্তবে যখন অত্যাচার-নির্যাতন ভয়ংকর রূপ নেয়, তখন সেটার প্রতিফলন ‘ট্র্যাজেডি’র মাধ্যমে সম্ভব হয় না, কারণ ট্র্যাজিক হিরোর হেরে যাওয়ার মধ্যে কোথাও একটা আপসহীনতার গর্ব থাকে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের অমানুষিক নিষ্পেষণে সেই গর্ব দেখানোর অবকাশ নেই, দেখালে সেটাই অশ্লীল। তাই এর একমাত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ঔদ্ধত্যে, কমেডি তাই চূড়ান্ত যন্ত্রণাকে সহনীয় করে তোলার হাতিয়ার হয় আবার হয়ে ওঠে হত্যাকারীর মুখের ওপর বেঁচে থাকার অট্টহাস্যও।
আমরা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ শিল্পের এই দ্বিতীয় ভাগকে টেনে নিয়ে যাব পরবর্তী, অর্থাৎ শেষ পর্বে। সেখানে আলোচনা করব সমসাময়িক আরও দুই শিল্পধারা নিয়ে, হিপ-হপ এবং থিয়েটার। হিপ-হপ একদমই আধুনিক সংযোজন ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ শিল্পে। হিপ-হপ সংগীতের ইতিহাস ও আঙ্গিক যেহেতু সবসময়ই প্রতিরোধের, তাই তা স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনি যুবদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
যদিও বিক্ষিপ্তভাবে আটের দশকে ফিলিস্তিনি থিয়েটার শুরু হয়, কিন্তু তা বেশিদিন চলে না। শিল্পীদের জেলবন্দি আর মিলিটারি ক্র্যাকডাউনে তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়, নয়তো প্রবাসী হয়ে পড়ে। সেই বিক্ষিপ্ত থিয়েটার মূলত ছিল নগরকেন্দ্রিক ও কিছু মাত্রায় শৌখিন, কিন্তু আমাদের আগ্রহের বিষয় হবে ২০০০ সাল পরবর্তী রিফিউজি ক্যাম্পে গড়ে ওঠা থিয়েটার– প্রতিরোধের থিয়েটার। বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে, খুনের হুমকি এবং খুন দেখেও অপ্রতিরোধ্য ক্যাম্পের শিশু-কিশোরদের করা নাট্যপ্রযোজনার রোমহর্ষক কাহিনি, যার প্রতিষ্ঠাতা মনে করিয়ে দেয় যে, তারা নির্যাতক ও নির্যাতিতর মাঝে দাঁড়িয়ে মহান সন্ত সেজে সংগ্রাম ছেড়ে শান্তির বাণী শোনাতে আসেননি। তাঁদের পক্ষ আছে, কারণ তাঁরা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’।
যেদেশে ক্রিকেট ধর্ম, সেই ক্ষেত্রয় শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ও বাঙালি প্লেয়ার হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে কত শুচিবাই, কত ট্যাবু, কত অসূয়া, কত সংস্কার ও তার জগঝম্পের ইতি না ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গবেষণা করলে ক্রিকেটের এক অন্যতর সামাজিক বীক্ষণ কি উঠে আসবে না?
রিয়েঙ্কা ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।