ফিলিস্তিনে সক্রিয় মানবাধিকার সংগঠনগুলি জানিয়েছে, গত ৪৭ দিনের যুদ্ধে ইজরায়েল ৫৪ হাজার বসতবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লক্ষ ৭৬ হাজার বাড়ি। গাজার মোট ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে ২৬টি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাকিগুলির অবস্থাও শোচনীয়। এখনও পর্যন্ত ৮৭টি অ্যাম্বুলেন্সের ওপর আক্রমণ হয়েছে। ৩০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠা আক্রান্ত। বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৬৭টি উপাসনাস্থল। যুদ্ধবিরতি না হয় হল, এই বিপুল ক্ষতর নিরাময় হবে কীভাবে?
পর্ব ৩
এক.
একটানা ৪৭ দিন গণহত্যা চালানোর পর অবশেষে ৪ দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হল ইজরায়েল। মধ্যস্থতাকারী কাতার জানিয়েছে, আপাতত চারদিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই সময়সীমা বাড়তে পারে। যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসাবে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি ৫০ জন ইজরায়েলি যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেবে৷ বিনিময়ে ইজরায়েলের কারাগার থেকে প্রথম দফায় বেরিয়ে আসবেন ১৫০ জন ফিলিস্তিনি। এই সংখ্যা আরও বাড়তেও পারে। যুদ্ধবিরতি চলাকালীন গাজায় কাউকে গ্রেফতার বা আক্রমণ করতে পারবে না ইজরায়েল। দক্ষিণ গাজায় তাদের ড্রোনে নজরদারি বন্ধ থাকবে। উত্তর গাজায় তারা দিনে ৬ ঘণ্টা ড্রোন নজরদারি করতে পারে। যুদ্ধবিরতির ফলে বিপুল সংখ্যক ত্রাণ নিয়ে অসংখ্য ট্রাক ঢুকতে পারবে গাজায়। তবে ইজরায়েলের একটানা হামলায় যাঁরা উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজায় সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা ফিরতে পারবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। সম্ভবত তাঁরা ফিরতে পারবেন না। এই জায়গা থেকেই ফিলিস্তিনিদের আশঙ্কা, উত্তর গাজা পাকাপাকিভাবে ইজরায়েল দখল করতে চলেছে।
পড়ুন যুদ্ধ পরিস্থিতি। পর্ব ১: মৃত শিশুদের মিছিলের মুখে অসহায় বেঁচে থাকা
যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়া ছাড়া বস্তুত ইজরায়েলের পক্ষে খুব কিছু করার ছিল না। যে দু’টি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে ইজরায়েল স্থল অভিযান শুরু করেছিল, তার কোনওটিই সফল হয়নি। ‘হামাস’, ‘পিএলএফপি’, ‘পিআইজে’-সহ
ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে ধ্বংস করা দূরের কথা, তাদের রকেট ছোড়ার ক্ষমতাও খর্ব করতে পারেনি ইজরায়েল।অন্যদিকে গত এক মাসেরও বেশি সময় স্থল-অভিযান চালিয়ে তারা মাত্র একজন ইজরায়েলি যুদ্ধবন্দিকে মুক্ত করতে পেরেছে। লন্ডনে কর্মরত ইজরায়েলি মানবাধিকার কর্মী কাসিফ ওফর বলছিলেন, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি দীর্ঘদিন ধরেই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। কিন্তু ইজরায়েল কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। নেতানিয়াহু প্রশাসনের অতিদক্ষিণপন্থী কার্যকলাপ দেশের মধ্যেই বিপুল সমালোচনার মুখে পড়ছে। প্রতিদিন যুদ্ধবন্দিদের পরিজনরা তেল আভিবের রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন। নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিও উঠতে শুরু করেছে। শুধু তা-ই নয়, স্থল-অভিযান শুরু করার পর ইজরায়েলের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও খুব কম নয়। প্রচুর ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়েছে। সরকারি হিসাবে অন্তত ৭১ জন সেনা আধিকারিক মারা গিয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি।
যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাময়িক স্বস্তি দিচ্ছে সব পক্ষকেই। প্যালেস্তাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেনের বেন জামাল অবশ্য সতর্ক। তিনি বলছেন, ‘গাজার অবস্থা ভয়াবহ। খাবার নেই, পানীয় জল নেই, চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালগুলির উপরেও হামলা হয়েছে। কার্যত অনাহারে মৃত্যুর মুখে কয়েক হাজার মানুষ। এই অবস্থায় চারদিনের যুদ্ধবিরতি কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। প্রয়োজন দীর্ঘস্থায়ী শান্তি। তবে আশার কথা এটাই, এই যুদ্ধবিরতির সুযোগে বেশ খানিকটা ত্রাণ গাজার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে।’
ইংল্যান্ডের রেল, নৌ এবং সড়কপথ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা অ্যালেক্স গর্ডন প্রথম থেকে কাজ করছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, এখনও পর্যন্ত অন্তত ১৪ হাজার ১০০ জন মানুষ ইজরায়েলের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৫,৬০০ জন শিশু, ৩,৫৫০ জন মহিলা। বেছে বেছে সিভিলিয়ানদের হত্যা করা হয়েছে। গুরুতর আহত অন্তত ৩৩ হাজার মানুষ। ৬,৮০০ জনের কোনও খোঁজ নেই। তাঁদের অনেকেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। যুদ্ধবিরতির সময়কালে যদি তাঁদের একাংশকে উদ্ধার করা যায়, তাহলে মৃতের সংখ্যা আরও অনেকটা বাড়বে।
পড়ুন যুদ্ধ পরিস্থিতি। পর্ব ২: এই গণহত্যার রক্ত কেবল জায়নবাদীদের হাতেই লেগে রয়েছে, সব ইহুদির হাতে নয়
যুদ্ধ শুরু হওয়ার একদম প্রথম থেকে যুদ্ধবিরতির দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন লেবার পার্টির প্রাক্তন নেতা জেরেমি করবিন, যিনি ২০১৭ এবং ২০২০ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন। যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে করবিন বললেন, ‘প্যালেস্তাইনের বুকে যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা চারদিনের যুদ্ধবিরতিতে নিরাময় হওয়ার নয়। এথনিক ক্লিনজিং ঘটছে প্যালেস্তাইনে। একটা জনগোষ্ঠীকে গায়ের জোরে, স্রেফ খুন করে মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যুদ্ধবিরতি নিঃসন্দেহে কিছুটা হলেও সদর্থক পদক্ষেপ, কিন্তু স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
ফিলিস্তিনে সক্রিয় মানবাধিকার সংগঠনগুলি জানিয়েছে, গত ৪৭ দিনের যুদ্ধে ইজরায়েল ৫৪ হাজার বসতবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লক্ষ ৭৬ হাজার বাড়ি। গাজার মোট ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে ২৬টি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাকিগুলির অবস্থাও শোচনীয়। এখনও পর্যন্ত ৮৭টি অ্যাম্বুলেন্সের ওপর আক্রমণ হয়েছে। ৩০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত। বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৬৭টি উপাসনাস্থল।
যুদ্ধবিরতি না হয় হল, এই বিপুল ক্ষতর নিরাময় হবে কীভাবে?
দুই.
যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন শুরুর প্রথম দিন থেকেই প্রতিবাদীদের হাতে হাতে ঘুরছে কাটা তরমুজের ছবি। অনেকে তরমুজের পোস্টার হাতে এঁকে নিয়ে আসছেন। সঙ্গে ক্যাপশন, ‘ফ্রি প্যালেস্তাইন’। অনেকে আস্ত তরমুজ মাঝ বরাবর কেটে হাতে নিয়ে হাঁটছেন মিছিলে। সোশাল মিডিয়াতেও বারবার তরমুজের ছবি ব্যবহৃত হচ্ছে প্যালেস্তাইনের পক্ষের প্রতীক হিসাবে। কিন্তু কেন তরমুজ আর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম একে অন্যের হাত জড়িয়ে ধরল?
পিছিয়ে যেতে হবে ৫৬ বছর আগে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে ইজরায়েল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজা এবং পূর্ব-জেরুজালেম দখল করে নেয়। ইজরায়েল সরকার ঘোষণা করে, কেউ প্যালেস্তাইনের পতাকা ওড়ালে তা ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ হিসাবে গণ্য করা হবে। সেই সময় থেকেই গ্রেপ্তারি এড়াতে স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে তরমুজ ব্যবহার করতে শুরু করেন ফিলিস্তিনিরা। তরমুজ হয়ে ওঠে এক ধরনের কোড, অথবা ইঙ্গিত, যা ফিলিস্তিনিদের বুকে জাগিয়ে রাখত স্বাধীনতার প্রতিস্পর্ধী বারুদ। তরমুজ কাটলেই দেখা যায় তিনটি রং– সবুজ, লাল এবং কালো। ঠিক যেন প্যালেস্তাইনের পতাকা। তাই দখলদার ইজরায়েলের নজরদারির ভিতর বুক থেকে বুকে মুক্ত প্যালেস্তাইনের নিষিদ্ধ ইস্তাহার পাচার করে দিত তরমুজ।
২০২১ সালে শিল্পী স্লিমান মানসুর ‘দ্য ন্যাশনাল’ পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ১৯৮০ সালের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। তখনও প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হয়নি। ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বে তার প্রস্তুতিপর্ব চলছে। মানসুরের কথায়, ‘‘রামাল্লার ৭৯ গ্যালারিতে শিল্পী নাবিল আনানি এবং ইসাম বাদ্রেলের সঙ্গে আমি-সহ কয়েকজন শিল্পীর একটি প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল। ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ সেটি বন্ধ করে দেয়। তারা এসে বলে, কেবল প্যালেস্তাইনের পতাকার ছবি আঁকাই যে নিষিদ্ধ তা নয়, ওই পতাকার রঙেও কিছু আঁকা যাবে না। শিল্পী ইসাম তাদের প্রশ্ন করেন, ‘আমি যদি লাল, সবুজ, কালো রঙের ফুল আঁকি, তাহলে কী হবে?’ ইজরায়েলি সেনার ওই সদস্য উত্তর দেয়, ‘সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওই ফুলের ছবি বাজেয়াপ্ত করব। এমনকী, যদি একটি তরমুজের ছবিও আঁকা হয়, সেটিও বাজেয়াপ্ত করব আমরা।’’
প্যালেস্তাইনের পতাকার প্রতি ইজরায়েলের এই আতঙ্কমিশ্রিত বিদ্বেষ রয়েই গিয়েছে। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির পর ফিলিস্তিনি পতাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা খাতায়-কলমে তুলে নেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় আচরণ তেমন কিছু বদলায়নি। সেই বিদ্বেষ ছুঁয়ে গিয়েছে তরমুজকেও। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জন কিফনার বলেছেন, কেবল তরমুজ হাতে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে গাজা স্ট্রিপে বেশ কিছু ফিলিস্তিনিকে ইজরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামের সঙ্গে গত সাড়ে ৫ দশকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে তরমুজ৷ দ্বিতীয় ইন্তিফাদার কিছুদিন পরে, ২০০৭ সালে শিল্পী খালেদ হৌরানি আঁকেন ‘তরমুজের নিশান’ ছবি। তারপর থেকে পৃথিবী জুড়ে প্যালেস্তাইন ডায়াস্পোরা এবং আরব জনতার হাতে হাতে ঘোরে সেই নিশান। এমনকী, জায়নবাদীদের নাকের ডগায়, খোদ ইজরায়েলেও ওড়ে তরমুজ-পতাকা।
গত জানুয়ারি মাসে ইজরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির ইজরায়েলি পুলিশকে ফিলিস্তিনি পতাকা দেখলেই বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে খোদ ইজরায়েলেই। এখানেও প্রতিবাদীদের হাতিয়ার হয় তরমুজ। জাজিম নামে একটি আরব-ইজরায়েলি কমিউনিটি সংগঠন ফিলিস্তিনি পতাকা বাজেয়াপ্ত করা এবং যাঁরা সেই পতাকা ওড়াবেন তাঁদের গ্রেপ্তারির সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে। তেল আভিবের রাস্তায় ১৬টি ট্যাক্সির স্ক্রিনে সেঁটে দেওয়া হয় তরমুজের ছবি। সঙ্গে ক্যাপশন, ‘এটা প্যালেস্তাইনের পতাকা নয়’। জাজিম-এর ডিরেক্টর রালুকা গানিয়া জানিয়েছেন, সরকারের প্রতি তাঁদের বার্তা খুব স্পষ্ট। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যদি আক্রমণ হয়, তাহলে তাঁরা ঠিকই নিজেদের কথা বলার জন্য বিকল্প রাস্তা খুঁজে নেবেন।
এইরকম করেই পথ হাঁটছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রাম। কখনও সশস্ত্র যুদ্ধ, কখনও অহিংস প্রতিবাদ, কখনও প্রতীকের আড়ালে– গোপনে, চুপিচুপি।